X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

কে ইয়াবাখোর?

হারুন উর রশীদ
১০ নভেম্বর ২০১৯, ২২:১৩আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৯, ২৩:০০

হারুন উর রশীদ প্রশ্নটি না করে পারলাম না। কারণ, আমরা জানি অতিরিক্ত অ্যালকহল বা মাদকের প্রভাবে মাদকাসক্তরা অনেক সময় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। গভীর রাতে সদর রাস্তার বিদ্যুতের খাম্বা মাথা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে ফেলার কাহিনিও শোনা যায়। আবার রাজা-উজির মেরে পুলিশের হাতে পড়ে শ্রীঘরে যাওয়ার ঘটনাও আছে অনেক।
মাদক ‘ইয়াবা’র প্রভাবে কেমন আচরণ হয়, সেটা আমার জানা ছিল না। কিন্তু এবার জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার কথা শুনে তা আর বুঝতে বাকি নেই। এর প্রভাব যে ভয়াবহ ও মারাত্মক, তা আগে চিকিৎসকদের কাছে শুনেছি। এবার হাতে-হাতে তার প্রমাণ পেলাম। তাই বলছি, এখন হয়তো তার সুচিকিৎসা বা রিহেবিলাইটেশন দরকার।
মশিউর রহমান রাঙ্গা এক বাণী ছেড়েছেন রবিবার (১০ নভেম্বর ২০১৯)। তিনি জাতীয় পার্টি আয়োজিত ‘গণতন্ত্র দিবসে’-এর আলোচনা সভার বলেছেন, ‘নূর হোসেন কে? একটা অ্যাডিকটেড ছেলে। একটা ইয়াবাখোর, ফেনসিডিলখোর।’

কিন্তু আমরা জানি নূর হোসেন একজন শহীদ। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে বুকে ও পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে জীবন্ত পোস্টার হয়েছিলেন তিনি। আর তিনি ছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী মিছিলের পুরোভাগে। জিরো পয়েন্টেই এরশাদের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ নূর হোসেনকে ওইদিন গুলি চালিয়ে হত্যা করে। দিনটি সেই থেকে ‘শহীদ নূর হোসেন দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তখন নূর হোসেনসহ অনেকের আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়, নতুন মাত্রা পায়।  আর তারই পথ ধরে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়।

এরশাদ এখন পরলোকে। কিন্তু ১৯৯০ সালে পতনের পর তিনি ও তার জাতীয় পার্টির অনেক নেতা কারাগারে গিয়েছিলেন। তবে ‘গণতন্ত্রের তোড়ে’ পরে এরশাদসহ সবাই ছাড়া পান। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ক্ষমতার অংশীদার হন। তার দলের নেতারা মন্ত্রী হয়ে ‘গৃহপালিত বিরোধী দলে’ পরিণত হন। আর এখন তো তারা সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট বিরোধী দল। তারাই যেন এখন গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কান্ডারি। একেই বলে রাজনীতি! নূর হোসেনের রক্তের সঙ্গে বেইমানি ‘পতিত’ এরশাদকে ‘উত্থিত’ করেছে। আর সেই দলের মহাসচিব রাঙ্গা শহীদ নূর হোসেনকে ‘ইয়াবাখোর’ অভিহিত করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।

তাই আমার প্রশ্ন—কে ইয়াবাখোর? কার মাথায় ইয়াবার প্রভাব দেখা দিয়েছে? ইয়াবার প্রভাবেই হয়তো তার দল ‘শহীদ নূর হোসেন দিবস’কে ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালন শুরু করছে। ভুলে গেছে ইতিহাস।

গণতন্ত্র হত্যা করার দায়ে যাদের কারাগারে থাকার কথা ছিল, যাদের বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় নেওয়ার কথা ছিল, যাদের প্রতি দেশের মানুষের অবিরাম ঘৃণা থাকার কথা ছিল, তারা যদি মুক্ত থাকেন, তারা যদি গণতন্ত্রের কথা বলেন, তারা যদি ক্ষমতার অংশীদার হন, তারা যদি বিরোধী দল হন; তাহলে তার তো একটা প্রভাব থাকবেই। সেই প্রভাবে বেসামাল হওয়াই স্বাভাবিক। সেই প্রভাব ইয়াবার প্রভাবের চেয়ে কোনও অংশে কম হওয়ার কথা নয়। আমার ধারণা তা-ই হয়েছে। আর এই ‘ইয়াবা’র প্রভাবে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে এখন বেসামাল বলেই মনে হচ্ছে।

বেসামাল হবেনই বা না কেন? কেউ যদি ট্রাক স্ট্যান্ডের চাঁদাবাজ থেকে মন্ত্রী হতে পারেন, তাও আবার স্বৈরাচারের তকমা লাগানো দল থেকে। শুধু তা-ই নয়, এখন আবার সেই দলের প্রধান কুতুবদের তিনি একজন। তাহলে অবস্থাটা বুঝুন! ফলে পুরোটাই বেসামাল অবস্থা। এখানে তো ইয়াবাও ফেল!

নূর হোসেনকে ‘ইয়াবাখোর’ বলে রাঙ্গা সাহেব আসলে আরেকটি সত্য প্রকাশ করেছেন। আর সেই সত্য হলো, রাজনীতিতে এখন ইয়াবার চর্চা প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে। তা-ই যদি না হবে, তাহলে জাতীয় পার্টি বা রাঙ্গা সাহেবরা টিকতে পারতেন না। ফলে একটু আধটু ইয়াবা দোষে হয়তো তিনি শেষ পর্যন্ত শহীদ নূর হোসেনকেও ‘ ইয়াবাখোর’ বলে ফেলেছেন!

আরেকটি কথা—১৯৮৭ সালে যখন নূর হোসেন শহীদ হন, তখন দেশে মাদক হিসেবে ইয়াবার ব্যবহার ছিল কিনা, আমার জানা নেই। তবে, এটা জানা আছে যে, এ দেশে ইয়াবার ব্যবহার শুরু হয় উঁচুতলার মাধ্যমে। তাই যারা ব্যবহার করতেন, তারা তো জানবেনই। রাঙ্গার হয়তো সে কারণেই ইয়াবা নিয়ে এত জানাশোনা।

সব শেয়ালেরই কিন্তু একই রা। জাপা সভাপতি ও এরশাদের ভাই জিএম কাদের তাই ওই একই অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘নূর হোসেন ও ডাক্তার মিলন হত্যার ইস্যু তুলে দেশের মানুষকে বারবার বিভ্রান্ত করা হয়। আমাদের নেতা এরশাদকে অপবাদ দেওয়া হয়।’ আমার মনে হচ্ছে—ইয়াবার প্রভাবে আমরা এরপর হয়তো শুনতে পাবো, ‘নূর হোসেন, মিলন নিজেরাই নিজেদের গুলি করেছেন। তারা আত্মহত্যা করেছেন। তাদের শহীদ বলা যাবে না। এরশাদ মরণোত্তর ‘জাতীয় গণতন্ত্র বীর’। তিনিই দেশে গণতন্ত্র রোপণ করেছেন!

শহীদ নূর হোসেন কোনও নেতা ছিলেন না। ছিলেন একজন ড্রাইভার। পরিবহনকর্মী। তিনি নেতা হতেও মিছিলে যাননি। মিছিলে গিয়েছেন প্রাণের তাগিদে গণতন্ত্রের জন্য। দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য তিনি জীবন দিয়েছেন। এভাবেই যুগে যুগে জীবন দিয়েছেন গণতন্ত্রপ্রেমী দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ। তারা আসক্ত ছিলেন সত্য। তারা ছিলেন গণতন্ত্রে আসক্ত, দেশপ্রেমে আসক্ত।

আর এই নেতা, যারা এখন ‘গণতন্ত্র দিবস’ পালন করেন, তারাও আসক্ত। কীসে আসক্ত? হতে পারেন ইয়াবা আসক্ত। তাদের মাথায় ইয়াবা। চিন্তায় ইয়াবা। কথায় ইয়াবা। তারা রাজনীতির ইয়াবা। তাই অন্যকে ইয়াবা আসক্ত বলতে তাদের মুখে বাধে না।

লেখক: সাংবাদিক

ই-মেইল:  [email protected]

 

/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ