X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে বাঙালির এত আগ্রহ কেন?

আমীন আল রশীদ
০৮ নভেম্বর ২০২০, ১৬:০০আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২০, ১৬:০২

আমীন আল রশীদ গত ৬ নভেম্বর শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম–‘গৌরনদীতে জো বাইডেন সমর্থকদের ভূরিভোজ’। খবরে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন এগিয়ে থেকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকায় বরিশালের গৌরনদীতে আনন্দ ভোজের আয়োজন করেন তার এক সমর্থক। স্থানীয় সুধী ও ব্যবসায়ীসহ প্রায় ২০০ জনকে আপ্যায়িত করান তিনি। প্রশ্ন হলো, সুদূর মার্কিন মুল্লুকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের একটি উপজেলা শহরের একজন ব্যবসায়ী বা একজন সাধারণ নাগরিকের এত আগ্রহ কেন? প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে খোদ মার্কিনিদের আগ্রহই বা কেমন থাকে?
২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সে দেশের সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাসে খুব বেশি বাড়াবাড়ি থাকে না। কারণ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ তথা রাজ্য পদ্ধতির (স্টেস সিস্টেম) কারণে তাদের কাছে গভর্নরের গুরুত্ব বেশি। তাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো এত শক্তিশালী যে, কেন্দ্রীয় সরকারের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপরে তাদের নির্ভর করতে হয় না। ফলে কে প্রেসিডেন্ট হলেন, তা নিয়ে সাধারণ মার্কিনিদের খুব একটা না ভাবলেও চলে। ফলে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, অতীতের নির্বাচনগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এটিকে ‘আনইউজুয়াল’ বা ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সেই সঙ্গে এই নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়ও যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে (যার রেশ এখনও কাটেনি)—তারও কারণ বিশ্লেষণ করা জরুরি। 

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও নির্বাচন খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন, এরকম কয়েকজনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ হয়। সেই আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিপুল আগ্রহের কিছু কারণ চিহ্নিত করা গেছে। যেমন—

১. যুক্তরাষ্ট্রকে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়—যারা বাংলাদেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে নিয়মিত বিবৃতি দেয়, প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলাদেশের সরকার প্রকাশ্যে এসব প্রতিবেদন অস্বীকার করলেও এগুলোকে আমলে নিতে হয় বা গুরুত্ব দিতে হয়। ফলে আমেরিকার রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাংলাদেশের রাজনীতি ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। আগেও রেখেছে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভবিষ্যতেও যে রাখবে, সেটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

২. ট্রাম্পের মতো আপাত ‘অভদ্র’ একজন মানুষকে এবারও ‘শিক্ষিত’ আমেরিকানরা ভোট দেন কিনা; প্রকাশ্যে নানারকম বিতর্কিত কথাবার্তা ও আচরণ করে নিজেকে ‘জোকারে’ পরিণত করা একজন ব্যক্তি পুনরায় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কিনা—তা নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মানুষেরই আগ্রহ ছিল।

৩. ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি অভিবাসনবিরোধী এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে—এরকম একটি ধারণা বাংলাদেশের জনমনে বেশ শক্তভাবে প্রোথিত হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের যেসব মানুষের আত্মীয়-স্বজন ও সুহৃদ আমেরিকায় বসবাস করেন, তাদের কাছে এবারের নির্বাচনটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তাদের মনে ট্রাম্পবিরোধী একটা মনোভাব সক্রিয় ছিল।

৪. যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে অগ্রসর একটি দেশ। সেই সঙ্গে সহনশীল, গণতান্ত্রিক এবং উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহেরও দেশ। ফলে আমেরিকার গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় খোদ প্রেসিডেন্টের যেসব সমালোচনা হয় বা প্রেসিডেন্টকে নিয়ে যেসব ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়—সেটিও বাংলাদেশের মানুষকে সে দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে অধিকতর আগ্রহী করেছে।

৫. ভোট মানেই উৎসব। অন্তত বাংলাদেশে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত ভোটের সঙ্গে এই উৎসব শব্দটি যুক্ত ছিল। কিন্তু এর পরের জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় সেই উৎসব থাকেনি। নির্বাচনে যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের প্রত্যাশা জনমনে থাকে, সেটিও বিলুপ্ত। বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়া এবং বিজয়ী ও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে অবিশ্বাস্য ভোটের ব্যবধানের কারণে পুরো নির্বাচন পদ্ধতির ওপরে জনমনে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রভাবশালী দেশ—যেখানে প্রচুর বাংলাদেশি বসবাস করেন এবং যে দেশের প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের অর্থনীতির অনেক কিছুই নির্ভর করে, সেই পদে কে জয়ী হচ্ছেন—তার প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরির পেছনে বড় ভূমিকা রাখে এই নির্বাচন পদ্ধতি। অর্থাৎ নিজের দেশের ভোটে উৎসব না দেখলেও অন্য একটি দেশের ভোটের উৎসবে সে পরোক্ষভাবে হলেও শামিল হতে চায়। এর মধ্য দিয়ে একটি অবাধ-সুষ্ঠু এবং উৎসবমুখর নির্বাচনের প্রতি মানুষের মনের ভেতরের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়।

৬. অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই দলের মধ্যে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে তুলনামূলকভাবে সহনশীল এবং প্রবাসীবান্ধব বলে মনে করা হয়। সে তুলনায় রিপাবলিকানরা একটু উগ্র জাতীয়তাবাদী ও কট্টর—এরকম একটি ধারণাও বাংলাদেশের মানুষের মনে আছে। যে কারণে বরাবরই রিপাবলিকান জর্জ বুশ বা ট্রাম্পদের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ডেমোক্র্যাটিক ক্লিনটন বা ওবামাদের জনপ্রিয়তা বেশি।

৭. বিদেশনীতির ক্ষেত্রে রিপাবলিকানরা ‘যুদ্ধবাজ’ বলে একটা ধারণা আছে। যদিও গত চার বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প কোথাও যুদ্ধ বাধাননি।  বরং তার অন্যতম বড় শত্রু উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের যে চেষ্টা করেছেন, সেটি আপাতদৃষ্টিতে লোক দেখানো বা স্টান্টবাজি মনে হলেও কিংবা এর পেছনে তার শান্তিতে নোবেল জয়ের একটা আকাঙ্ক্ষা কাজ করলেও এর একটি রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। তবে বাংলাদেশের মানুষ মনে করে, বিশ্বের জন্য রিপাবলিকানদের চেয়ে ডেমোক্র্যাটরা তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ। যে কারণে তারা চায়নি ট্রাম্পের মতো একজন মানুষ পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের অধিক আগ্রহের এটিও একটি বড় কারণ।

৮. বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম বৃহৎ অংশীদার। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের জন্য। তাছাড়া আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দফতরও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। সবকিছু মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় বিশ্বের কেন্দ্র। সুতরাং সেই দেশের প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন—তা নিয়ে ‘রাজনীতি সচেতন বাঙালি’র আগ্রহ যে কিছুটা বেশি থাকবে—তাতে আর সন্দেহ কী!

৯. ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় এবং এখানে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের বিপুল অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার আমেরিকার যে স্বার্থ জড়িত আছে, সেখানে বাংলাদেশকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান স্বার্থের কারণে তারা ভারতকেও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে। সুতরাং আমেরিকায় যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বাংলাদেশের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলে তারা ভারতের সঙ্গে পরামর্শ করবে। ফলে বৈশ্বিক রাজনীতির মেরুকরণে বাংলাদেশ কতটা ভারতপন্থী আর কতটা চীনপন্থী—সেই হিসাব-নিকাশেও যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় ফ্যাক্টর।

১০. মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের একটি আগ্রহের কারণ গণমাধ্যম। নিজের দেশের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রচার করতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিবিসি-সিএনএন-আলজাজিরা-এপি-এএফফির মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগে বাংলাদেশের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো মার্কিন নির্বাচনের খুঁটিনাটি সবই জানতে পারে—যা একদিকে তাদের সংবাদের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, অন্যদিকে সংবাদে বৈচিত্র্যও আনে। অর্থাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে প্রচুর সংখ্যায় সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রচার ও প্রকাশও জনমনে এ নিয়ে আগ্রহ বাড়িয়েছে। অর্থাৎ গণমাধ্যমের বিস্তৃতি এই নির্বাচন নিয়ে জনআগ্রহ তৈরির পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। কে আজ দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেলেন, সেই তথ্যও যখন ফেসবুকের দুনিয়ায় উন্মুক্ত—তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে কে কী ভাবছেন—সেটিও যে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপুল আকারে ছড়িয়ে যাবে, সেটিই স্বাভাবিক। সেলফি দিয়ে মানুষ যেমন নিজেকে প্রকাশ বা এক ধরনের নার্সিসিজমে ভোগে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের মতামত ও অবস্থান তুলে ধরেও সে নিজেকে আপডেটেড বা অগ্রসর হিসেবে প্রমাণ করতে চায়।

১১. অন্যের যেকোনও বিষয়ে বাঙালির আগ্রহ একটু বেশি। নিজে কী করছে, সেটি বিবেচনায় না নিয়ে অনেক সময়ই দেখা যায়, ওই একই কাজ যখন  অন্য কেউ করছে, সেটি নিয়ে মানুষ সমালোচনা করে। কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের অতি আগ্রহ অনেক সময় নীতি-নৈতিকতার সীমাও অতিক্রম করে। যেমন, কারও সঙ্গে পরিচয় হলেই তার বেতন জিজ্ঞেস করা; বিয়ে করছো না কেন; সন্তান কেন হচ্ছে না, সমস্যা কি তোমার না বউয়ের ইত্যাদি অদ্ভুত প্রশ্নও মানুষ অবলীলায় করে। সেই সঙ্গে হুজুগে মাতাও বাঙালির একটি বড় স্বভাব। কোথাও কেউ ধর্মের অবমাননা করেছে শুনেই হাজার হাজার মানুষ সেখানে গিয়ে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং মরদেহ পুড়িয়ে দেয়—এরকম ভয়াবহ ঘটনাও দেশে ঘটেছে। ফলে সব বিষয়ে বাঙালির এই অতি উৎসাহপ্রবণতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাদের অতি আগ্রহের একটি কারণ বলে মনে করা হয়।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ