X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর উত্তরাধিকার

মাসুদা ভাট্টি
১৭ মার্চ ২০১৯, ১৪:৪০আপডেট : ১৭ মার্চ ২০১৯, ১৪:৪৩

মাসুদা ভাট্টি ভারত ভেঙে পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই এই ভূখণ্ডে মানুষটি ক্রমাগত জনগণকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, অধিকার আদায়ের পথ দেখিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করে হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে বাঙালিকে মুক্ত করেছেন। তিনি আর কেউ নন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বলা হয়ে থাকে, বঙ্গবন্ধু কার্যত পাকিস্তান চালিয়েছেন আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্ত হওয়ার পর থেকে। এবং বাঙালি দেখেছে তর্জনী উঁচিয়ে বাঙালিকে যে নির্দেশই তিনি দিয়েছেন, আপামর বাঙালি সেই নির্দেশ মেনে নিয়েছেন, জীবন বাজি রেখে পালন করার চেষ্টা করেছেন। যারা করেনি, তারা ইতিহাস থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বিস্মৃতিতে– এই বিস্মৃতির তালিকাও দীর্ঘই, কিন্তু আজকের এই দিনে তাদের স্মরণ করার কোনও কারণ নেই।
বঙ্গবন্ধু জীবনভর কত ভাষণ দিয়েছেন, কত বৈঠক করেছেন, কত জগৎখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন– যতগুলো ছবিতে তাকে আলোচনারত দেখা যায় তার বেশিরভাগেই আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু তার তর্জনী হয় উঁচিয়ে রেখেছেন, না হয় আঙুলটিও যেন কিছু একটা বলছে। এটা আমার একান্তই নিজস্ব চোখে দেখা বঙ্গবন্ধু কিনা তা নিয়ে আমি অনেককেই প্রশ্ন করেছি। প্রায় প্রত্যেকেই বলেছেন, তাদের দৃষ্টিও পড়েছে বঙ্গবন্ধুর ওই আঙুলটির প্রতি। যেন ওই তর্জনী তাকেও কিছু একটা বলছে, কিছু একটা নির্দেশনা দিচ্ছে। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর এই যে অঙ্গুলি-নির্দেশ, এটা যে কত বড় একটি ‘সিম্বল’, সেটা প্রকট হয়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের পর থেকে। কিংবা ১৯৭০ সালের নির্বাচনি প্রচারণা থেকেই। বাঙালিকে ভোট দিতে বলছেন তিনি– বাঙালি ভোট দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছেন। বাঙালিকে তিনি বলেছেন রাজপথে নেমে আসতে– বাঙালি রাজপথে নেমে এসেছেন। বাঙালিকে কলকারখানা বন্ধ করে দিতে বলেছেন– তারা কলকারখানা, অফিস-আদালত বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের ব্যারাক থেকে বের হতে বলেছেন, বাঙালি ব্যারাক ছেড়েছেন। বাঙালি সাংবাদিককে নির্দেশ দিয়েছেন যেভাবে, যে ভাষায় লিখতে, সাংবাদিকরা তাই-ই করেছেন। সবাই যেন ওই একটি আঙুলের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন সব সময়, ওই আঙুল উঁচিয়ে দৃঢ়স্বরে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে কী নির্দেশনা দেন তার অপেক্ষায় থেকেছেন বাঙালি এবং সেসব পালন করাকেই সে সময়কার মূল বিচার্য মনে করেছেন।

বিশ্বের দেশে দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে যারা প্রণম্য হয়েছেন, হয়েছেন স্বাধীনতা শব্দটির প্রতীক, তাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু নিজস্বতা ছিল, যা দিয়ে তাদের চেনা যায়। যেমন, ব্রিটেনের চার্চিলের পাইপ, লেনিন ও চে গুয়েভারার মাথার টুপি, গান্ধীজির লাঠি বা চরকা, লিঙ্কন ও ফিদেল কাস্ত্রোর দাড়ি; বঙ্গবন্ধুকে যদি কেউ গ্রাফিতিতে পরিচয় করিয়ে দিতে চান তাহলে যে ছবিটি চোখের সামনে ভেসে উঠবে তা হলো রেসকোর্স ময়দান বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আঙুল উঁচানো ছবিটি– এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।

আমার প্রায়ই একটি কথা মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর এই তর্জনীটি আসলে কে কে স্পর্শের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন? বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলায় তার বাবা-মা এই আঙুলটি ছুঁয়েছেন বারবার। তারপর বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ছুঁয়েছেন। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে যে ছবিটি সবচেয়ে গভীর রেখাপাত করে তা হলো, বঙ্গবন্ধু বিছানায় শুয়ে আছেন আর তার আদরের বড় কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নখ কেটে দিচ্ছেন। শিশুকালে শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর এই আঙুল ধরে হাঁটতে শিখেছেন। বড় পুত্র হিসেবে শেখ কামাল, তারপর শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং শিশু রাসেল, প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুর এই আঙুল স্পর্শের সুযোগ পেয়েছেন। পঁচাত্তরের ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর এই আঙুল স্পর্শের দাবিদার বেশিরভাগ আপনজনকেই হত্যা করেছে নৃশংসভাবে। আজ আমাদের মাঝে কেবল সেই দুই উত্তরাধিকারীই জীবিত আছেন, যারা বঙ্গবন্ধুর অমল আঙুলটি ছোঁয়ার দাবিদার। নিশ্চিতভাবেই হয়তো শিশু সজীব ওয়াজেদ জয়ও বঙ্গবন্ধুর আঙুল ছুঁয়েছেন। আজকে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এসব কথা লেখার একটিই উদ্দেশ্য– তা হলো, বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর উত্তরাধিকার এই বাংলাদেশে এখনও বর্তমান এবং তারাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন একটি উজ্জ্বল আগামীর দিকে।

লক্ষণীয় যে, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রেই যেটা সম্ভব হয়নি, যে নেতা দেশের স্বাধীনতা এনেছেন তার লিগেসি বা উত্তরাধিকারীরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেশের হাল ধরলেও তাদের নতুন কোনও সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সেই স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়নি। উপমহাদেশে জওহরলাল নেহরুর কন্যা প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী যে ভারতকে তথা ভারতীয় রাজনীতির উত্তরাধিকারিত্ব করেছেন তা মূলত নেহরুর রেখে যাওয়া গণতান্ত্রিক লিগেসি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে যে রাজনীতির সূচনা হয়েছে তা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক ছিল না, এমনকি স্বাভাবিক রাজনীতির পরিবেশও এদেশে বজায় ছিল না। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন আর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে। এ যুদ্ধ যে ভয়ঙ্কর ও দুঃসাধ্য একটি যুদ্ধ ছিল সে কথা আজ হয়তো কেউ স্বীকার করবেন না, কিন্তু তাতে ইতিহাস বদলাবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ আর স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতিকে উন্মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধুর দুই জীবিত উত্তরসূরির আত্মত্যাগকে অস্বীকার করে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর উত্তরাধিকার নিয়ে আলোচনাটি মুখ্য হয়ে ওঠে, প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে উদযাপনের ক্ষেত্রে।

আমরা জানি যে, বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশ থেকে আজকে যে বাংলাদেশে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি তা নানা মাত্রায় ও বহুক্ষেত্রেই ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন মানচিত্র উপহার দিয়ে মাত্র তিন বছরের মধ্যে তাকে বিশ্বের সামনে একটি বিকাশমান অর্থনীতির, রাজনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত করাতে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরে সে পরিচয় উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেছিল। বাংলাদেশ পরিচিত হয়ে উঠছিলো দারিদ্র্য, খরা, বন্যা আর সামরিক ক্যু’র মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের দেশ হিসেবে। এমনকি সামরিক দখলদারিত্বের কবলে থাকা রাষ্ট্রে সরকারি খরচে রাজনৈতিক দল গঠন করে তাকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে হাস্যকর চেষ্টা এ দেশে হয়েছে এবং তাতে এ দেশেরই একদল শিক্ষিত মানুষ অংশ নিয়ে কেবল নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে, দেশ ও দশের উন্নয়নকে ‘সেকেন্ডারি’ কর্মসূচি হিসেবে আড়ালে রেখেছে, তাতে কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের রাজনীতিরই। আজকের বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক দৈন্য ও একটি পক্ষের হাহাকার ‘গণতন্ত্রহীনতা’ বলে প্রচার বলে লক্ষমান, তার জন্য আর কিছু নয়, এই সামরিক-রাজনীতিকে ‘গণতান্ত্রিক’ তকমা দেওয়ার অপচেষ্টার ফল। আমরা এর থেকে বেরুতে গিয়ে নতুন কোনও বিপদে পড়তে যাচ্ছি কিনা সে বিষয়ে অন্য কোনও সময়ে আলোচনা করা যাবে, কিন্তু আজকে আমাদের এই চেতনা সামান্য হলেও স্বস্তি দেয় যে, বাংলাদেশের চালকের আসনে এখন বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর উত্তরাধিকারীরাই রয়েছেন।

তার চেয়েও বড় আনন্দ ও গর্বের কথা হলো, বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর নির্দেশনা যেমন জাতিকে একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পথে ধাবিত করেছিল, তেমনই আজকে একটি সর্বত স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার জন্য সেই তর্জনীর উত্তরাধিকার বাঙালি মানসকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। চারদিকে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে তাতে বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, ৭ই মার্চ ১৯৭১ যে আঙুল রেসকোর্সের ময়দানে বাঙালিকে নিবেদিত করেছিল প্রাণোৎসর্গে, আজকে তারই উত্তরাধিকার শেখ হাসিনার তর্জনীটিও বাঙালিকে একীভূত করেছে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সকলকে একযোগে অংশগ্রহণে। মানব সভ্যতার ইতিহাস ত্রুটি-বিচ্যুতিহীন নয়, তেমনই নয় বাঙালির ইতিহাসও, কেবল বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর নির্দেশনা বাস্তবিক অর্থেই ত্রুটিহীন, বিচ্যুতিহীন। আজকে জাতির পিতার জন্মদিনে আমাদের এটাই বিশাল প্রাপ্তি যে, আমরা এখনও তাঁর তর্জনীর উত্তরাধিকারের অংশ হয়েই আছি। বঙ্গবন্ধু সশরীরে নেই সত্য, কিন্তু তাঁর তর্জনীর উত্তরাধিকারীরা আছেন, যারা সেই আঙুল ছুঁয়েছেন এবং সেই আঙুল ধরেই বাংলাদেশকে চিনতে শিখেছেন। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আঙুল চিনেছিল এবং এখনও সেই তর্জনীর ছায়াতেই আছে।

লেখক: দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ