X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

অবাক হওয়ার কী আছে?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০২ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৪৩আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৫৬

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আমরা অনেকেই বলি বাংলাদেশ কোন পথে চলবে সেটা নির্ধারিত হয়ে গেছে ১৯৭১ সালেই যখন আমরা লড়াই করে একটি দেশ পেয়েছি। লড়াইয়ের দর্শনটাও পরিষ্কার ছিল–আমরা স্থির করেছিলাম মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানকে হটিয়ে একটি উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কায়েম করবো। ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, ১ কোটি মানুষ পাকিস্তানিদের অত্যাচারের মুখে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং কোটি কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়েছিল।
আমাদের চলা শুরুও হয়েছিল সেভাবে। কিন্তু এ দেশ পথ হারায় খুব অল্প সময়েই। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশকে আবার নিয়ে যাওয়া হয় সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি ধারায়। ১৯৯৬-এর আগ পর্যন্ত একুশ বছর বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সালাফি ইসলাম ঢুকিয়েছে ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতি। ১৯৭১-এ যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল মানুষ, তার মৌলিক চরিত্র নষ্ট করার আয়োজন ছিল সর্বত্র। ১৯৯৬ থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে আনার প্রচেষ্টা আরেক দফা হত্যার শিকার হয় ২০০১-এ। সেবারের নির্বাচনে সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে বিএনপি। সাম্প্রদায়িক শক্তি একুশ বছরে যা করেছে, তার চেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক করার, জঙ্গি করার আয়োজনে নামে তখন।

২০০৮-এর নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধের বিচার করলেও শেখ হাসিনাকে মোকাবিলা করে যেতে হচ্ছে ভয়ংকর জঙ্গি এক শক্তিকে। এরা হলি আর্টিজানের মতো ক্যাফেতে বিদেশিদের হত্যা করে, লেখকদের হত্যা করে। এরা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে রাষ্ট্রকে অন্ধকারের পথে নিয়ে যেতে সক্রিয় হয়। এদেরই একটা প্রকাশ্য অংশ ধর্মপ্রাণ কিন্তু উদার মানুষদের নাস্তিক উপাধি দেয়।

রাজনীতিতে কৌশল থাকে, থাকতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো কৌশলের আশ্রয়ে কি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি কৈফিয়তধর্মী হয়ে পড়ছে? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এতটাই বিভাজিত হয়েছে যে, তারা কোথায় নিজেরা ন্যারেটিভ ঠিক করবে তা নয়, বরং মৌলবাদী ও জঙ্গি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উচ্চারিত কথার প্রতিক্রিয়ার যেন কাউন্টার ন্যারেটিভ বলতে বলতে ক্লান্ত। এতটাই প্রতিক্রিয়াধর্মী যে, তাকে কৈফিয়তের সুরে বলে যেতে হয় সে নিজে কতটা ধর্ম মেনে চলে। তাকে কৈফিয়ত দিতে হয় ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয় বলে।

এখানেই আসল কথা। ধর্মনিরেপক্ষ শক্তি যদি নিজে এজেন্ডা স্থির করে, দৃঢ়তার সঙ্গে, সততা আর নিষ্ঠার সঙ্গে, অঙ্গীকার নিয়ে এজেন্ডা স্থির না করে তবে তাকে শুধু কৈফিয়তই দিয়ে যেতে হবে। শুধু যদি ক্ষমতার রাজনীতি করা হয়, সেটা করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়, যদি আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকে সে তবে তার পক্ষে আর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয় না। তখন সে স্বভাবে পরাশ্রিত হয়। আদর্শের রাজনীতি না করলে তার স্বভাবে আর আচরণে দুর্বলতা আসবেই, কারণ তার আত্মপ্রত্যয় হারিয়ে যায় অনাদর্শের চর্চায়।

এই অবস্থা কখন হয় সেটা টেরও পায় না সে। এই দুর্বল, পরাশ্রিত, প্রতিক্রিয়াজীবী ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই উগ্রবাদী গোষ্ঠী আজ মাঠ গরম করছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক পথেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করবে এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও নির্মম সহিংসতার যে রাজনীতি, তার কাছে কোথায় যেন অসহায় আত্মসমর্পণ।

আজ খুব সহজেই যেন সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করে এক রাজনৈতিক দর্শন সমাজকে গ্রাস করছে। তাই এখন সময় হয়েছে নতুন করে চিন্তা করার। রাষ্ট্রের উন্নয়ন ভাবনাকে উদারনৈতিক সাংস্কৃতিক ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে পথ হারাবার আশঙ্কা আছে। মৌলবাদী রাজনীতির এমন ভয়ংকর উত্থান আধুনিকীকরণ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরাসরি আক্রমণ করে এগিয়ে চলেছে। প্রগতি, স্বাধীনতা এবং বৈজ্ঞানিক মানসিক বিকাশ না হলে শুধু জিডিপি দিয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না।

আমাদের আপামর মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ কখনও ছিল না। এখন তাদের সেই পথে নিয়ে চলেছে এই ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী। এদের নেতারা নিজেরা কতটা সৎ, কতটা সত্যিকারের ধার্মিক সে নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একথা সত্য যে তারা এই ধর্ম-সম্পৃক্ত মানুষকে উসকে দিতে পারছে বারবার। শুধু মুখে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বুলি নয়, উদারনৈতিক রাজনীতির সৎ চর্চা, সমাজের মানুষকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করে আদর্শ ও অনুসরণীয় আচরণবিধিকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে এগিয়ে আসছে প্রতিপক্ষ। একটা প্রকৃত উদার, সর্বজনীন সামাজিক-অর্থনৈতিক রাজনীতি কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে নিতে না পারলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ব্যর্থ হতেই থাকবে। আমরা এক সমাজ নির্মাণ করেছি যা আমাদের নিয়ে চলেছে পুঁজিবাদী বিকাশের পথে। এতে করে বৈষম্য ক্রমশ বাড়ছে, সাংস্কৃতিক জিডিপি কমছে। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দেবে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে? গোটা দেশের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন, ১৯৭১-এ দেখা স্বপ্নের বাংলাদেশ ভাবনাটাকে প্রতিষ্ঠিত করাই বাঁচার একমাত্র পথ।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ