X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

পারিবারিক নির্যাতন: একটি তিক্ত-মধুর দুষ্টচক্র

জেসমিন চৌধুরী
০৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৯:০৫আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৯:১১

জেসমিন চৌধুরী ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বা পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা যতটা হয় ঘটনাভিত্তিক আলোচনা ততটা হয় না। এর কারণ হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতকের কৌশল ব্যবহারের ফলে নির্যাতিত নিজের কাছেই স্বীকার করতে পারে না যে সে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অথবা বুঝতে পারলেও সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে, লজ্জায়, অক্ষমতায় নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে চক্রটি চলতেই থাকে, নির্যাতিত মানুষটিও নিষ্পেষিত হতে থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।  
আপনিও পারিবারিক নির্যাতনের এই তিক্তমধুর চক্রের শিকার হচ্ছেন কিনা তা কী করে বুঝবেন? আপনার সঙ্গীটি যদি নির্যাতক হয়ে থাকে তাহলে সে আপনার জীবনের ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করবে, আপনাকে চেনাজানা জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা করবে, প্রতিটি বিষয়ে তার নিজের নিয়মকানুন আপনার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে, নানানভাবে আপনাকে ছোট করার চেষ্টা করবে, কথায় কথায় আপনাকে হুমকি দেবে। আবার এসবের ফাঁকে ফাঁকে শারীরিক ও মানসিক ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে আপনার প্রতি ভালোবাসাও প্রকাশ করবে। ঘরের কাজে বা বাচ্চাদের দেখাশোনায় সহায়তা করার মাধ্যমে আপনার মনজয় করার চেষ্টা করবে। মাঝেমধ্যে আপনার প্রশংসা করবে, উপহার দেবে, কালেভদ্রে হয়তো আপনার হাত-পাও টিপে দিতে পারে। আমার পরিচিত এক নির্যাতিত নারীর স্বামী প্রতিবার নির্যাতনের ঘটনার পর আদর করে স্ত্রীর পায়ের নখ কেটে দিতো।      

নির্যাতনের ঘটনার পর সে নিজেই কাঁদবে, ক্ষমা চাইবে, আপনাকে ছাড়া তার জীবন কতটা অর্থহীন তার জানান দেবে। আপনি তাকে ছেড়ে যেতে চাইলে সে আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দেবে। অন্তহীন কষ্ট, উপেক্ষা, অবহেলা আর অপমান সইতে সইতে শেষ পর্যন্ত যদি আপনি যথেষ্ট সাহস আর শক্তি সঞ্চয় করেও ফেলেন, তবু তাকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া আপনার জন্য সহজ হবে না। তার মিষ্টি ব্যবহারের বিরল মুহূর্তগুলোর কথা আপনার মনে পড়ে যাবে,অথবা আপনার আত্মীয়-বন্ধুরাই আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে সে আসলে মানুষ হিসেবে ততটা খারাপ নয়। আপনি তাদের কথা বিশ্বাস করবেন কারণ প্রতিকারের চেয়ে সমঝোতাই আপনার কাছে সহজতর বলে মনে হবে। আপনি আপনার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলবেন, তাকে ছেড়ে গিয়ে থাকলেও আপনি আবার ফিরে আসবেন। আপনার জীবনের তিক্ত-মধুর নির্যাতন-চক্র চলতে থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা পারিবারিক নির্যাতনের এই চক্রকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন– সম্পর্কের ভেতর চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি, নির্যাতনের ঘটনা, মধুচন্দ্রিমা অথবা মিটমাট পর্ব, প্রশান্তিকাল। 

প্রথম পর্বে দু’জনের মধ্যে কিছু একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে একটা চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। সামান্য কারণে অথবা কোনও কারণ ছাড়াই নির্যাতক সঙ্গীটি রেগে যায়। পরস্পরের মধ্যে মানসিক যোগাযোগ ভেঙে পড়ে, এতে নির্যাতিত সঙ্গীটির ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় এবং তার কোনও অপরাধ না হয়ে থাকলেও শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সে আত্মসমর্পণ করার প্রয়োজন বোধ করে। সে খুব নার্ভাস হয়ে যায়, প্রচণ্ড ভীতি তাকে গ্রাস করে ফেলে, স্বাভাবিক জীবন এবং কাজ ব্যাহত হতে থাকে।  

দ্বিতীয় পর্যায়টিই সবচেয়ে মর্মান্তিক যখন নির্যাতনের মূল ঘটনাটি ঘটে। পারিবারিক নির্যাতনের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হচ্ছে শারীরিক বা যৌন নির্যাতন,কিন্তু শারীরিক হিংস্রতা ছাড়াও নির্যাতন আরও বিভিন্ন ধরনের হতে পারে– আবেগ, মানসিক অথবা শুধুই নিয়ন্ত্রণ এবং শক্তির প্রদর্শন ও ব্যবহার। পরিবারের ভেতরের একটা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখাও একধরনের নির্যাতন। এধরনের পরিবেশে পরিবারের সদস্যরা সারাক্ষণই অস্থিরতা এবং অস্বস্তিতে ভোগে।  

একটি নির্যাতন-নির্ভর সম্পর্কের মধ্যে যে অংশটুকুকে সাধারণত ইতিবাচক বলে ধরে নেওয়া হয়, সেই মিটমাট বা মধুচন্দ্রিমা পর্যায়কে বিশেষজ্ঞরা নির্যাতনের দুষ্টচক্রেরই একটি অংশ বলে মনে করেন। তৃতীয় পর্যায়ে মিটমাট করার উদ্দেশ্যে নির্যাতক নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়, প্রতিশ্রুতি দেয় যে এরকম আর কখনও হবে না। মিটমাট করার সময় কোনও এক ফাঁকে সে দাবি করে যে দোষটা আসলে নির্যাতনের শিকার মানুষটিরই, সে-ই নিজের কোনও আচরণ দিয়ে তাকে (নির্যাতক) প্ররোচিত করেছে। দীর্ঘদিনের নির্যাতনে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া মানুষটির কাছে এই সময় সবকিছুই গ্রহণযোগ্য মনে হয়, অন্তত তাৎক্ষণিকভাবে। সে নিজেকেই অপরাধী ভেবে মিটমাট করার জন্য নির্যাতকের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে।  

তারপর আসে চতুর্থ পর্যায় যখন বেশ কিছুদিন নির্যাতনের মাত্রা খুব কম থাকে অথবা কোনও নির্যাতনই ঘটে না। নির্যাতক এমনভাবে আচরণ করে যে তাদের মধ্যে কখনোই কোনও সমস্যা ছিল না, সে কখনোই কোনও অন্যায় করেনি। হয়তো মধুচন্দ্রিমা পর্যায়ে প্রতিশ্রুত কোনও উপহারও সে তার শিকারকে কিনে দেয়। এই পর্যায়ে নির্যাতিত সঙ্গীটি বিশ্বাস করতে চায় যে আসলেই সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। তার এই আশা দুরাশাই থেকে যায়, আবার কিছুদিনের মধ্যেই নির্যাতনের চাকা ঘুরে ঘুরে প্রথম পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়- আবার সম্পর্কের মধ্যে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।  

একজন নির্যাতক সঙ্গীকে ছেড়ে যাওয়া সহজ নয়, কিন্তু বিশ্বাস করুন যদি আপনি যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে তাকে ছেড়ে যেতে পারেন এবং যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেন তাহলে প্রথমে আপনি তাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে শিখবেন, তারপর একসময় আপনি তাকে ছাড়া সুখী হতেও শিখবেন।

আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত এই উপলব্ধি ইদানিং পারিবারিক নির্যাতনের কিছু থেরাপি সেশনে দোভাষী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে আরও গভীর এবং দৃঢ় হয়েছে। নিজের মনের মতো একটা জীবনে বাঁচার জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে নিজের ওপর আস্থা রাখতে শেখা, নিজের ভেতরের শক্তিকে অনুধাবন করতে পারা, নিজের মর্যাদাকে মরীচিকাসম কপট সাংসারিক সুখের ওপরে স্থান দেওয়া। শুধুমাত্র তাহলেই আপনি নির্যাতনের চক্রটিকে ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবেন।    

লেখক: অভিবাসী শিক্ষক ও অনুবাদক

 

/এসএএস/টিএন/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
ঝালকাঠিতে নিহত ১৪ জনের পরিবার পাচ্ছে ৫ লাখ টাকা করে
ঝালকাঠিতে নিহত ১৪ জনের পরিবার পাচ্ছে ৫ লাখ টাকা করে
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ‘আসমানে যাইও নারে বন্ধু’ গানের স্রষ্টা
সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ‘আসমানে যাইও নারে বন্ধু’ গানের স্রষ্টা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ