X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁকুড়ার মাটির রুক্ষ-লাবণ্য ঢুকে পড়েছে আমার কবিতায় : সুধীর দত্ত

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অরুণাভ রাহারায়
১৮ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:০০আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:০০

বাংলা কবিতার ব্যতিক্রমী স্বর কবি সুধীর দত্তের জন্ম ১৯৫১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়। ১৯৭৯ সালে রাজ্য সিভিল সার্ভিস-এ যোগ। অন্য ধারার পাঠকের স্বীকৃতি ও সমাদর পেয়েছে তাঁর একাধিক বই। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া, আরশি টাওয়ার, প্রাকপুরাণ, দাহপুঁথি, কবিতাসমগ্র। বোধিবৃক্ষতলে দেবতা ও তস্কর। তাঁবু মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছের জন্য আনন্দ পুরস্কার অর্জন। রয়েছে হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি নামে ৮০০ পংক্তির একটি মহাকাব্য। প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ: গদ্যসমগ্র ও প্রভু উবাচ। বাঁকুড়ার মাটির রুক্ষ-লাবণ্য ঢুকে পড়েছে আমার কবিতায় : সুধীর দত্ত

প্রশ্ন : আপনার কবিতার পথ একেবারেই আলাদা। আপনার কবিতাকে স্পর্শ করার জন্য হাঁটতে হয় অনেকটা...

সুধীর দত্ত : আমি পথ বেছে নিয়ে লিখতে আসিনি। ছোটবেলায় কবিতা পড়তাম। কবিতার একটা পরম্পরাজ্ঞান আমার বোধের মধ্যে ছিল। আমার ধারণা এই ঐতিহ্য ও ইতিহাসবোধের মধ্যে দাঁড়িয়েই আমার কবিতা নিজস্ব ভাষামুদ্রা তৈরি করে নেয়। আমার আত্মার স্পন্দনই আমার কবিতা। আমি যে জীবনযাপন করি বা যে ভাবনাবৃত্তে থাকি আমার কবিতাকে তারই উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করি। তাতে যদি আমার কবিতা স্বতন্ত্র হয় তো স্বতন্ত্র, না-হলে নয়!

 

প্রশ্ন : লেখা শুরু করেন ৭০ দশকে। প্রথম বই 'ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া' প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে...

সুধীর : আমি বহুপ্রসূ নই। প্রথম পর্বে যে কবিতাগুলো লিখেছিলাম, তাকে অগ্রজরা মান্যতা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হত, কবিতাগুলো মুদ্রণযোগ্য হলেও, ওগুলো ঠিক গ্রন্থনযোগ্য নয়। সেখানে আবেগের প্রাধান্য ছিল। আর এই প্রবণতা যতক্ষণ না প্রজ্ঞাশাসিত হচ্ছে, ততক্ষণ এর মধ্যে তারল্য থেকেই যাবে। কবিতার ক্ষত্রে আমি চিরকাল তারল্য বিরোধী। পরে আমার মনে হয়েছে, এই অনিয়ন্ত্রিত আবেগকে একটু শাসন করা দরকার। সেই সময়ের অনেক লেখাই রিরাইট করি। তাই আমার 'কবিতা সংগ্রহে' সংকলিত হওয়ার সময় 'ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া' বইয়ের অনেক কবিতাই পাল্টে পাল্টে গিয়েছে।

 

প্রশ্ন : আপনার কবিতা আত্মকেন্দ্রিক…

সুধীর : কবিতা হল কবির আত্মখননের ইতিহাস, আত্মবিকাশের ইতিহাস। খনন যে হচ্ছে, তা তো শুধু ভাটিক্যাল নয়, তা হরাইজেন্টালও বটে। তাই পঞ্চাশের দশকের কবিদের কবিতায় যে আত্মজৈবনিকতা, এটা কিন্তু সেইরকম ‘আমি’ নয়। এই আমিটা সমষ্টি আমি’র দিকে ধাবিত। সেখানে পুরাণ প্রসঙ্গও এসেছে। পুরাণ হচ্ছে একটা সমবেত স্মৃতির উত্তরাধিকার। একটা সাময়িক নির্জ্ঞানের সঙ্গে ব্যক্তি যুক্ত হলেই আত্মজৈবনিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। তখন সেই আমি বিরাট আমি’র অংশ হয়ে ওঠে। এবং আমার কবিতার ধাবনটা সেই দিকেই।

 

প্রশ্ন : বহুদিন বাদে, ১৯৯৪-এ প্রকাশ পায় আপনার দ্বিতীয় বই। এত দেরি?

সুধীর : কবির ভাববিশ্বে বিচিত্র আসে। অভিজ্ঞতার বিস্তার হয়। নতুন মড়কে ধরবার জন্য ভাষা বাঁক নিতে থাকে বিভিন্ন সময়। ‘ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া’র সঙ্গে ‘আরশি টাওয়ার’এর কবিতাগুলোর কোনও মিল নেই। সেটাই তো হওয়া উচিৎ। নদী যেমন আপন খেয়ালে বয়ে চলে, আমার কবিতাজীবনও সেভাবেই নিজস্ব বাঁক খুঁজে নিয়েছে।

 

প্রশ্ন : বাঁকুড়ায় রুক্ষ মাটি মিশে রয়েছে আপনার কবিতায়

সুধীর : আমি দীর্ঘদিন বাঁকুড়ায় বসবাস করেছি। সেখানকার ডেপুটি ম্যাজিস্টেট ছিলাম। বাঁকুড়ার মাটির রুক্ষ-লাবণ্য স্বভাবিকভাবেই ঢুকে পড়েছে আমার কবিতায়। এমনটা আমি রামকিংকর বেইজের ভাস্কর্যে খুঁজে পেয়েছি। তাঁর শিল্পের রুক্ষতার সঙ্গে বাঁকুড়ার মাটির মিল রয়েছে বলে মনে হয়। এমনটা আমার শিল্পের ক্ষেত্রেও হয়েছে। যেহেতু কয়েক বছর ছিলাম তাই আমার কবিতায় মিশে গিয়েছে সেখানকার মাটি।

 

প্রশ্ন : আপনি মনে করেন নিজেকে ভাঙচুর করাই আপনার কাজ

সুধীর : আমি মনে করি কবির কাজ হল সমস্ত প্রথাকে ভেঙে ফেলা। অভ্যেসের অনুবর্তিতা আমার স্বভাব নয়। আরও মনে করি, কবির প্রতিদ্বন্দ্বী বাইরে কেউ নয়, কবি নিজেই। লিখতে লিখতে একটা ঘরানায় আটকে যাওয়ার মানে নেই। তাই নিজেকে ভেঙে ফেলতে চেষ্টা করি আমি। নিজেকে ভেঙে ভেঙে পুনর্নিমাণ করাই আমার কাজ।

 

প্রশ্ন : 'তাঁবু মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ' বইয়ের জন্য আপনি আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। এ বই বহু মানুষের ভালবাসা পেয়েছে...

সুধীর : প্রাপ্তিটা শুধু আমার নয়, আমি মনে করি, এই পুরস্কার সমস্ত সৎ, সাহসী এবং আপসহীন কবিতা সাধকের। আমরা যারা কলরোল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে কবিতাকে পুজো হিসেবে গ্রহণ করেছি— এটা তাঁদেরই জয় বলতে পারো। আমি শুধু প্রতিনিধি হয়ে এই পুরস্কার গ্রহণ করেছি মাত্র।

 

প্রশ্ন : আপনি 'সংবেদ' পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময়টার কথা কিছু বলুন...

সুধীর : কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সংবেদ প্রকাশ করতাম। প্রধান সম্পাদক ছিলেন শরৎ সুনীল নন্দী। সহ-সম্পাদক ছিলাম আমি আর রামচন্দ্র প্রামাণিক। অনেকে সেই কাগজে লিখতেন। 'কবি ও কবিতা' বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গীতা চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত লিখতেন আমাদের কাগজে। সাহিত্যগুণে সংবেদ এতই উচ্চতা ছিল যে, কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন 'আধুনিক বাংলা কবিতার ট্যাক্সট বুক'। প্রথম জীবনে আমার সিংহ ভাগ লেখাই সংবেদে প্রকাশ পায়।

 

প্রশ্ন : এখন তো কবিতা প্রকাশের ক্ষেত্রে ফেসবুক একটা ভূমিকা নেয়। আপনিও মাঝেমধ্যে কবিতা পোস্ট করেন ফেসবুকে

সুধীর : ফেসবুকে সিরিয়াস পাঠক থাকে না। অনেকে আছেন যারা কবিতা বুঝতে চায়। ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করতে আপত্তির তো কিছু নেই! এটা একটা বড় মাধ্যম। ফলে অনেকের কাছে কবিতাটা পৌঁছায়। আমার মতে, এই মাধ্যম তরুণ কবির ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে অনেকে কবিতা পোস্ট করতে অনুরোধ করেন। আমি নিজেও ফেসবুকে কবিতা প্রকাশ করি। কিছুদিন যদি বন্ধ রাখি তাহলে অনেকে আবার মেসেজ করে কবিতা পোস্ট করতে বলেন। এটা আমার ভালোই লাগে। কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, আপনার এই কবিতাটা পড়ার জন্যই আমার ফেসবুকে আসা সার্থক হয়েছে। এমনও পাঠক আছে! ধরো, একটা কবিতা পোস্ট করলাম সেটা একশ জন লাইক করল। তার মধ্যে তিনজন তো ভাল পাঠক আছে। তাই বা কম কী? আমার কবিতার তলায় অনেকে মন্তব্য করেন। কিন্তু সেইসব মতামতের দ্বারা আমি প্রভাবিত হই না কখনও। ফেসবুকের মধ্যমেই আমি অনেক তরুণ কবির লেখা পড়েছি। সেটাও একটা পজেটিভ দিক।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া