X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ আসাদ দিবস

সালেক উদ্দিন
২০ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০৪আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০৭

সালেক উদ্দিন
আজ (২০ জানুয়ারি) শহীদ আসাদ দিবস। মোহাম্মদপুরের আসাদগেট, আসাদ এভিনিউতে ঢুকতে বা বের হতে শহীদ আসাদের কথা আমাদের সেকালের মানুষের অনেকেরই মনে পড়ে। আজকের সময়ের মানুষেরা, বিশেষ করে ছাত্রসমাজ শহীদ আসাদ এবং সে সময়ের ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে কতটা জানে বা তা লালন করার চেষ্টা করে বলা মুশকিল। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতার একটি লাইন- 'পুরানো নক্ষত্রের দিন শেষ হয় নতুনেরা আসিতেছে বলে'। কথাটি সত্য হলেও তা মেনে নিতে কষ্ট হয়। আর তাই শহীদ আসাদ দিবস উপলক্ষে ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু কথা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম মাত্র।

নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ধনিয়া গ্রামের ২৬ বছর বয়সের এক তরতাজা যুবকের নাম ছিল আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ছাত্র রাজনীতির সাথে ছিল তাঁর আত্মার সম্পর্ক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) ঢাকা হল শাখার সভাপতি ছিলেন তিনি। একইসাথে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিতপ্রাণ আসাদুজ্জামান গরিব ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষার অধিকারের বিষয়ে সর্বদা সজাগ ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং কৃষক সমিতির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নির্দেশনায় কৃষক সমিতিকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে শিবপুরের মনোহরদী, রায়পুরা, নরসিংদী এলাকায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন আসাদ। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিতপ্রাণ আসাদুজ্জামান গরিব ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষার অধিকারের বিষয়ে সর্বদা সজাগ ছিলেন। তিনি শিবপুরে একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিবপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে আর্থিক তহবিল গড়ে তোলেন।

১৯৬৯ সালে শাহাদাতবরণের কিছু দিন আগে হাতিরদিয়া বাজারে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ডাকা ‘হাট হরতাল’ করতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতনে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন আসাদ। সে অবস্থায় মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধেই ঢাকায় এসেছিলেন খবর দিতে। বিভিন্ন পত্রিকায় তার দেওয়া খবর প্রকাশিত হয়েছিল। পরে সে বছরেরই ২০ জানুয়ারি স্বৈরাচার আইয়ুব খান সরকারবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। নিজেই হয়ে ওঠেন আরেকটি খবর। এরপর থেকে এই দিনটি শহীদ আসাদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তার এই আত্মত্যাগ শুধু ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং পরবর্তীতে আইয়ুব খানের পতন, আগরতলা মামলা বাতিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উভয়ভাবেই ত্বরান্বিত করেছিল। শহীদ আসাদ স্থান করে নিয়েছিলেন ইতিহাসের পাতায়।

ইতিহাস বলে, এই গণঅভ্যুত্থানের প্রস্তুতি চলছিল ১৯৬৮ সাল থেকে। সে বছরের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে পল্টনের জনসভা শেষে মওলানা ভাসানী তৎকালীন গভর্নর ভবন (বর্তমানে বঙ্গভবন) ঘেরাও করেছিলেন। ঘেরাও শেষে ৭ ও ৮ ডিসেম্বর হরতাল ডেকেছিলেন। হরতাল সফল হয়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে ছিলেন। মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেছিলেন, শেখ মুজিবকে মুক্তি না দিলে ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে তাকে মুক্ত করা হবে। এই আন্দোলন গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি ২৯ ডিসেম্বর ‘হাট হরতালের’ ডাক দিয়েছিলেন। সারা দেশের মানুষ তার ডাকে সাড়া দিয়েছিল। শহর থেকে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত বেগবান হয়েছিল আন্দোলনের ঝড়ো হাওয়া।

১৯৬৯ সালের শুরুতে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও এনএসএফ-এর একাংশ নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। ১৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অর্থাৎ শহীদ আসাদ। তাদের নেতৃত্বে ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ হয়েছিল।

২০ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট চলছিল। সরকারের পূর্বঘোষিত ১৪৪ ধারা ভেঙে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে সকাল থেকেই জড়ো হচ্ছিল। দুপুরে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা শেষে হাজার হাজার ছাত্রের মিছিল চানখারপুলের কাছে এলে পুলিশ হামলা চালায়। পুলিশের সাথে সংঘর্ষের পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হল (শহীদুল্লাহ হল)-এর পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছে থেকে আসাদকে গুলি করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন আসাদ। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে বের হলো অদম্য মিছিল। কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতা। কবি হেলাল হাফিজ ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’-এর মাধ্যমে। আসাদের মৃত্যুর দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো দেশময়। গণআন্দোলন পরে রূপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে। হাজারো ছাত্র-জনতা আসাদের মৃত্যুতে একত্রিত হয়ে পুনরায় মিছিল বের করে এবং শহীদ মিনারের পাদদেশে জমায়েত হয়। কেন্দ্রীয় প্রতিরোধ কমিটি তাকে শ্রদ্ধা জানাতে ২৪ জানুয়ারি সারাদেশে ধর্মঘট আহ্বান করে। দেশব্যাপী বেগবান হয় আন্দোলন। ফলশ্রুতিতে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সরকার প্রথমত দুই মাসের জন্য ১৪৪ ধারা আইন প্রয়োগ স্থগিত রাখতে এবং পরবর্তীতে ক্ষমতা ছাড়তেও বাধ্য হয়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুসহ অন্য আসামিরা নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেছিলেন। অতএব, বাংলাদেশের ইতিহাসে আসাদের শাহাদাতবরণের ২০ জানুয়ারি রক্তাক্ষরে লেখা একটি বিশেষ দিন।

বাংলাদেশের অনেক জায়গায় জনগণ আইয়ুব খানের নামফলক পরিবর্তন করে শহীদ আসাদের নামফলক স্থাপন করেছিল। যেমন, মোহাম্মদপুরস্থ আইয়ুব গেটের নাম রাখা হয়েছিল আসাদগেট, আইয়ুব এভিনিউ পরিবর্তিত হয়ে হয়েছিল আসাদ এভিনিউ এবং আইয়ুব পার্ক হয়েছিল আসাদ পার্ক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকে জনগণ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের স্মারক ও অমর আসাদ শিরোনামে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছিল। শিবপুরের উধুনিয়া এলাকায় স্থানীয় লোকজন ১৯৭০ সালে শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ নামে একটি মহাবিদ্যালয় এবং ১৯৯০ সালে আসাদের নিজ গ্রাম ধনিয়ার স্থানীয় অধিবাসীরা শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

অতি সংক্ষিপ্ত আকারে এই হলো শহীদ আসাদ দিবসের ইতিহাস। এই ইতিহাসের মধ্যেই সে সময়ের ছাত্র রাজনীতির একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। তখন ছাত্র রাজনীতি ছিল খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণের সাধনা, গরিব ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত ও সর্বত্র শিক্ষার আলো ছড়ানোর ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা। অন্যায় হটিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি সমাজের কল্যাণ সাধন ছিল ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য। কল্যাণের জন্যে ছাত্ররা ছিল দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ। আদর্শের লড়াই ছিল সেই রাজনীতির ভিত। ব্যক্তি বা দলগত স্বার্থের ভূত তখনও তাদের ওপর দখল নিতে পারেনি বলেই হয়তো ছাত্ররা যখন কোনও দাবি নিয়ে একত্রিত হয়েছে তখন তা অর্জিত হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

শহীদ আসাদের সময়ের ছাত্র রাজনীতির সাথে এখনকার ছাত্র রাজনীতি মিলিয়ে দেখার সম্ভবত এটাই মোক্ষম সময়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাতে নামছে বার্সা-পিএসজি
রাতে নামছে বার্সা-পিএসজি
জার্মানির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিকশিত করতে যে শর্ত দিলো চীন
জার্মানির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিকশিত করতে যে শর্ত দিলো চীন
স্থায়ী জামিন পেলেন না ড. ইউনূস
স্থায়ী জামিন পেলেন না ড. ইউনূস
আইপিএল থেকে অনির্দিষ্টকালের বিরতি নিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল!
আইপিএল থেকে অনির্দিষ্টকালের বিরতি নিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ