X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

তর্জমা প্রসঙ্গে

রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
২৪ অক্টোবর ২০২০, ১৮:০২আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২০, ১৪:২৯

তর্জমা প্রসঙ্গে সবই তো তর্জমা, তাই না? সাহিত্যের আঙ্গিনায় মূল টেক্সট্ বা পাঠকৃতি তো পূর্বাপর কোনো পাঠকৃতিরই তর্জমা, তার অস্তিত্ব না থাকলেও। একজন লেখক তো তার যাবতীয় পঠন-পাঠন ও ব্যক্তিক-সামষ্টিক অভিজ্ঞতার ফসল। থাক সে তর্ক! এই অতিমারির মধ্যে তর্জমা প্রসঙ্গে আয়োজিত একটি ওয়েবিনারে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ইংরেজি ও এস্পানিয়োল থেকে বাংলায় তর্জমা করার মধ্যে ফারাক কী কী? সেদিন একই লেখকের পাঠকৃতি তিন হাত ঘুরে ইংরেজি থেকে এবং সরাসরি মূল এস্পানিয়োল থেকে তর্জমা করতে গিয়ে শব্দের ধ্বনি মাধুর্য্যগত ও বিশেষণের প্রসঙ্গ টেনে অল্প কথায় জবাবটা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। প্রশ্নটার সূত্র ধরে এখন অন্য উদাহরণ হাজির করা যাক। তর্জমা করতে গিয়ে উৎস ভাষার উৎস পাঠকৃতি বা টেক্সট্ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তোলাটা জরুরি : কী ধরনের পাঠকৃতি, কী তার সংরূপ বা genre, এর বিন্যাস ও সংহতি বা coherence কেমন, শব্দ-পদ-বাক্য কীভাবে গ্রন্থিভুক্ত হয়েছে, কে লিখেছেন, তার অভিপ্রায়, এর বিষয়গত ও সংস্কৃতিগত দিক, এর নির্বাহণ বা functionality, উৎস ভাষার পাঠকদের কাছে এর প্রতিক্রিয়া বা effect কী রকম ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের উত্তরগুলি পাওয়ার পর উৎস পাঠকৃতির বিশ্লেষণে আমরা মনোযোগ দেবো : মানে এর ভাষাগত বিষয়-আশয়গুলি খুঁটিয়ে দেখব। সাহিত্য মানেই তো ভাষার কারুকাজ। এবং লেখকদের ভাষার ব্যবহার স্বতন্ত্র : শব্দচয়ন, শব্দবিন্যাস, পদক্রম, বাক্যের গঠন ভিন্ন হয়। তার ভাষাই তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। সৈয়দ মুজতবা আলী আর হুমায়ূন আহমেদের ভাষা একেবারেই আলাদা, যদিও দুই জনই সরস, দুই রকম ভাবে। হিস্পানি সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক আর্হেন্তিনার হোর্হে লুইস বোর্হেসের গল্প বা প্রবন্ধের তর্জমা মূল এস্পানিয়োল থেকে করতে গেলে বিশেষভাবে নজর দিতে হয় তাঁর বাক্যের কাঠামোর ওপর। কারণ তাঁর বাক্যগুলিই অসামান্য। অনেকগুলি খণ্ডবাক্য দিয়ে তৈরি দীর্ঘ জটিল বাক্য যা তাঁর রচনারীতির লক্ষণ। গত শতকের চারের দশকে লেখা বোর্হেসের গল্পগুলি তর্জমা করতে গিয়ে বাক্যের দিকে যদি বিশেষ নজর না দিই তাহলে বোর্হেস তর্জমা করা হবে ঠিকই কিন্তু তাতে বোর্হেস কতটুকু থাকবেন তা নিয়ে সংশয় রয়ে যাবে।

তর্জমায় লোপ বা loss-এর কথা হরহামেশাই শোনা যায়। এ তো অনিবার্য। একটি বাক্য বা পঙক্তির সমস্ত গুণাগুণ তো অনেক সময়ই ধরে রাখা সম্ভব হয় না। সমস্ত স্তরে তুল্যতা একটি অসম্ভব প্রকল্প, খুঁত থাকবেই, কিছু একটা বাদ পড়বেই। একটি উৎস সংস্কৃতিতে প্রোথিত উৎস ভাষার পাঠকৃতি যখন একজন সৃষ্টিশীল অনুবাদক পান (যিনি দুটো ভাষা ও এর সংস্কৃতি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন) বা তর্জমা করবেন বলে নির্বাচন করেন তখন তিনি প্রথমে এটি পাঠ করেন। নিবিড় পাঠ বা close reading। একজন অনুবাদক তো পাঠকের সেরা পাঠক। তার ওই পাঠের মধ্য দিয়ে তিনি পাঠকৃতিটির একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করান। এরপর তর্জমা করতে গিয়ে শব্দ, পদ ও বাক্যের স্তরে, মূল লেখকের সুর ও স্বরের সাথে সঙ্গতি রেখে কতগুলি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একাধিক বা অনেকগুলি সম্ভাবনার মধ্যে একটিকে তিনি সচেতনে, অসচেতনে বা প্রায় অসচেতনে বেছে নেন। আর এভাবে উৎস পাঠকৃতির একটি ভিন্ন রূপ দাঁড়িয়ে যায় লক্ষ্য ভাষায়। সাহিত্যের তর্জমায় খেয়াল করতে হয় ওই লক্ষ্য পাঠকৃতিটি সমস্তটা মিলিয়ে সাহিত্য হয়ে উঠল কি-না, পাঠক-সংবেদী হল কি-না। আর কবিতার তর্জমার প্রথম শর্তই বুঝি এই যে তা লক্ষ্য ভাষায় কবিতা হয়ে উঠতে হয়। তর্জমার মধ্য দিয়ে আমরা যে লক্ষ্য পাঠকৃতি পাচ্ছি তা উৎস পাঠকৃতি থেকে সরে যেতে বাধ্য। লোপ যেমন হয় পাশাপাশি বলা যায় পুনঃনির্মাণের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য ভাষায় একটি বিস্তারও ঘটে বৈকি। তর্জমা মানেই জমা খরচের এক টানাপোড়েন-খেলা। আর অনুবাদকের ভূমিকা মধ্যস্থতাকারীর, তাকে দুই কূলের মধ্যে একটা সমঝোতা-সেতু নির্মাণ করতে হয়। তর্জমা শুধুই মূলের প্রতি অবিশ্বস্ততা নয়, একই সাথে তর্জমা মানে সাংস্কৃতিক সংলাপ ও ভাব বিনিময়, নতুন পাঠকৃতির নির্মাণ, বিকল্প ভাষ্যের খোঁজ ও তাকে গ্রহণ করা, নিবিড় পাঠ, উপযুক্ততার অনুশীলন এবং অপরকে চেনা ও জানার মধ্য দিয়ে জরুরি এক শিক্ষণ। অপরের ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা করার নামও তর্জমা।

অন্য ভাষা থেকে বাংলায় তর্জমা করতে গেলে যে-সমস্যাগুলি হয় তার মধ্যে একটি হল ক্রিয়াপদ। ক্রিয়াপদের তর্জমায় আমাদেরকে প্রায়ই উৎস ভাষার একটির জায়গায় বাংলায় দুইটি শব্দ ব্যবহার করতে হয়। এতে অসুবিধা বাঁধে, বিশেষ করে কবিতায়। বলা হয় কবিতায় শব্দ হল এর আত্মার দেহ। একটির বদলে দুইটি শব্দ বসাতে গিয়ে দেখা যায় ছন্দ-মিল-সুর-স্বরের তাল কেটে যাচ্ছে। ভাষা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সঙ্গীত, কবিতার দেহ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে কবিতা। বাংলায় অসংখ্য অসামান্য তর্জমা কবিতা যে রয়েছে সে কথা কিন্তু আমি মাথায় রেখেই সমস্যাটা তুলে ধরলাম। আরও একটি সমস্যা যা চোখে পড়ে তা হল সংস্কৃতির ভ্রান্ত পাঠ বা ওই জ্ঞান না থাকা। এতে করে অনেক সময়ই আমরা পাঠকৃতির ভেতরে জায়গায় জায়গায় গুলিয়ে ফেলি। আর যদি কোনো সংস্কৃতি-নির্দিষ্ট শব্দ বা শব্দবন্ধের জুতসই বাংলা না পাওয়া বা এমন কিছু পাওয়া গেল যা দেশিকরণের নামান্তর তাহলে বরং উৎস ভাষার শব্দটা মূল উচ্চারণ অনুসারে বাংলায় বানান করে রেখে দেয়াটাই উত্তম। তর্জমা তো শুধু ভাষাগত ব্যাপার নয়, ভাষাতিরিক্ত নানা হেতুও আমলে আনতে হয় তর্জমাপ্রক্রিয়ায় : যেমন সংস্কৃতি, ইতিহাস, সামাজিক-রাজনীতিক প্রসঙ্গ, মতাদর্শ। সবগুলি হেতু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলে পাঠকৃতিটি ধরতে এবং বিশ্লেষণ করতে সুবিধা হয় একজন অনুবাদকের।

তর্জমায় নির্বাচন বা choice বলে একটা ব্যাপার আছে। আমরা কোন লেখককুলদেরকে তর্জমা করছি বা কোন লেখকের কোন রচনা তর্জমা করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম এবং কেন নিলাম­−এইসব প্রশ্ন নিজেদেরকে করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে গত শতকের পাঁচ ও ছয়ের দশকে তর্জমাসাহিত্যে অনেক স্বনামধন্য লেখক-কবিদের উল্লেখযোগ্য কাজের নজির রয়েছে। ইদানিং সেই চল কিছুটা কমেছে যদিও বিস্তর তর্জমা হচ্ছে। কোনো জরিপ না চালিয়েই বলা যায় যে বহুলচর্চিত লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের তর্জমা অনুবাদক এবং প্রকাশক উভয়ের কাছেই আকর্ষণীয়। কিন্তু এত বড় দুনিয়ায় কত কত দেশ বা অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ কত রচনা রয়ে গেছে যা আদৌ বাংলায় তর্জমা হয়নি বা ততটা হয়নি। সোয়াহিলি, আফ্রিকানস্, চীনা, জাপানি, কোরিয়ো, ফার্সি, হিন্দি, আরবি, উর্দু, জার্মান, তুর্কি, ফরাসি ইত্যাদি নানান ভাষায় রচিত সাহিত্যের তর্জমা কাজে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যতই এগিয়ে আসবে ততই মঙ্গল। মনিরুদ্দিন ইউসুফের করা ছয় খণ্ডে প্রকাশিত ফেরদৌসির শাহনামা-র মতোন একটি অসামান্য তর্জমাকাজ উপহার দেবে সামনের প্রজন্মের কেউ−এরকম আশা করাটা কি ভুল? আর শুধু সাহিত্য কেন, দরকার হয়ে পড়েছে জ্ঞানরাজ্যের আরও নানান বিষয় বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, দর্শন ও অন্যান্য বিদ্যার আকরগ্রন্থগুলির তর্জমা।

তর্জমা একটি জটিল কর্মযজ্ঞ। শ্রমসাধ্য তো বটেই। অর্থগত, ভাবগত, সংস্কৃতিগতভাবে একটি শব্দ বা বাক্যের জুতসই বাংলা খুঁজতেই তো দিনের পর দিন চলে যায় অনেক সময়। উৎস ভাষা থেকে লক্ষ্য ভাষায় অনুবাদ করে দিলাম−ব্যাপারটা তো নিছক তা-ই নয়! আমরা যেন ভুলে না যাই যে একজন অনুবাদক দায়িত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করেন, বিশেষ করে গোলকায়নের এই দুনিয়ায়। সময় এসেছে তর্জমাকে মূল পাঠকৃতির সমান মর্যাদা দেয়ার, অনুবাদককে গৌণ না ভেবে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে দেখবার। আমরা চাইব অনুবাদক আরও বেশি করে দৃশ্যমান হোক। তর্জমা হল পুনর্লিখন। তর্জমার গোটা ব্যাপারটাকে লক্ষ্য সংস্কৃতির সংশ্রয় থেকে দেখতে পারলে আমরা উপকৃতই হব। জ্ঞানের সৃজন এবং সংস্কৃতির রূপদানের বলীয়ান কাজে সৃষ্টিশীল লেখকদের পাশাপাশি অনুবাদকদের অবদানকে অস্বীকার করলে আমরা পিছিয়ে থাকব।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি