X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘কাটমোল্লা’ নয়, গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ উদারপন্থী, সহনশীল

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৮ নভেম্বর ২০২০, ১৪:২১আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২০, ১৪:২৩

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা কোথাও একটা ছন্দপতন ঘটেছে। কোথাও একটা যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাও ঘটেছে। আমরা আর যোগাযোগ করতে পারছি না, মানুষকে জানাতে পারছি না, আমরা অতি সাধারণ মানুষের কাছে যেতে পারছি না, কিংবা নাগরিক সমাজেও নিজেদের অবস্থান সংহত করতে পারছি না।
কথাগুলো এ কারণে বলা যে ধর্মকে ব্যবহার করে যে উগ্রবাদী গোষ্ঠী দাপট দেখায় তারা সমাজের মূলধারা না হয়েও আজ  সমাজকে পরিচালিত করছে। একজন প্রকৃত ধার্মিক যেকোনও ধর্মের হয়েও সহনশীল হতে পারেন, ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হতে পারেন, শ্রেণি প্রথার বাইরে অবস্থান নিতে পারেন–সে কথা বলার লোক যেন আমরা আর খুঁজেই পাচ্ছি না। আমাদের চারপাশটা এ কারণেই কেমন যেন বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। আমরা যেন মানতেই পারি না যে, একজন মানুষ একই সঙ্গে উদারনৈতিক এবং ধার্মিকও হতে পারে। সেই পরিসরটাই যেন আমরা সংকুচিত করে ফেলেছি।

একটা শ্রেণি নিয়তই আমাদের ধর্মের কথা বলছে। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি, শিল্প, সংগীত, সাহিত্যের কথা বলছে ক’জন? আমাদের হাজার হাজার টিভি শো হয়, সংবাদপত্র আর অনলাইনে অসংখ্য রচনা ছাপা হয়। বিদ্বেষ আর বিভেদের রাজনীতি নিয়ে যত কথা হয়, ক্ষমতার অলিন্দে যত সুবিধাবাদী লোক রাজনীতিকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটে, ততখানি আমরা আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে বলি না। এই মাটির সব ধর্মের লোক যে বহুকাল আগে থেকেই সব ধর্ম বিষয়েই সহনশীল, সেটি বলছি না।

একটা ভুল ধারণা যারা সৃষ্টি করেছে, তারা অতি মাত্রায় পাত্তা পেয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রক ভাবতে শুরু করেছে। কিছু মানুষের ধর্মের নামে অধর্ম চর্চা, অত্যাচারী মনোভাব, কিছু মানুষের কুসংস্কারে আচ্ছন্ন থাকা, প্রগতি বিরোধী কথা বলাই শেষ নয়। পৃথিবীর মানবিক ইতিহাস গড়তে মুসলিমের অবদান আছে, যেমন আছে অন্য ধর্মের মানুষেরও। কিছু আজব প্রাণী এমনভাবে কথা বলছে যেন বাংলাদেশের ইতিহাস মানেই শুধু ৯০ শতাংশ মুসলিমের ইতিহাস, নাগরিক অধিকার মানেই শুধু সেই ৯০ শতাংশের আধিকার। বাকি সব অপ্রাসঙ্গিক, অনুপস্থিত।

এমন মনোভাবের লোক আছে। কিন্তু এই মনোভাবটাই শেষ কথা নয়, এই রেটোরিকটা আমাদের রেটোরিক নয়–এমন কথা ঐক্যবদ্ধভাবে বলার তাগিদ আমরা অনুভব করছি না। ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবে। ধর্মীয় সম্প্রীতিও থাকবে। একে অন্যের ধর্ম চর্চার প্রতি উদার হবো, অংশগ্রহণ করবো। যারা এসব কাজে ধর্মের অবমাননা দেখে তারা কেবলই সংকীর্ণ ধর্মাচার করে। এদের হাত থেকে ধর্মকে বাঁচালে দেশও বাঁচবে।

সত্যিকার ধর্ম-জ্ঞানবর্জিত ব্যক্তিরাই অন্য ধর্মবিদ্বেষী, বর্ণবিদ্বেষী এবং জঙ্গি সমর্থক। তারা আসলে ধর্মের উদারনৈতিক দর্শন সম্পর্কে কোনও কথা শোনেনি, শুনতে নারাজও বটে। এটি যেমন সত্য তেমনি লিবারাল এলিট শ্রেণি আছে, যাদের নীরবতা, স্বার্থপরতা বেলাশেষে এই বিদ্বেষ সংস্কৃতিকেই জিইয়ে রাখতে সহায়তা করছে।

একটা নতুন ভাবনার প্রয়োজন। মৌলবাদ অবশ্যই একটি পশ্চাৎপদ, অবাঞ্ছিত শব্দ। কিন্তু সেটা যা-ই হোক ধর্ম মানেই কিন্তু সংগঠিত মৌলবাদ নয় এবং সেটা ধর্মের মূল কথাও নয়। কিছু ওয়াজ, কিছু হুংকারই ধর্মের একমাত্র অর্থ ও পরিচয় ছিল না, আজও নয়।

ধর্ম আলাদা আলাদাভাবে পালিত হলেও একজন প্রকৃত ধার্মিক সহনশীল হতে পারেন, অন্য ধর্মের মানুষকে আপন করে নেবার কথা বলতে পারেন, ‘যত মত তত পথ’ বলে সমাজের প্রগতির পথে চলতে পারে। আমার কেবলই মনে হয় উদারনৈতিক, মানবতাপন্থী ধর্ম চর্চার কথা। আমি কেবলই ভাবি যে, আমাদের নিজেদের জীবনেও তার দৃষ্টান্ত বেশি করে উপস্থিত করতে না পারলে যে অন্ধকারের জীবরাই সব দখলে নিয়ে নেবে।

আমাদের মিডিয়াতে, আমাদের সমাজে সেই ছবি দরকার, যেখানে পূজা আর ঈদ উৎসবে প্রতিবেশী মুসলমান ও হিন্দু বা খ্রিস্টান পরিবার মহোৎসাহে যোগ দেয়। আর এভাবেই একে অন্যকে জানার, বোঝার সেতু তৈরি হয়। ১৯৭১-এ সৃষ্টি হওয়া সেই সেতু ১৯৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু সেই কর্মযজ্ঞকে আর বাড়তে দেওয়া যায় না।

যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যায়িত করে তা বুড়িগঙ্গায় ফেলতে চায়, যারা পূজায় উপস্থিত হওয়ার জন্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে মেরে ফেলতে চায় তারা বাইরের পৃথিবীকে জানাতে চায় যে বাংলাদেশ আদতে এক ধর্মান্ধ ও চরমপন্থার সজাগ ভূমি। ধর্মের নামে বিদ্বেষ-ব্যবসা, বিদ্বেষের রাজনীতি যারা করছে তাদেরকে জমিন ছেড়ে দিলো যারা তারাও ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়।

ধর্ম মানুষের অস্তিত্ব। এটা এক চরম সত্যি কথা। কিন্তু ধর্মে যে লোভ, হিংসা, ঘৃণা এবং বিদ্বেষের কোনও স্থান নেই, সেটা বোঝা ও বোঝানোর চেষ্টা করা, সমাজকে জানানোটাও ধর্মেরই চর্চা। প্রকৃত ধার্মিক, আর প্রকৃত উদারনৈতিক মানুষ ‘সবারই দায়িত্ব এই একটি জায়গায় এসে করণীয় নিয়ে ভাবা। এই বাংলাদেশে যে উদারনৈতিক ইসলামের চর্চা ছিল তা ‘কাটমোল্লা’দের কারণে অদৃশ্য হতে পারে না। আমাদের জোরের সঙ্গে বলা দরকার যে গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ আসলে উদারনৈতিক।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
বুয়েটে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীদের
বুয়েটে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ