X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নতুন বছরে জাগুক নতুন উপলব্ধি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:৩১আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:৩২







সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা শেষ হলো ২০২০। মানুষের অপেক্ষা ছিল কবে শেষ হবে, কখন সেই অন্তিম লগ্ন আসবে অভিশপ্ত বছরটির। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিছু দেশ অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি পর্যদুস্ত। ২০২০ সাল শেষ হলো, কিন্তু কোভিড-১৯ বিদায় নেয়নি। বরং আমরা দেখছি যুক্তরাজ্যে এই ভাইরাসের নতুন রূপ এসেছে, যেটি আরও সংক্রামক এবং প্রাণঘাতী। একমাত্র ভ্যাকসিন আবিষ্কারটাই আমাদের আশান্বিত করে তুলছে।



ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে এবং মানুষ আশা করছে তুখোড় ভ্যাকসিনে দুর্বল হতে বাধ্য হবে ভাইরাস। কিন্তু সংশয়ের মন মানুষের। তাদের ভয় বিশ্বজুড়ে টিকা-রাজনীতি খুব প্রখর হবে এবং বাংলাদেশে দুর্নীতি ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে টিকা নিয়ে গোলযোগ হতে পারে। অতি সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তই হয়তো টিকার আওতায় আসবে না। তবে আমরা এও জানি যে, আমাদের মানুষ যেহেতু সৃজনশীল, পরিশ্রমী, তাই তারা নিজের হাতেই নেবে তাদের নির্ভরতার চাবি, চেয়ে থাকবে না সরকারের পানে।

এমনভাবে ইংরেজি নতুন বছরকে আমরা আসতে দেখিনি আগে। বছরের শুরুতে মানুষের এমন মনমরা দশা আমরা কেউ কখনও দেখিনি, শুনিনি। মানুষ মন্বন্তর দেখেছে, অনাহারি মানুষ দেখেছে। কত বড় বড় রোগ দেখেছে। কিন্তু এমন আতঙ্কিত বন্দিদশা আগে দেখেনি।

বাংলাদেশের অর্থনীতির ভয়ানক ক্ষতি হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ রোজগার হারিয়েছে, বেকার হয়েছে, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটেছে। সেই যে মার্চ মাসে স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলো, এখনও খুলতে পারছে না। কবে খুলবে সেই নিশ্চয়তা নেই। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ৬৬ আর গ্রামাঞ্চলের ৪১ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে।
তাই করোনা আমাদের কি শিক্ষা দিয়েছে সেটা নিয়ে চিন্তা করা দরকার। উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু গড় আয় বেশি নিয়ে যে মোহ আমাদের এতদিন ছিল তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ কল্যাণ রাষ্ট্র নয় এবং তার সম্পদও সীমিত। সেই সীমিত সম্পদও দুর্নীতির কারণে দখলে রেখেছে গুটি কয়েক মানুষ। তাই সরকারের বিবেচনায় প্রথম ভাবনা হতে হবে মানুষের জন্য কাজ। প্রযুক্তির উৎকর্ষে আর পরিসংখ্যানের জাদুতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটানো যেতেই পারে। তবে মানুষের হাতে কাজ না থাকলে সেই পরিসংখ্যান মূল্যহীন। করোনা পরিস্থিতি উত্তরণে প্রথম প্রশ্নটিই অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং সেটি হবে মানুষের জন্য প্রচুর কাজ সৃষ্টির মাধ্যমে।
মানুষকে কাজ দিতে হবে। কারণ, দিন শেষে কাজই একজন মানুষকে অন্য আরেকজন থেকে থেকে আলাদা করে। সমস্যা হলো আমাদের কাজ নেই। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য কাজের মতো কাজ নেই। অসংগঠিত অর্থনীতির এই দেশে তবু মানুষ কাজ করে। কারণ, কাজ ছাড়া তার বাঁচার জন্য রাষ্ট্র কিছু রাখেনি। দরিদ্র মানুষ, অসহায় মানুষ, সম্বলহীন মানুষ কাজ করে দিনরাত। করোনায় সেই পথটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কাজের মানুষের হাত সাহায্যের জন্য সম্প্রসারিত হচ্ছিল। সরকারের কৃতিত্ব এখানেই যে সে দ্রুততার সাথে জীবিকা বাঁচানোর প্রচেষ্টায় সবকিছু খুলে দিয়ে মানুষকে কাজে ফিরিয়ে আনে।  
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বেকারত্ব সবসময় বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। করোনার আগ থেকেই দীর্ঘ সময় বেকারত্ব ভয়ানকভাবে বাড়ছিল। করোনা মহামারি এই অবস্থাকে আরও খারাপ করেছে। বিরাট সংখ্যক মানুষ চাকরি বা তাদের জীবিকা হারিয়েছে। সরকার জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য আনতে সবকিছু খুলে দিলে কাজের সুযোগটা ধীরে ধীরে ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু কিছু চাকরি চিরতরে হারিয়েই গিয়েছে।
যে দেশে লাখ লাখ গরিব মানুষের বসবাস সেই দেশের পক্ষে এমন একটা পরিস্থিতি কোনোভাবেই সুখকর নয়। এতে ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের মনে হতাশা সৃষ্টি হয়। তাই নতুন বছরের বড় ভাবনা হতে হবে দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিন এনে, তা সুষ্ঠুভাবে বিতরণের মাধ্যমে রোগ দূর করা এবং মানুষের জন্য কাজ সৃষ্টি করা।
এ দেশের অতি সাধারণ মানুষ ধনিক শ্রেণির মতো প্রণোদনা চায় না, বিশেষ গোষ্ঠীর মতো সৃষ্টিকর্তার কথা বলে দান, খয়রাত, লিল্লাহ, সদকা সাহায্য চায় না। তারা কাজ চায়। তারা কাজ করেই আনন্দ পায়। কাজের মাঝেই সে তার মর্যাদা খুঁজে পায়। কাজই তার পুরস্কার বা প্রণোদনা। বৃহত্তর অর্থে সমাজে একজনের টিকে থাকার ব্যাপারটাও নির্ধারিত হয় কাজ দিয়ে। আজ লক্ষ লক্ষ মানুষের কাজের প্রয়োজন, কিন্তু তারা কাজ খুঁজে পায় না। তারা বেকার। এই বেকারত্বে আঘাত হানতে হবে। আমরা জানি অনলাইন আর মোবাইল ফিন্যানসিয়াল সার্ভিসকে ঘিরে তুখোড় উদ্যোক্তা আর উদ্যোগ সৃষ্টি হবে। সরকার শুধু পরিবেশটা দিক।
কিন্তু পরিবেশটা অন্যভাবেও প্রয়োজন। একটা সহজ স্বাভাবিক পরিবেশ। বছর শেষে মৌলবাদী শক্তির উন্মাদনা আমাদের শঙ্কিত করে। সরকার রাজনৈতিকভাবে সেটা কীভাবে মোকাবিলা করে তা দেখতে চাই। কিন্তু আমরা এমন একটা উদার সমাজ চাই, যেখানে মানুষ আইনের শাসন পাবে, বিচার পাবে। নারী ও শিশু নির্যাতন কমবে। একটা ছেলে বা মেয়ে সহজেই বন্ধু হয়ে উঠবে, নিঃশঙ্কচিত্তে শহরে বা গ্রামে পরস্পরের হাত ধরে হাঁটবে। মানুষ তাদের রুচি বা পছন্দ মতো খাওয়া-দাওয়া করবে, পোশাক পরবে, কথা বলবে, মত প্রকাশ করবে, লিখবে এবং অন্যদের সঙ্গে যুক্ত হবে বা মেলামেশা করবে। এটাই কল্যাণ এবং এই পরিবেশটাই পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে অনন্য করে তুলবে।

নতুন প্রখর হবে অশান্তি ও বিভাজন থেকে বেরিয়ে এসে একাত্তরের চেতনায় নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। বিদায়ী ২০২০ সাল ছিল এক অন্য বছর। যেন অন্যরকম এক সাম্যের দিন। এক অপরিচিত রোগ পৃথিবীব্যাপী নিষ্ঠুর মারণ থাবায় মানুষের অহংকার ধূলিতলে মিশিয়ে ছেড়েছে। কে বড়লোক, কে খুব গরিব, কার কত শৌর্যবীর্য, কার কত সম্পদ বা সম্মান, কিছুই সে পরোয়া করেনি। সবাইকে সমানভাবে আক্রমণ করেছে।
কিন্তু তবু এক অদ্ভুত অবস্থা আমরা দেখেছি। মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষ মরণের অতি নৈকট্যে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ চিকিৎসা খাতে কেউ কেউ জালিয়াতি করেছে, দুর্নীতি করেছে। অন্যান্য খাতও ব্যতিক্রম নয়। এই পরিস্থিতি আমাদের বারবার হতাশ করেছে।
নতুন বছরে এই হতাশা থেকে মুক্তি চাই। রাস্তায় নামলে মানুষের নিরন্তর কাজ করা দেখলে হতাশা কেটে যায়। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সেনা ও পুলিশ সদস্য, প্রশাসনের কর্মীরা দিনরাত মানুষের সেবা করেছেন। এসব আমাদের হতাশা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে তরুণ যুবকদের। তাদের অনেকেই করোনা সুরক্ষা বিধি মেনে দরিদ্র মানুষের দুয়ারে খাবার আর ওষুধ পৌঁছে দিয়েছে। দিন-আনা দিন-খাওয়া হাজারো মানুষ বেঁচে ছিল এদেরই কল্যাণে।    

নতুন বছরটি এলো নতুন প্রখরতার কথা বলতে। আমরা হয়তো শিখবো মানুষ যদি বাঁচতে চায়, তাকে বাঁচতে হবে অপরের জন্য। নিশ্চয়ই নতুন বছরে আমরা একটু বেশি মানুষ হবো, আরও বেশি সংবেদনশীল হবো, অনেক বেশি সহানুভূতিশীল, অনেক বেশি ভালোবাসতে পারবো। করোনা রোগ আর মৌলবাদের রোগ থেকে নিশ্চয়ই বেঁচে উঠবো আমরা।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ