X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কে কাকে ভোট দেয়, কেন দেয়?

আমীন আল রশীদ
২৭ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৫৬আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৫৮

আমীন আল রশীদ মিয়ানমারের রাখাইনে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিষয়ে গত ১৮ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যে প্রস্তাব পাস হয়েছে, তাতে বিপক্ষে ভোট দিয়েছে ৯টি দেশ—যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী চীন। আর ভোটদানে বিরত থেকেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে পরিচিত প্রতিবেশী দেশ ভারত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র জাপানও ভোট দেয়নি।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ পক্ষে ভোট দিয়েছে। ভারতসহ অন্য তিনটি দেশ (নেপাল, ভুটান ও শ্রীলংকা) ভোটদানে বিরত থেকেছে। ফলে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে আসছে, যেমন:
১. রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে কোন কোন দেশ ভোট দিয়েছে এবং কারা ভোটদানে বিরত থেকেছে?

২. ভোটদানে বিরত থাকার ব্যাখ্যা কী?

৩. মিয়ানমার ছাড়া অন্য যে ৮টি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, তাদের স্বার্থ কী?

৪. এই ভোটাভুটির ফলাফল কী?

৫. পৃথিবীর সব দেশও যদি বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারকে চাপ দেয় এবং চীন যদি মিয়ানমারের পক্ষে থাকে, তাহলে সারা বিশ্বের ওই চাপেও সমস্যার কোনও সমাধান হবে কি না?

৬. ভারত কেন ভোটদানে বিরত থাকে?

৭. রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত, চীন ও জাপান পাশে আছে বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও ভোটাভুটিতে এর প্রভাব পড়ে না কেন?

৮. রাশিয়া এই ইস্যুতে বিপক্ষে ভোট দেয়। পক্ষান্তরে পক্ষে ভোট দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের এই বিপরীতমুখী অবস্থান কি সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াইয়ে কোনও প্রভাব ফেলে?

৯. নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কি রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনও ভূমিকা রাখবেন বা এই সমস্যা সমাধানে তার পক্ষে আদৌ কি কিছু করা সম্ভব হবে?

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের পর ওই বছর থেকে নিয়মিতভাবে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) নেতৃত্বে মিয়ানমারের মানবাধিকার সংকট নিয়ে তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাব আনা হচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকে ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যৌথভাবে তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাবটি তুলছে এবং প্রতিবারই বিপুল ভোটে তা গৃহীত হচ্ছে। কিন্তু বরাবরই এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিচ্ছে চীন এবং ভোটদানে বিরত থাকে ভারত। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

এবারও যেসব দেশ এই রেজুলেশনের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে সেগুলো হচ্ছে মিয়ানমার, চীন, রাশিয়া, বেলারুশ, কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও জিম্বাবুয়ে। মিয়ানমারে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকায় তারা বিপক্ষে ভোট দিতে পারে। কিন্তু বাকি সাতটি দেশের স্বার্থ কী?

ভোটদানে বিরত থেকেছে যে ৩১টি রাষ্ট্র তার মধ্যে ভারত ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশ জাপান। জাতিসংঘে যেদিন এই ঘটনা ঘটেছে, তার দুদিন পরেই মিয়ানমারের গণমাধ্যম ‘ইরাবতি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিয়ানমারে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘মিয়ানমারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের (জাপান) প্রতিশ্রুতির কোনও ব্যত্যয় হবে না।’

সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলংকা ভোটদানে বিরত থেকেছে। পক্ষে ভোট দিয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ। তিনটিই মুসলিম প্রধান দেশ। তার মানে কি এই যে, এই ভোটাভুটিতে রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয় একটি বড় নিয়ামক? নাকি ভারত বিপক্ষে ভোট দিয়েছে বলে নেপাল, ভুটান ও শ্রীলংকাও তাদের পথে হেঁটেছে? প্রশ্নটা এ কারণে যে, জাতিসংঘের মতো একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে ভোট দেওয়া, না দেওয়া কিংবা বিরত থাকার বিষয়টি শুধুই সংশ্লিষ্ট দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা সচিবের বিষয় নয়। বরং এটি সেই দেশের পুরো পররাষ্ট্র নীতিরও অংশ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রস্তাব গ্রহণের ইস্যুতে ভারত যে ভোটদানে বিরত থাকলো, অর্থাৎ তারা যে সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিলো না, এটি এককভাবে সে দেশের কোনও একজন ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নয়; এটি ভারতের বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্র নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। ভারতে এ মুহূর্তে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলে তারা কি জাতিসংঘে এই ভোটাভুটিতে সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিতো?

ভোটদানে বিরত থাকা অন্যান্য দেশের মধ্যে রয়েছে থাইল্যান্ড, অ্যান্টিগুয়া বারবুডা, বলিভিয়া, ক্যামেরুন, কঙ্গো, উত্তর কোরিয়া, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, ফিজি, কেনিয়া, লেসেথো, মঙ্গোলিয়া, নামিবিয়া, নাউরু, জাম্বিয়া ইত্যাদি। দক্ষিণ আফ্রিকা পক্ষে ভোট দিলেও আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে বিপক্ষে এবং মধ্য আফ্রিকার অনেক দেশ ভোটদানে বিরত থেকে। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক। দক্ষিণ ও মধ্য আফ্রিকায় চীনের বড় অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আছে। তাছাড়া আফ্রিকার বিরাট অঞ্চল (ভূমি) চীন এরইমধ্যে নগদ টাকায় কিনে ফেলেছে। ফলে তারা এমন কোনও কাজ করে না, যা চীনের সঙ্গে তাদের আদর্শিক দ্বন্দ্ব তৈরি করে। অর্থাৎ চীন যে ইস্যুতে বিপক্ষে ভোট দিলো, সেই ইস্যুতে তাদের পক্ষে ভোট দেওয়া কঠিন। তাই বিপক্ষে ভোট না দিয়ে তারা ভোটদানে বিরত থেকে একরকম নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করে।

কিন্তু চীনের বিপক্ষে ভোট দেওয়া এবং ভারতের ভোটদানে বিরত থাকার কারণ ভিন্ন। মিয়ানমারে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে, অতএব সে বিপক্ষে ভোট দেবে, এটাই স্বাভাবিক। আর রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ভারত সম্ভব হলে বিপক্ষে ভোট দিতো, কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশকে তার ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ বলা হয়, অতএব ভোটদানে বিরত থেকে সে লাঠি না ভেঙে সাপ মারার কৌশল নেয়। এতে করে এই অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ পরাশক্তি চীনের সাথে তার সম্পর্কও মোটামুটি চেক অ্যান্ড ব্যালান্সে রাখা যায়। আবার পলিটিক্যাল ডিপ্লোম্যাসির কারণেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিতে পারে না। কারণ, রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার যে আচরণ করে, ভারতও তার সংখ্যালঘুদের প্রতি মোটামুটি একই আচরণ করে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিপক্ষে কেউ নেই। এটি আসিয়ানের নীতিগত সিদ্ধান্ত। তাছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রোহিঙ্গাদের পরিচিতি যতটা না এথনিক কমিউনিটি হিসেবে, তার চেয়ে বেশি মুসলিম। ফলে, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সমর্থন কেবলই রোহিঙ্গারা মুসলিম বলে।

মূলত চীন, রাশিয়া, জাপান ও ভারত সব সময়ই মিয়ানমারের সাথে ছিল এবং আছে। চীন ও ভারতের অর্থনীতি, রাশিয়ার অস্ত্র ব্যবসা এবং জাপানের ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতা। তাছাড়া অফিসিয়ালি মিয়ানমারের সরকার প্রধান অং সাং সু চি জাপানের জন্য একটি বিরাট ইস্যু। জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা করে সু চি চেয়ার আছে। সুতরাং রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা মিয়ানমারের বিপক্ষে যাবে না—এটিই স্বাভাবিক।

অনেকে মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় এবং জো বাইডেন ডেমোক্র্যাটিক দলের নেতা হওয়ায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন। কিন্তু এটিও বিবেচনায় রাখা দরকার যে, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম চীন। আর এই অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বোঝাপড়া সেটির অন্যতম বড় জায়গা হচ্ছে মিয়ানমার। অর্থাৎ দুই বৃহৎ শক্তির প্লে গ্রাউন্ড হচ্ছে মিয়ানমার। আবার চীনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে ভারতকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছু করবে বলে মনে হয় না। তবে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি মনে করেন যে চীন সত্যিই প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে এবং তাদের প্রতিরোধের জন্য সকল ফ্রন্টেই চেষ্টা চালাতে হবে, সেক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি তিনি কাজে লাগাতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি বিবেচনায় থাকবে সামান্যই।

তাছাড়া চীন ও ভারত যদি মিয়ানমারের ওপরে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে চাপ না দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ কিংবা জাতিসংঘের মতো সংস্থা যতই চিৎকার করুক, মিয়ানমার তাকে পাত্তা দেবে না। কারণ, সে জানে তার সঙ্গে রয়েছে চীন ও রাশিয়া। আর এই ইস্যুতে ভারত তার সঙ্গে না থাকলেও অন্তত বিপক্ষে যে নেই, সেটিও পরিষ্কার। অতএব, কূটনীতির লড়াইটা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে একাই লড়তে হবে। প্রশ্ন হলো, এতদিন ধরে যে লড়াইটা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করছে সেটি সঠিক পথে ছিল কিনা এবং যদি সেখানে কোনও ভুলত্রুটি বা ‘ডিপ্লোম্যাটিক মিসটেক’ থাকে, সেগুলো শুধরে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে কিনা?

লেখক: সাংবাদিক

 
 
/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ