X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

অথবা আকাশই শুধু থেকে যায়...

পিয়াস মজিদ
২১ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:৪১আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:৪৭

অথবা আকাশই শুধু থেকে যায়... এই সেদিন আবুল হাসনাত ভাই চলে যাওয়ার পর মনজুরে মওলা ফোন করে শোনালেন ‘আকাশই শুধু’ শিরোনামে তাঁর একটা এলিজি; দু’একটি পঙক্তি-ঘরে ঘুরতে ঘুরতে কাটতে চায় না পঙক্তি-ঘোর:

'মানুষ ও নীল এক হয়ে যায়

গাঙচিল ও মানুষ এক হয়ে যায়।

 

থাকে না আকাশ বলে কিছু আর

অথবা আকাশই বুঝি থেকে যায়...'

এমন কত কত কবিতা ভেসে আসতো তাঁর নিরালা আজিমপুরের আবাস থেকে, ইথারে; দেখার স্মৃতি সামান্যই তবু তাঁর সঙ্গে ক্ষণিকের আড্ডাগুচ্ছের রেশ অশেষ-অসামান্য।

বাংলা একাডেমিতে কাজ শুরু করার আগে থেকেই শুনেছি এখানকার এককালীন দাপুটে মহাপরিচালক মনজুরে মওলার নাম; হাসান আজিজুল হকের কাছে শুনেছি, কী করে তাঁর কাছ থেকে 'ভাষাশহীদ গ্রন্থমালা'র জন্য আদায় করেছেন 'সক্রেটিস' বইটি, আনিসুজ্জামানের আত্মকথায় পড়েছি 'পুরনো বাংলা গদ্য' বইটি যথাসময়ে প্রকাশ করতে একাডেমির একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে বইয়ের প্রুফ কপি দিয়ে চট্টগ্রামে, আনিস স্যারের তৎকালীন কর্মস্থলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, শিবনারায়ণ রায়ের লেখায় জেনেছি, আশির দশকের একাডেমিতে ঢুকে মনজুরে মওলা’র কর্ম-উৎসব প্রত্যক্ষণের কথা, প্রতিদিন একটি করে বই প্রকাশের বিস্ময়বার্তা। মনজুরে মওলার কবিতার বই 'সুচিত্রা সেনের জন্য' পড়া ছিল আর 'জনকণ্ঠ'-এ মাঝে-সাঝে পড়া হতো 'একী দুর্দৈব!' নামের রসগম্ভীর কলাম।

তো, এক সকালে বন্ধু প্রকাশক সঞ্জয় মজুমদার বললেন 'মওলা স্যার আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।' আমি বলে উঠলাম 'মনজুরে মওলা! বাপরে বাপ!!' সদা- হাসিখুশি সঞ্জয় অভয় দিয়ে বললেন, 'আরে, আমি তো সঙ্গে থাকব। আর স্যার খুব মজার মানুষ।'

যাহোক, তাহোক করে অবশেষে এক সন্ধ্যায় যাওয়া গেল তাঁর আপন আলয়ে। গিয়ে বুঝলাম গাম্ভীর্য তাঁর অনুল্লেখ্য আবরণ-মাত্র, যদি তাঁর ভেতরকার প্রাণফোয়ারার দেখা পাওয়া যায় তবে মনজুরে মওলার মতো অতুলনীয় বন্ধু কমই হয়। বলাবাহুল্য, সে সন্ধ্যা আড্ডার স্রোতে কমে রাত্রি নামের সমুদ্রে গড়িয়েছিল; এলিয়ট থেকে কিরীটি রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে সুধীন্দ্রনাথ, আবুল হোসেন থেকে শার্লক হোমস পর্যন্ত কত দিকে যে তিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন আমাদের! একটা প্রকল্পে কাজ করার জন্য আমাকে নির্বাচন করেছিলেন, সে কাজটিতে যুক্ত হওয়া হয়নি আমার তবে তাঁর মতো শিল্পসুষমাময় এক মানুষের নৈকট্যে থাকার ইচ্ছেন অমলিন থেকেছে নিরন্তর। রবীন্দ্র-সার্ধশত জন্মবর্ষে বাংলা একাডেমি থেকে 'গ্রহণ করেছো যত' নামে একটা বই প্রকাশ-মুহূর্তে কিছুদূর পড়ার সুযোগ ঘটেছিল; রবীন্দ্রকবিতার রূপতাত্ত্বিক গহন-গভীর আলোচনা ছিল দারুণ মুগ্ধকর। ঠিক সেসময়ই সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'দশমী' কাব্যগ্রন্থ নিয়ে 'নষ্ট নীড়' শিরোনামে তাঁর ধারাবাহিক লেখা বেরুচ্ছিল 'উত্তরাধিকার'-এ, আর আবদুল মান্নান সৈয়দের মৃত্যুর পরপর 'কালি ও কলম'-এ 'পড়েছে কাচের জুতো ঝড়' নামে তাঁর কবিতালোচনা। কবিতা নিয়ে তাঁর অনুধ্যানী অবলোকন আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রচলানুগামী ছিল না মোটেই, তাঁর কবিতাকেন্দ্রিত গদ্য যেন-বা চিত্রকলার তেলজল বা মিশ্রমাধ্যমে রূপান্বিত ইশারা অবিরত। তার স্বাদ নিতে আমাদের অপারঙ্গমতা ছিল বিপুল তবে অপার আগ্রহও ছিল অনেকের। এইতো সেদিন 'ধানশালিকের দেশ'-এ 'দুঃখ-জয়-করা এক রাজপুত্র' নামে তাঁর লেখা রবীন্দ্রনাথের কিশোর-জীবনীর প্রথম-পর্ব পড়ে সনজীদা খাতুন আপা বলছিলেন 'ভারী সুন্দর লিখেছেন মওলা। এমন একটা লেখার কথা আমিও ভেবেছিলাম।'  মনে করি, মনজুরে মওলার রবীন্দ্র-বিষয়ক সব ক'টি বইয়ের সমন্বিত প্রকাশ আশু -কর্তব্য আমাদের। একত্র-পাঠে বোঝা যাবে, তাঁর রবীন্দ্রনিমগ্নতার ধরণ-ধারণ।

শেষ বয়সে টিএস এলিয়ট নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি  অর্জন করেছিলেন তিনি। এই সংবাদটি বিশদ করতে 'প্রথম আলো' থেকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিতে বলা হয়েছিল আমাকে। অনেক কথা বলার শেষে আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে ছাড়লেন, যেন তাঁর জীবদ্দশায় আমার কোনো লেখায় তাঁর 'ডক্টর' হওয়ার তথ্য পরিবেশন না করি। বললেন 'আমি এলিয়ট গবেষক নই, এলিয়টের মুগ্ধ পাঠক।' এলিয়টের জীবনপঞ্জি রচনা করেছেন, এলিয়ট অনুবাদ করেছেন; যেমন অনুবাদ করেছেন ইবসেনের 'ব্র্যান্ড' নাটকও। মজা করে বলতেন, একবার ইবসেন উৎসবে সিএটির প্রযোজনায় অন্য একটি নাটক কোনো এক মফস্বল প্রদর্শিত হওয়ার জন্য নির্বাচন করা হলে, স্থানীয়রা গোঁ ধরল এই বলে 'আমাদের ব্র্যান্ড-ই চাই।' অনুবাদক মনজুরে মওলা হাসতে হাসতে নির্দেশক কামালুদ্দীন নীলুকে বললেন 'অনুবাদক হিসেবে আমাকেও একটু ব্র্যান্ডি দিও।'

কোনো ধরনের বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগ ব্যতীত, 'মূর্ধন্য' প্রকাশনার আন্তরিক উদ্যোগে   রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ১৫১টি বিচিত্র বইয়ের প্রকাশনা তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি 'পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা' এবং 'বাংলাদেশের কবিতা'-র মতো মহার্ঘ্য সংকলন সম্পাদনা করে তিনি তাঁর গবেষণা ও সম্পাদনা-সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছেন। মনে আছে, এই সংকলনগুলোর কাজে কত অপরিচিত, বিস্মৃত কবির বই সংগ্রহ করতে চলে আসতেন বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগারে, কবি সাজজাদ আরেফিন, কাজী জাহিদুল হক বা আমার কাছ থেকে সংগ্রহ-ব্যাকুল ছিলেন ইমামুর রশীদ, মেহেরুননেসার কবিতাবই অথবা আশরাফ সিদ্দিকী-আবদুর রশীদ খানের 'নতুন কবিতা' সংকলন সংগ্রহে।

মনজুরে মওলার সঙ্গে শেষ সুদীর্ঘ আড্ডা অনুজ বন্ধু আসিফ বিন আলী-সহযোগে।  আমার কাছ থেকে তাঁর গল্প শুনে বিদেশে পড়তে যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলার বাসনা প্রকাশ করেছিল। আমরা তিনজনে বয়সের ব্যবধান ভুলে আড্ডার হাতিঘোড়ায় চড়ে কত কোথায় কোথায় ঘুরে এলাম সে সন্ধ্যায়! মার্কিম মুল্লুক থেকে কোটবাড়ির বার্ডে, তলস্তয় থেকে মির্জা আবদুল হাই, বুদ্ধদেব বসু থেকে দেবব্রত বিশ্বাস-কত প্রসঙ্গে-অনুষঙ্গে পরিব্রাজন হতো তাঁর সঙ্গে কথাসূত্রে!

সেদিন এবং আরও অনেকদিন বলেছি, বাংলা একাডেমিতে তাঁর অসাধারণ কৃতি সম্পর্কে বিশদে বলতে। এসব নিয়ে কথা তুলতেই চাইতেন না, বলতেন 'সব তো একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করেছে। মহাপরিচালক হিসেবে আমি তো ম্যানেজার-মাত্র।'

অবাক হয়ে ভাবছিলাম, মাত্র তিন বছর মেয়াদে মহাপরিচালক থাকাকালে যিনি একুশে বইমেলা, একুশে বক্তৃতা, ভাষাশহীদ গ্রন্থমালার ১০১টি ব্যতিক্রমী বই, 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস', 'ছোটদের অভিধান' প্রকাশ, ঐতিহাসিক বর্ধমান ভবন সংস্কার, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি প্রদর্শনী আয়োজন, শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ-স্মারকগ্রন্থের উদ্যোগ নিয়ে একাডেমিকে অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছেন, তিনি যখন বলেন 'আমি কিছু করিনি। সব করেছে একাডেমির কর্মকর্তা -কর্মচারীরা' তখন বুঝি তিনি একালের 'আমি'-বাদী মানুষ নন, সমষ্টিবাদী 'শেষ অভিজাত'-দের গোত্রভুক্ত বিরল গুণীজন।

এই সেদিন আশিতম জন্মবার্ষিকী অতিক্রান্ত হলো তাঁর। আশি পেরিয়ে 'আসি' বলবেন, ভাবিনি কোনোমতে। শারীরিক নানা জটিলতা তো ছিল, শেষে আক্রমণ করল কোভিড-১৯। তবু, যখন ফোন করে পিএ নাজিরের আত্মকথা বা বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেনের 'রবীন্দ্রনাথ ও মোগল সংস্কৃতি'  বইয়ের সন্ধানে ফোন করতেন বা একদা সাড়া-জাগানো 'শ্রাবণ' সাহিত্যপত্র নতুনভাবে প্রকাশের স্বপ্নের কথা বলতেন, তখন তাঁর জরাজয়ী অপরিমেয় জীবনতৃষ্ণার কথা মনে আসতো। তাঁর শুভার্থীদের মধ্যে মাহবুব তালুকদার কিংবা তারিক সুজাতের সঙ্গে ফোনালাপে জেনেছি, শেষ পর্যন্ত কবিতার কথায় ছিলেন তিনি আর অতঃপর কখনও অস্ত না যাওয়া শিল্পের স্বপ্নসূর্যের দিকে বিশে ডিসেম্বর দু'হাজার বিশে দিলেন পাড়ি।

গড় বাঙালির চেয়ে অনেকটা বেশি বয়সে 'নিমগ্ন, কী করে পারো' নামে প্রথম কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর। শোকস্তব্ধ আমার কলম তাঁকে ফিরে ফিরে জিজ্ঞেস করছে আজ—'এত এত সৃষ্টি, এত এত সুন্দরের প্রভা। নিমগ্ন, কী করে পারতেন আপনি?'

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!