X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বড় জয় বড় শত্রুপক্ষ বড় দায়িত্ব

মাসুদা ভাট্টি
২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:৫৯আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ২০:৩৯

মাসুদা ভাট্টি ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা অব্যাহত থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে দেশে ও বিদেশে যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে থেকে আলোচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে গত দুই মেয়াদে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছেন যে, সর্বত্রই বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আশাবাদ জাগ্রত হয়েছে। যে আশাবাদ কেবল দেশের শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী-বিরোধী পক্ষটি কখনোই নিজেদের ভেতর টের পাচ্ছেন না। আর টের না পাওয়াতেই নির্বাচনে যোগ দিয়েও সর্বাত্মকভাবে নির্বাচনি প্রচার তথা নির্বাচনের মাঠ আঁকড়ে থাকার যে শক্ত প্রয়াস, তা তাদের মধ্যে লক্ষ করা যায়নি। যার ফলে নির্বাচনটি একটি শক্তিশালী পক্ষের সঙ্গে একেবারেই ‘দুধভাত-টাইপ’ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ের মধ্যে শেষ হওয়ার কারণে ফল যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে। নির্বাচন সর্বোতভাবে সুষ্ঠু হয়েছে এরকম দাবি কেউ করছেন না, কিন্তু নির্বাচনি ফলাফল নিয়ে যারা সন্দিহান তারা এখন পর্যন্ত কেন নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে গিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি- এ প্রশ্ন তোলাটা অবান্তর হবে না। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীরা যখন প্রতিপক্ষ, যখন তাদের ছেলেমেয়েরাও বিচারালয়ে গেলে স্বয়ং বিচারককে সমীহ করে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তখন তারা এখনও কেন নির্বাচন নিয়ে আদালতের দ্বারস্থও হতে পারলেন না– তা হয়তো ভবিষ্যৎই আমাদের জানাবে। তবে আজকের লেখার বিষয়বস্তু সেটা নয়, আজকে নতুন সরকারের সামনের দিনগুলো নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

শুরুতেই বলেছি যে, নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে কিন্তু নতুন সরকারকে কেউ অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন সরকার এরই মধ্যে তাদের অবস্থান তৈরি করে নিয়ে কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছে। যদিও একথা খুবই সত্য যে, আগামী পাঁচ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনার সরকারকে দেশে-বিদেশে নিন্দুকদের সমালোচনার টার্গেট হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কিছু আসবে যাবে না। সাধারণ মানুষ তাদের জীবনমানের উন্নয়নসহ বাংলাদেশকে যে উচ্চতায় দেখতে চায়, সেই স্বপ্নকে এসব সমালোচনা অতীতেও যেমন স্পর্শ করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। তার মানে একথাও সত্য যে, নতুন সরকারের কাছে জনগণের চাওয়া যেমন সীমাহীন, তেমনই নতুন সরকারকে সব ক্ষেত্রেই কঠিন সমালোচনার চালুনির ভেতর দিয়ে যেতে হবে। সরকারকে হয়তো কেউ কেউ বা কোনও কোনও পক্ষ দুর্বল ভেবে চাপ প্রয়োগ করে অন্যায্য দাবি আদায় করে নিতে চাইবে। যেমন, আমরা বিগত আমলে দেখেছি কোটা সংস্কার আন্দোলন কিংবা হেফাজতে ইসলামের দাবির কাছে সরকারকে নতিস্বীকার করতে হয়েছে। তেমনই আসছে সময়েও সরকারের ওপর বিভিন্ন সেক্টর ও পক্ষের চাপ অব্যাহত থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু তার চেয়েও বেশি যে বিষয়টি নতুন সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে তা হলো দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনার জীবননাশের চেষ্টা অতীতেও বহুবার হয়েছে, অনেক বিশ্লেষকই এ কথা মনে করেন যে, এই অপচেষ্টা এবার আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হবে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দেশের ভেতর জঙ্গি দমনে বিগত সরকার যে সফলতার নজির রেখেছে তা আজ বিশ্বস্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু তাই বলে রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ সমূলে বিনষ্ট হয়েছে বলে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনও কারণ নেই। ধারণা করতে পারি যে, নতুন সরকারকে অতিষ্ঠ করতে ও দেশকে দুর্বল করে দেওয়ার লক্ষ্যে জঙ্গিবাদ নতুন মাত্রায় ফিরে আসতে পারে। কারণ, আর কোনোভাবে যখন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে থামানো যাবে না তখন শত্রুপক্ষ জঙ্গিবাদকেই তাদের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়ে থাকে বলে অতীতে প্রমাণ পাওয়া গেছে। দ্বিতীয়ত, নাশকতা সৃষ্টি কেবল যে জঙ্গিবাদ-উদ্ভূত তাও নয়, রাজনৈতিক সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার ঘটনা এই দেশে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ চলাকালে, যাতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল সরকার পতন। কোনোভাবেই যখন শেখ হাসিনার সরকারকে হটানো যাচ্ছে না তখন নাশকতার পথকেই বেছে নেওয়ার ২০১৩ সালে শুরু হওয়া পন্থার ধারাবাহিকতা এবারও বজায় থাকবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি কিসে? এর অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এই অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য, প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ থেকে এখন উঠতির দিকে। এত দীর্ঘ সময় ধরে কোনও দেশের এরকম উন্নতি সচরাচর দেখা যায় না। চীনের মতো দেশেও এ বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়েছে। তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। ব্রেক্সিট সংক্রান্ত ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ধাক্কা বাংলাদেশেও পড়বে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির প্রভাবও বাংলাদেশকে ছাড়বে না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির চলমান হার বজায় রাখাটা সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। ফলে অর্থনীতির ওপর আঘাত পড়ে এমন কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে সবচেয়ে বেশি। কারণ, শত্রুপক্ষ নিশ্চিত জানে যে, অর্থনীতির চাকা বন্ধ করা গেলে সরকারকে দুর্বল করে দেওয়া সহজ হবে। সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই রফতানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ ঘটানো হয়েছে। যদিও সরকার কোনোভাবে বিষয়টি সামাল দিয়েছে কিন্তু এখানে যে সরকারকে দুর্বল করার চাবিকাঠি রয়েছে তা শত্রুপক্ষ ভালো করেই জানে। আর জানে বলেই বারবার এই সেক্টরকে উসকানি ও রাস্তায় নামিয়ে দেশ অচল করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। একই সঙ্গে পরিবহন সেক্টরকে এই অসন্তোষের সঙ্গে যুক্ত করা গেলে তো কথাই নেই। সুতরাং, সরকারের সবচেয়ে সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া উচিত এসব অসন্তোষ যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকটি নিশ্চিত করতে।

বড় বিজয় বড় দায়িত্ব নিয়ে আসে। এই দায়িত্ব আর কারো প্রতি নয়, ভোটারদের প্রতি। কারণ, তারাই ভোট দিয়ে এই বিজয় দিয়েছে। এ দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ জ্ঞাত। আর জ্ঞাত বলেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে শুরু করে দেশের উন্নয়নযাত্রায় আওয়ামী লীগ একক নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়েছে। দেশের স্বার্থে কারো সঙ্গে আপস নয়–এই মন্ত্রে নতুন করে সরকারকে দীক্ষিত হওয়ার কিছু নেই, বরং শেখ হাসিনা নিজেই বারবার সেটি প্রমাণ করেছেন। প্রশ্ন হলো, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার এই দেশপ্রেম ও দেশের প্রতি প্রখর দায়িত্ববোধকে বুঝতে পারে কিনা বা ‘ওউন’ করে কিনা? গত আমল থেকেই লক্ষ করা গেছে যে, দলের ভেতর বিভিন্ন দল এমনকি জামায়াতে ইসলামী থেকেও এসে শক্ত জায়গা করে নিয়েছে এবং তারাই অনেক জায়গায় দল, দেশ ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। আওয়ামী লীগের যতটুকু বদনাম বা জনগণের কাছে যতটুকুই অগ্রহণযোগ্যতা, তার সবটাই দলের ভেতরকার দুষ্কৃতিকারী ও অন্য দল থেকে আসা বহিরাগতদের সমন্বয়ে ঘটা কর্মকাণ্ডের কারণে। এই আমলে এসব দৃঢ় ও শক্তহাতে দমন করতে হবে। মন্ত্রিসভার নতুন মুখ অচিরেই যেন পুরনো ও স্বার্থান্বেষী হয়ে না ওঠে সে জন্য দলের নেতৃস্থানীয়দের ভূমিকা থাকা জরুরি। আত্মসমালোচনা কিংবা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে দলের ভেতরেই যদি সমালোচক শ্রেণি তৈরি হয় তাহলে সে দলের সফলতাকে ঠেকানো অসম্ভব। আওয়ামী লীগ এই মেয়াদে দলের ভেতরেই একটি বিশাল সমালোচকগোষ্ঠী তৈরি করবে এবং তাদের সমালোচনাকে আমলে নেবে। দলীয় ও দেশের স্বার্থে সেটাই জরুরি।

ধরে নিচ্ছি দেশের ও বিদেশের নামকরা গণমাধ্যমে প্রতি সপ্তাহেই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ-বিরোধী একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হবে, সংবাদ-বিশ্লেষণ থাকবে। এসব আমলে নিতে হবে এবং সমালোচনার জবাবে নিন্দা নয়, বরং সমালোচনার জবাবে আরও কাজ, আরও উন্নয়ন, আরও জনগণের কাছে যাওয়ার উদ্দীপনা হিসেবে দেখতে হবে। বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিকভাবে আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য একটি দেশ। সেই দেশের রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের সমালোচনা হবে, নিন্দা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। যেহেতু এ দেশে সরকার-বিরোধিতার নামে দেশ-বিরোধীরা রাজনীতির নামে ষড়যন্ত্র করবে, সেহেতু দেশে ও বিদেশে যারা সরকারের কাজের সমালোচনা করবে তাদের আমলে নিলে ও অবিলম্বে সেসব সমালোচনার জবাব কাজের মাধ্যমে দেওয়া গেলে শেষ পর্যন্ত দল, সরকার ও দেশেরই লাভ হবে। দেশ আর মানুষের লাভই তো একটি দেশপ্রেমিক সরকারের মুখ্য চিন্তা হওয়ার কথা– এই সরকার সেটাকেই মূল কাজ ধরে নিয়ে এগিয়ে যাবে, এটাই কামনা। শুধু এটাই মনে রাখতে হবে, কোনও রকম ভুলভ্রান্তির সুযোগ আর নেই সরকারের সামনে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল কর্মদক্ষতা দিয়েই মানুষের সমর্থন ধরে রাখতে হবে। বড় বিজয়ের বড় দায় হচ্ছে নিরন্তর মানুষের সমর্থনকে ধরে রাখা।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ