X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১
ট্রাভেলগ

বুদবুদি ছড়ায় অবারিত বিস্ময়

জাকারিয়া মন্ডল
২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:০০আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:০০

গাছপালায় ছাওয়া গুহার মতো গিরিপথ (ছবি: আলাফ আলী) মাথার সিঁথির মতো সরু মেঠোপথ। সবুজের বুক চিরে সাদা ফিতার মতো এগিয়েছে। দু’পাশের ধানক্ষেত দামাল বাতাসে আয়েশ করে দুলছে। সামনে একটা চড়াই। পাহাড়ের রাজ্য শুরু। এই পাহাড় কেটেই রাস্তা। গাছ-গুল্মে ছাওয়া দুই দেয়ালের বেড়ে স্যাঁতস্যাঁতে গিরিপথ।

পায়ের নিচে মাটির সোঁদা গন্ধ। শরত শেষ হলেও দাপট কমেনি বর্ষার। প্রায় প্রতিদিনই মেঘ গলে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। বুনোপথ তাই কাদায় মাখামাখি। একটু অসাবধান হলেই পা হড়কে পপাত ধরণীতল হওয়ার শঙ্কা। তাই পা ফেলতে হচ্ছে মেপে মেপে।

কিন্তু, কী অদ্ভুত! কাদা মেখে পিচ্ছিল হয়ে পড়া পথ বেয়েই কী অনায়াসে ঝুড়ি মাথায় হেঁটে আসছে ওরা। কারও মাথায় লেবু, কারও মাথায় পেয়ারার ঝাঁকা। কেউবা করল্লার ঝাঁপি বইছেন। রোদে পোড়া কর্মঠ শরীর সবার। তবুও প্রখর রোদের তেজে তেতে ওঠা পাহাড়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে ক্লান্ত। দু’জন জিরিয়ে নিতে বসেছে পাতায় ছাওয়া এক তোরণের নিচে। দু’পাশ থেকে ঝুঁকে এসে মাথার ওপর ডালপাতার ছাদ সাজিয়েছে গাছগাছালি। আপন খেয়ালে কী এক অপরূপ তোরণ গড়ে রেখেছে প্রকৃতি।

গভীর বন থেকে বাঁশ কেটে ফিরছেন এক বনজীবী (ছবি: ইমপ্রেসিভ কমিউনিকেশনস) পাহাড়ি এলাকা আরও বন্ধুর হতে শুরু করলো। একবার চড়াই বেয়ে ওঠা তো পরক্ষণেই উতরাই বেয়ে নামা। একের পর এক পাহাড় ডিঙানো। পাহাড়ের ফাঁকে সবুজ উপত্যকা, ফসলের মাঠ, ফলের বাগান।

একখানে মাটির নিচ দিয়ে আপন খেয়ালে পথ করে নিয়েছে একটা ছড়া। আর তার প্রবাহ পথের ওপর তৈরি হয়েছে মাটির সেতু। অপরূপ প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেয়াল!

একের পর এক গিরিখাদ এড়িয়ে, গিরিপথ পেরিয়ে আরও এগিয়ে চলা। বনে বনে পাখির কলতান। নাম না জানা পোকার একটানা আওয়াজ। সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় তুলার মতো মেঘরাশি। এ যেন পাহাড় ঘেরা এক স্বর্গরাজ্য।

এ বনের নাম হাইদগাঁও। পটিয়ার বনাঞ্চলটি কিন্তু প্রাণিবৈচিত্র্যে ভরপুর। ভাগ্য ভালো হলে দেখা দিতো সজারু, বানর, মুখপোড়া হনুমানের দল। দর্শন মিলে যেতে পারে বুনো হাতিরও।

ওই যে, ওই পথটায় বুনো হাতিদের চলাচল। স্থানীয়রা হাতিকে বলে আঁতি। তবে ‘মামা’ বা ‘ম’ বলতেই পছন্দ তাদের। ওই মামাদের সামনে পড়লে কিন্তু ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার শঙ্কাই বেশি। তাই কোনও বনজীবী যদি বলে, ‘ইন্দি ন জাইয়ু, ম আছে’– তাহলে ওই পথ এড়িয়ে চলাই ভালো।

এক বনজীবী জানালেন, হাতির দল এখন রাঙ্গুনিয়ার দিকে আছে। কাজেই আরও এগিয়ে যেতে ভয় নেই।

আর একটু এগিয়ে একটা ছড়ার দেখা পাওয়া গেলো। পাহাড়ের ফাঁকে তিরতিরিয়ে বইছে। দুপুরের প্রখর রোদও ছড়ার পানিকে তাতাতে পারেনি। কী শীতল!

একটু দূরে গাছের ছায়ায় ছড়ার পানিতে কবজি ডুবিয়ে জাবর কাটছে একটা মহিষ। তার পালের আরও দুটো পাড়ের ওপরে। মনমেজাজ বুঝি বড্ড খারাপ। খুব কাছে ঘেঁষার সাহস হলো না।

এবার একপাশে পেয়ারা, একপাশে কচুবন। ঘাসবনে প্রজাপতি, ফড়িংয়ের মেলা। অনেক লজ্জাবতীকে লজ্জায় রাঙিয়ে আরও এগোতে ফের পিচ্ছিল গিরিপথ। তারপর গিরিখাদ। আরও সামনে একটা ছাউনি।

উল্টোদিকে খাড়া পাহাড়ের মাথায় কানু শাহের মাজার। ওখান থেকে পুরো এলাকার প্যানারোমিক ভিউ পাওয়া যায়। ঢেউখেলানো সবুজের চাদর যেন হারিয়ে গেছে দৃষ্টির দিগন্তে।

বিপরীত দিক থেকে দুই নারীকে হেঁটে আসতে দেখা গেলো। একটু আগে আরেক নারীকে পাওয়া গিয়েছিল, যিনি বছর দশ বয়সী মেয়েকে নিয়ে সকাল ৯টায় হাঁটা শুরু করেছেন। রাঙ্গুনিয়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা মা-মেয়ের সঙ্গে আমাদের যখন দেখা হয়, তখন দুপুর দুইটা। তারা বাবার বাড়িতে ফিরছিলেন। মাথায় ছিল সবজি ও নিত্যপণ্যের বোঝা। এই দুই নারীর সঙ্গে যদিও বাক্স-পেটরা কিছু নেই, তবেও তারাও রাঙ্গুনিয়া থেকেই আসছেন।

গাছের সাঁকোতে ছড়া পাড়ি (ছবি: ইমপ্রেসিভ কমিউনিকেশনস) আর একটা সরু গিরিপথ পেরোনোর খানিক পরই আর একটা ছড়া। ছড়ার বুকে গাছের গুঁড়ি, শুকনো ডালপালা। বৃষ্টির তোড়ে এসে আটকে গেছে। পরের বৃষ্টিতে হয়তো এখান থেকে ভেসে আরও ভাটিতে সরে যাবে।

প্রশস্ত ছড়ার শীতল বুকে হেঁটে আরও খানিক এগোতে বুদবুদি ছড়ার দেখা পাওয়া গেলো। দুই ছড়া মিলে ভাটিতে শ্রীমতী খালের দিকে এগিয়েছে।

ডান থেকে আসা বুদবুদি ছড়া পাহাড় ধোয়া পানিতে ঘোলা। পানির নিচে কোথায় গর্ত কে জানে? তাই বিপদ এড়াতে শীতল ছড়ার সঙ্গ ছেড়ে পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়া ঢের ভালো। কিন্তু গভীর বুনোপথ ছেড়ে বারবারই ফিরে আসতে হচ্ছে বুদবুদি ছড়ায়। সবুজে ছাওয়া পাহাড় সারির মাঝে সাদা সরু ফিতার মতো গড়াতে থাকা ছড়া বেয়েই এগোতে হচ্ছে বারবার।

বর্ষায় ধুয়ে দু’পাশের সবুজ বনানী আরও সতেজ। রোদ মেখে যেন হাসছে।

একটু পরপরই বাঁক নিচ্ছে ছড়াটা। আর প্রতি বাঁকবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে দু’পাশের দৃশ্যপট। সৌন্দর্যের বিচিত্র পসরা সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। আপন খেয়ালে যেন তুলির আঁচড়ে এঁকে রেখেছে বন, পাহাড়, আকাশের স্কেচ।

সামনে সবুজ বনের ফাঁকে একটা অদ্ভুত গিরিপথ। মাথার ওপর ডালপাতার ঘন ছাদ সুড়ঙ্গটাকে গুহার আকার দিয়েছে। ভেতরে গা ছমছমে অন্ধকার। নানান প্রজাতির লতাপাতা ঝুলছে। ওপাশ থেকে হঠাৎ উদয় হলো দুই মাছ শিকারি। নানান প্রজাতির কয়েক কেজি মাছ ধরে এনেছে ছড়ার শাখা-প্রশাখা থেকে। পটিয়ার হাটে নিয়ে বিক্রি করবে।

গিরিপথটির খাড়া দেয়ালও মাটির। এ ছড়াতে আমরা এখন পর্যন্ত কোনও পাথর খণ্ড বা বোল্ডার পাইনি। তার মানে, এটি পাথুরে ছড়া নয়। মাটির। এজন্য কাদা বেশি। পানিও ঘোলা। সমতলে এগিয়ে চলা এমন ছড়া কিন্তু বাংলাদেশে খুব বেশি নেই।

ছড়ার বুকে কলাগাছ ফাঁড়ছেন এক বনজীবী (ছবি: আলাফ আলী) সামনে ছড়ার বুকে জেগে থাকা মেটে চরটায় কলার গাছ ফাঁড়ছে মাঝবয়সী একজন। কথা বলার সময়ও হাত থামলো না তার। দক্ষ হাতে কলা গাছ চিরে বের করতে থাকলেন সাদা সাদা থোড়। কাছেই একটা দোকান আছে তার। সেখানে বিস্কুট মিলবে। চা-ও মিলবে। তবে পানি খেতে হবে এই ছড়ারই। ছড়ার বুকে একটা গর্ত করে পানি জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। তার দোকানে বনেই কাঠ কেটে বানানো বেঞ্চি। এই গহীন বনে এটাই একমাত্র দোকান।

সরু গিরিপথে মহিষ পালের ডেরায় ফেরা (ছবি: আলাফ আলী) আর একটু এগোতেই আরও সরু একটা গিরিপথ। মাঝামাঝি আসতেই মহিষ পালের মুখোমুখি আমরা। মাথা তুলে অভিযাত্রীদের মাপছে। পাহাড় কেটে বানানো পথটা এত খাড়া আর সরু যে দু’জন মানুষই পাশাপাশি গলবার জো নেই। তার ওপর মহিষ! অগত্যা ঝুলে থাকা লতা-গুল্ম ধরে খাড়া টিলাটার মাথায় উঠতেই চক্ষু চড়কগাছ! এই গহীন বনেও রড-সিমেন্টের ঢালাই কাঠামো।

ঢালাই করে দেওয়া গ্যাসকূপের মুখ (ছবি: ইমপ্রেসিভ কমিউনিকেশনস) হাজার বছরেরও অধিক সময় ধরে সভ্যতা ছুঁয়ে আছে চাঁদখালী নদীতীরের পটিয়াকে। বর্মী রাজার বৌদ্ধ যুগ, মুঘল সাম্রাজ্যের মুসলিম যুগের বহু কীর্তিকলাপের সাক্ষী এই জনপদ ইংরেজ আমলেও ছিল শিল্প-বাণিজ্যের সমৃদ্ধ কেন্দ্র। একসময় গ্যাসকূপও আবিষ্কৃত হয়েছিল এই এলাকায়। ব্রিটিশরা বিতাড়িত হওয়ার আগে সেই কূপ ঢালাই করে বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রচলিত গল্পে বিশ্বাস রাখলে, এমনই একটা ঢালাই কাঠামো চোখের সামনে। ধ্বংসপ্রায়। কী অদ্ভুত!

পাহাড়ের ওপরে জমে থাকা পানিতে গ্যাসের বুদবুদ (ছবি: ইমপ্রেসিভ কমিউনিকেশনস) এখান থেকে একটু সামনেই পাহাড়ের ওপর জমে থাকা পানিতে গ্যাসের বুদবুদ উঠছে। পাশেই আরেকটি ঢালাই কাঠামো। ধারেকাছের মাটিতে সারি সারি গর্ত। এসব গর্তে দিয়াশালাই ঠুকলেই জ্বলে উঠছে আগুন। বনজীবীরা তাদের রান্নার প্রয়োজনীয় কাজটুকু এই আগুনেই সেরে নেয়। খিচুড়ি রান্না করে পিকনিক পার্টি।

পাহাড়ের মাটিতে দিয়াশালাই ঠুকে আগুন (ছবি: ইমপ্রেসিভ কমিউনিকেশনস) গ্যাস পাহাড়টি বেড় দিয়েই এগিয়েছে ছড়া। এই ছড়ার পানিতে বুদবুদ ওঠে বলেই নাম হয়েছে বুদবুদি ছড়া। বাঁশের চোঙ্গা পানিতে ধরলে দিয়াশালাই ঠুকে জ্বালানো যায় আগুন। দেশের আর কোনও বনে বেড়াতে এসে এভাবে রান্নার সুযোগ নেই। বুদবুদি ছড়া তাই রূপে ও আবেদনে অনন্য। পর্যটকের অপেক্ষায় পটিয়ার গহীন অরণ্যে কুলকুলিয়ে বইছে। এখান থেকে ছড়া পেরিয়ে বুনোপথ পাড়ি দিয়ে বান্দরবান অবধি যাওয়া যায়।

এই পথে হেঁটে যাওয়া যায় বান্দরবান (ছবি: আলাফ আলী) লেখক: ফ্যিল্যান্স সাংবাদিক

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বার্সার বিদায়ে কান্সেলোর অনাগত সন্তানেরও মৃত্যু কামনা করেছেন সমর্থকরা!
বার্সার বিদায়ে কান্সেলোর অনাগত সন্তানেরও মৃত্যু কামনা করেছেন সমর্থকরা!
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি