X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘উন্নয়ন’ খেয়ে কি মিটে ক্ষুধা?

রুমিন ফারহানা
৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ১৭:১১আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ১৭:১৩




রুমিন ফারহানা আফগানিস্তান সম্ভবত গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে প্রিয় দেশ। যে কোনও বিষয়ে বৈশ্বিক বা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের কোনও সূচক প্রকাশিত হলে মোটামুটি অবধারিতভাবে দেখা যায়, বাংলাদেশ সেই সূচকে একেবারে সবার শেষে আছে; কোনও কোনও ক্ষেত্রে আফগানিস্তান বাংলাদেশের পেছনে থাকে। হাতে গোনা দুই একটি বাদে আর প্রায় সব ক্ষেত্রে, এমনকি পাকিস্তানও আমাদের আগে থাকে। আফগানিস্তান অনেক ক্ষেত্রেই অনেক সূচকে এই অঞ্চলে সর্বশেষ অবস্থানটি পেয়ে বাংলাদেশকে লাস্ট হওয়া থেকে অনেক সময়ই বাঁচিয়ে দেয়। আফগানিস্তান প্রীতি তো হবারই কথা, তাই না?
এই বছরের আগস্ট মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের স্ট্যাটিসটিক্যাল ক্যাপাসিটি স্কোরে দেখা যায় বাংলাদেশ যথারীতি দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের পেছনে আছে; শুধু আফগানিস্তান আছে বাংলাদেশের পেছনে। অবশ্য আফগানিস্তানকে পেছনে দেখে আমরা কতটুকু মানসিক শান্তি পাবো জানি না।
বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় মূলত তথ্যের উৎস দুর্বলতা, মেথডোলজিক্যাল দুর্বলতা বা মান নির্ধারণে দুর্বলতা, নির্ভুলতা ও নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশ করতে না পারার কারণেই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের তথ্যের মান দুর্বল হচ্ছে।

এই রিপোর্টের পর সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে, বাংলাদেশের যেকোন‌ও বিষয়ের সঠিক পরিসংখ্যানের কাছাকাছি পৌঁছ‌তে সরকারি প্রতিষ্ঠান দেওয়া নেগেটিভ পরিসংখ্যানকে ৩/৪/৫ দিয়ে গুণ করে আর পজিটিভ পরিসংখ্যানকে ৩/৪/৫ দিয়ে ভাগ করতে হবে। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই খুব সম্প্রতি প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানের কিছু তথ্য দেখে নেওয়া যাক।

এই গবেষণাটি করেছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এ বিষয়ে ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেখান থেকে জানা যায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অন্যান্য শহর অঞ্চলে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাওয়া যাওয়া মানুষের হার যেখানে চার দশমিক ৮৪ শতাংশ, সেখানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের শহরাঞ্চলে এই হার নয় দশমিক ২৩ শতাংশ।

জরিপে সারা দিনে একবেলাও খেতে পারেনি এমন পরিবার পাওয়া যায় প্রায় তিন শতাংশ। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এই হার তিন দশমিক ১৭ শতাংশ।

এতে আরও দেখা যায়, সাত শতাংশ পরিবার কম পরিমাণে খাবার গ্রহণ করছে, প্রায় ১৫ শতাংশ পরিবার অপছন্দের খাবার খাচ্ছে এবং ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ পরিবার খাবারের পরিমাণই কমিয়ে দিয়েছে।

শতাংশ দিয়ে প্রকাশিত পরিসংখ্যানটি দিয়ে আমরা হয়তো পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণা করতে পারি না। তাই কয়েকটি সংখ্যা একটু জেনে নেওয়া যাক। ঢাকা শহরের যদি দুই কোটির মতো মানুষ থাকে তাহলে সেখানে ৬ লক্ষ ৩৪ হাজার মানুষ সারা দিনে এক বেলায় খেতে পায়নি। আর ঢাকায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যায়।

দ্য আরবান স্যোসিও-ইকোনমিক অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে (ইউএসএএস) ২০১৯ নামের এই জরিপটি পরিচালনা করে বিবিএস। গত বছরের ৮ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই জরিপটি চলে।

এই পরিসংখ্যানটি হচ্ছে করোনা শুরু হওয়ার আগের সময়ের। তাহলে করোনার সময় যখন সাধারণ ছুটির নামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল, তখন কেমন ছিল এই দেশের কোটি কোটি মানুষ? এখন মোটামুটি সবকিছু খুলে দেওয়ার পরও দেশের অর্থনীতি ঠিক আগের গতিতে চলছে না। তাহলে এখনও কত মানুষ এই ভয়ঙ্কর অবস্থায় আছে?

‘মেনেজ তো করতে পারি না। এখন এক ওয়াক্ত খাইয়া, আরেক ওয়াক্ত না খাইয়া, বাচ্চাগুলারে কম কম খাওয়াইয়া, কোনও রকমে দিন যাইতেছে’– উক্তিটি পারুল বেগমের। ২ দিন আগে বিবিসি বাংলার একটি রিপোর্টে তিনি কথা বলেন। সম্প্রতি চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে তিনি যে বিপদে পড়েন সেটাই বলছিলেন। তিনি জানান, স্বামীর অসুস্থতার পর সংসারের হাল ধরেছেন তিনি। কাজ করেন গৃহকর্মী হিসেবে। সংসারের খরচ টানতে টানতে হাঁপিয়ে উঠছেন। পারুল বেগম বলেন, যে চাল কয়েক মাস আগেও ১৬-১৭শ’ টাকায় কিনেছেন তিনি, সেই চাল এখন কিনতে হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ দামে।

এই হচ্ছে এমন একজন নারীর পরিস্থিতি, যার কাজ আছে, এবং যিনি চালের মূল্যবৃদ্ধির আগে আধপেটা খেয়ে থাকতেন না। চালের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে তার এখন এই অবস্থা। আচ্ছা করোনার আগের যে পরিসংখ্যান নিয়ে কথা বলছিলাম সেই পরিসংখ্যানে তখনই যারা আধপেটা খেয়ে কিংবা একেবারে না খেয়ে দিন কাটাতো, কেমন আছে তারা এখন? তাদের সঙ্গে কত মানুষ নতুন করে যুক্ত হয়েছে?

যখনই দেশে খাদ্য নিয়ে কথা হয় তখনই সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলার চেষ্টা হয় দেশে খাদ্যশস্যের মজুত খুব ভালো অবস্থায় আছে। কত লাখ মেট্রিক টন চাল উদ্বৃত্ত আছে সেই তথ্য আমাদের সামনে নিয়মিতভাবে আসে। মজার ব্যাপার এখানেও আবার আসে পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন। এবার আর দেশের বাইরের কোনও সংস্থা নয়, স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, দেশে খাদ্যের উৎপাদন ও ভোগ নিয়ে তথ্যের মধ্যে যথেষ্ট ঘাটতিও রয়েছে। তাই সরকার এবার সব সংস্থার তথ্যকে সমন্বয় করে একটি একক তথ্যভান্ডার তৈরিতে গুরুত্ব দেবে।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই খাদ্যশস্য প্রচুর উদ্বৃত্ত আছে, তারপরও সেটা কি মানুষের কাছে সুলভে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট? অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের নোবেল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল যে মূল গবেষণা সেটা দুর্ভিক্ষ নিয়ে। সেই গবেষণায় তিনি বিশ্বের অনেক বিখ্যাত দুর্ভিক্ষের উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন, সেই দুর্ভিক্ষগুলো খাদ্যের মজুতের অভাবজনিত কারণে না, বরং মানুষের খাদ্যের প্রাপ্যতা (একসেস টু ফুড) নিশ্চিত না হওয়ার কারণে হয়েছিল।

এবার তাহলে হঠাৎ করে চালের দাম এত উপরে উঠে গেলো কেন? এর জবাব আছে সরকারের মজুতের পরিমাণে। বিবিসি বাংলার ওই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সরকারি হিসাবে ৫ লাখ ৫১ হাজার ২৯০ টন চাল মজুত আছে, যদিও গত বছর একই সময়ে মজুত ছিল প্রায় সাড়ে দশ লাখ টন চাল। কি অদ্ভুত, তাই না? করোনার কারণে এই বছরের চালের মজুত থাকা উচিত ছিল গত বছরের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ, কিন্তু আছে তার অর্ধেক। করোনার শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল, করোনার কারণে একদিকে মানুষকে অনেক বেশি খাদ্য সাহায্য দেওয়ার প্রয়োজন হবে, আবার অন্যদিকে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী কৃষির সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বিশ্ববাজারেও খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বলা বাহুল্য, সরকার শোনেনি সেই কথা।

এই বছর সরকার অনেক বেশি পরিমাণ চাল কিনলে সেটা গত বোরো এবং এবারকার আমন মৌসুমে যেমন কৃষকদের জন্য ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারতো, তেমনি সরকারের হাতে অনেক চাল থাকলে সেটা বড় বড় রাইস মিল মালিকদের বাজারে কারসাজি করতে বাধা দিতো।

ঢাকা শহরে এখন চলতে গেলে ওএমএসের দোকান কিংবা ট্রাকের সামনে মানুষের দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে মানুষ কিছুটা কম দামে চাল কিনছে সেখান থেকে। মজুতের যে তথ্য পাই আমরা, সেটা বিবেচনায় নিলে এভাবে চাল বিক্রি আর কয়দিন করতে পারবে সরকার?

সরকারের নিজের মজুতে চাল নেই অথচ বাজারের এই পরিস্থিতি মাথায় রেখে উচিত ছিল বহু আগে চাল আমদানি করা। কিন্তু এটার প্রক্রিয়া এখন মাত্র শুরু হয়েছে। ফলে চাল আসতে আসতে বাজারের এই অস্থিরতা আরও খারাপ পর্যায়ে পৌঁছবে। বরং যখন এসে এই চাল পৌঁছাবে তার প্রভাবে আগামী বোরো মৌসুমে ধানের মূল্য পড়ে গিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

যে মানুষগুলো না খেয়ে রাতে ঘুমাতে যায় কিংবা সারা দিনে পায় না একবেলা খাবার‌ও, সেই মানুষগুলো কি জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি বোঝে? তারা কি বোঝে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে কতটা? তারা কি জানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কতটা বেড়েছে? এসব জানলে কি তাদের ক্ষুধার কষ্ট কমবে কিছুটা?

কিছু দিন আগে আইএমএফের একটি রিপোর্ট নিয়ে সরকার বেশ শোরগোল করেছিল- এই অর্থবছরে বাংলাদেশের কিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি হওয়া আর ভারতের উল্টো জিডিপি সংকুচিত হওয়ার ফলে আগামী বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে, যদিও তার পরের বছরই ভারত আবার আমাদের ছাড়িয়ে যাবে। এখানে খুবই উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, পিপিপি (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) বা ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে এখনও ভারত আমাদের চাইতে অনেকটা ভালো অবস্থানে আছে। ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৬ হাজার ২৮৪ পিপিপি ডলার, আর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৫ হাজার ১৩৯ পিপিপি ডলার।

দেশের সব মানুষের মোট আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে দিয়ে যে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়, সেটা কখনও দেশের বেশিরভাগ মানুষের সত্যিকার অবস্থাকে প্রকাশ করে না। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের পেছনে। এবং তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার (২১.৮%) ভারতের (১১.১%) তুলনায় দ্বিগুণ।

যেহেতু সত্যিকার অর্থে এই দেশের সাধারণ মানুষ ভালো নেই, তাই ক্রমাগত আমাদের সামনে উন্নয়নের প্রপাগান্ডা চলে। প্রপাগান্ডা দিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয় যাবতীয় অসাম্য, অন্যায্যতা, আর তৈরি করার চেষ্টা করা হয় যেকোনোভাবে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার ন্যায্যতার বয়ান।

জবাবদিহিহীন ক্ষমতা এক ধরনের অন্ধত্ব তৈরি করে, তাই সেই ক্ষমতা ভুলে যায়- ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’। তথাকথিত উন্নয়নময় বাংলাদেশের বয়ান মানুষকে ক্ষুধার জ্বালা থেকে বাঁচায় না, বরং ক্ষুধার্ত মানুষের কানে উন্নয়নের বয়ান তাদের বিবমিষা জাগায়, অন্তরের গভীর থেকে বের করে আনে ভয়ঙ্কর অভিশাপ।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
তিন লাল কার্ডের ম্যাচে মোহামেডানের খেলতে অস্বীকৃতি, আবাহনীকে জয়ী ঘোষণা
তিন লাল কার্ডের ম্যাচে মোহামেডানের খেলতে অস্বীকৃতি, আবাহনীকে জয়ী ঘোষণা
প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে নিজেকে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, গ্রেফতার ১
প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে নিজেকে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, গ্রেফতার ১
ইরান হামলা বন্ধ করলেও ছায়াশক্তিরা সক্রিয়
ইরান হামলা বন্ধ করলেও ছায়াশক্তিরা সক্রিয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ