X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভালোবাসাহীন শহরেও সবাই ভালো বাসা খোঁজে

শেগুফতা শারমিন
০৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:১৭আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:২০

শেগুফতা শারমিন কমন অভিযোগ, ঢাকায় আকাশ দেখা যায় না। আজকে থেকে নয়, গত প্রায় ৩০ বছর যাবৎ এই অভিযোগ চলছেই। সবার অভিযোগ, সবার হাপিত্যেশ। কিন্তু আকাশটাকে একটু দৃশ্যমান হওয়ার সুযোগ দেওয়ার দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নাই। বরং ৩০ বছরে শহর বেড়েছে অনেক দৈর্ঘ্য, প্রস্থে এবং উচ্চতায়। বিশ বছর আগেও মোহাম্মদপুরের পেছনে যে এলাকা ছিল বিস্তীর্ণ জলাভূমি, কচুরিপানার আবাস। তা এখন বিশাল জনবসতি। হাজারে হাজারে বাড়িঘর, শপিংমল, চিপা গলি। সে সময় যে উত্তরা ছিল নিরিবিলি নীরব মধ্যবিত্তের গন্ধওয়ালা আবাসিক এলাকা। সে উত্তরা এখন ভেঙেচুড়ে ঊর্ধ্বমুখী। গলিতে গলিতে জ্যাম। মালিবাগ মগবাজারের কথা আর কিই বা বলি।  দেখেই বোঝা যায়, একটা সময় মানুষ যেখানে যেভাবে জমি পেয়েছে, বাড়ি করে ফেলেছে। রাস্তা নাই, ড্রেন নাই। অপরিকল্পনার চূড়ান্ত। ইদানীং ফ্লাইওভারের নামে হয়েছে দোতলা গলিপথ। নিচে গলি, উপরে গলি। নিচে ‘গিট্টু’ উপরে জ্যাম। পরিষ্কার বোঝা যায়, নানারকম দফতর থাকার পরও, ঢাকা শহরের জন্য কোনও পরিকল্পনা কাজে লাগেনা। অপরিকল্পনার সর্বোচ্চ উদাহরণ হতে পারে প্রিয় ঢাকা। অপরিকল্পনার সবচেয়ে বড় সূচক হতে পারে, ভবনের ক্রমবর্ধমানতা।

ভবন শুধু ঢাকায় নয়, বাড়ছে জেলা শহর, উপজেলা এমনকি একেবারে মেটে গ্রামে। গ্রামে গেলে দেখা যায় চারিদিকে টিনের বাড়ি। ইটের বাড়িও সংখ্যাও বাড়ন্ত। গ্রামের দিনমজুরও এখন পয়সা জমিয়ে টিনের ঘর তোলে। মজার ব্যাপার হলো, মাস কয়েক আগে গ্রামে গেছি। এক মহিলা আসছে দেখা করতে এবং কিছু সাহায্য চাইতে। সাধারণত বাচ্চার লেখাপড়া, স্বামীর ভ্যান মেরামত, পরিবারের কারও অসুস্থতা এসব খুব সাধারণ কারণ থাকে সাহায্য চাওয়ার পেছনে। কিন্তু অবাক করে দিয়ে সেই মহিলা আব্দার করলো, টিনের ঘর তুলতে হবে, সাহায্য দেন। তার মানে টিনের ঘর বা বাড়ি এখন মানুষের চাহিদার এমন স্তরে গেছে যে, সেটাও সাহায্য চাওয়ার কারণে দাঁড়িয়ে গেছে!

ঢাকা শহরের কোনও প্রাণকেন্দ্র নাই, খোলা মাঠ নাই। এসবই পুরনো প্যাঁচাল। যেভাবে শহর বেড়ে গেছে এখন আর এইসব অবকাঠামো তৈরি করাও প্রায় অসম্ভব কল্পনা। কিন্তু জেলা শহরগুলোতো পরিকল্পিত হতেই পারতো। ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোতে গেলে এখন প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসে। একই অবস্থা। শহর বাড়ছে দ্রুত। দৈর্ঘ্য, প্রস্থে এবং উচ্চতায়। পুকুর ভরছে, গাছ কাটছে, নদী মারছে। সব হচ্ছে শুধু বাড়ি বানাতে। যত্রতত্র বাড়ি উঠছে। বড় বড় বাড়ি। অদ্ভুদভাবে খেয়াল করি, বাঙালির এই বাড়ি প্রেম। শুধু তাই না, বড় বাড়ি প্রেম। নিজে নিজে এদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলাতে যাই। সম্ভবত একসময় রাজা জমিদারদের বাড়ি ছিল বড়। নির্যাতিত প্রজাদের ছিল কুঁড়েঘর। প্রজারা নিজের সঙ্গে জমিদারদের, ক্ষমতাবানদের তফাৎ দৃশ্যমানভাবে দেখতো বাড়িতে। সেই সেখান থেকে মানুষের মগজে জায়গা করে নিয়েছে যে বাড়ি তার সক্ষমতার প্রতীক। তাই একটু সামর্থ্য হলেই মানুষ বাড়ি বানায়। বাড়ি বানাক, ভালো কথা। একই সঙ্গে মাথায় ঢুকে আছে বড় বাড়ির ধারণা। যে সময় এই উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল। তখন অবিভক্ত ভারত ভূমিতে জমি ছিল অনেক। ব্রিটিশরা তাই বড় বড় বিল্ডিং বানাতো। সরকারি বাবুরা থাকতো বড় বড় ভবনে। মহকুমা শহরগুলোর ডিসি এসপির বাসভবন, ঢাকা শহরে উপাচার্য ভবন তার কিছু উদাহরণ। কিন্তু দেশ ভাগের পরে আমাদের দেশটা হয়ে গেছে ছোট্ট। মানুষ বেড়েছে কয়েকগুন। কিন্তু বড় বাড়ি বানানোর শখ থেকে আমরা বের হতে পারিনি।

যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে অণু পরিবার বাড়ছে। শরিকের বাড়ি ছেড়ে নিজস্ব ফ্ল্যাটে উঠছে মানুষ। কিন্তু ফ্ল্যাটের আয়তন চাইছে বড়। সব মিলিয়ে টেনেটুনে ৪ জনের পরিবার, ফ্ল্যাট চাই কমপক্ষে ২০০০ স্কয়ার ফিট। দেশের মোট আয়তন যেখানে মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইল! বাড়ি বড় হবে কিন্তু তার আবার যথেষ্ট ব্যবহার হবে না। অথচ বিদেশের সাধারণ আয়ের মানুষের বাসাগুলো খুব অল্প আয়তনের। হিসেব করে তৈরি। একটি জায়গাও অপরিকল্পিত না, অব্যবহৃত না।  সারাজীবন জাপানিরা বাস করে গেলো ছোট ছোট কাঠের ঘরে। স্পেস ম্যানেজমেন্টে জাপানিদের মতো দক্ষতা খুব কম মানুষের আছে। জাপানে প্রতি কিলোমিটারে বাস করে ৩৫০ জন সেখানে বাংলাদেশে ১২৫০ জনের বেশি। তারপরেও জাপানিদের বাড়ি বা বাসা আমাদের চেয়ে অনেক ছোট।   ছোট বাসায় থেকেও জীবনের মান বিচারে বাংলাদেশিদের তুলনায় তারা কোটিগুণ এগিয়ে। 

বেশিরভাগ উন্নত দেশগুলোতেই  দেখি, বাসা ছোট। বাসা শুধু রাতে ঘুমানোর জায়গা। আর জীবন যাপনের সব উপকরণ বাইরে। বাসার বাইরে বাগান থাকে। এলাকায় খেলার মাঠ থাকে। সুন্দর পার্ক থাকে। ভালো গ্রোসারি থাকে। স্থানীয় হাসপাতাল থাকে। বাচ্চাদের  ডে কেয়ার থাকে। কমিউনিটির ভেতরেই স্কুল থাকে, লাইব্রেরি থাকে, লন্ড্রি স্পেস থাকে। হাঁটা দূরত্বে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থাকে। নিরিবিলি একটা আবাসিক এলাকার পরিবেশ থাকে। এলাকায় ঢুকলেই একটা হোমলি পরিবেশ থাকে। নিরাপত্তা থাকে। আর আমাদের ঢাকা এবং আশেপাশের শহরগুলোতে শুধু বিল্ডিং থাকে। একটা গায়ে আরেকটা ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফুটপাত থেকে সোজা সিঁড়ি উঠে যায়, কোনও বাগান নাই। সবুজ নাই। এর মাঝেই আবাসিক ঠিকানায় তৈরি হয় শপিং মল! ফ্লাট বাসাতে স্কুল! উন্মুক্ত ড্রেনের পাশে রেস্টুরেন্ট, এক ফ্ল্যাটে মানুষ থাকে তো পাশের ফ্ল্যাট হাসপাতালের আইসিইউ! নিচতলায় মার্কেট, ওপর তলায় বাসা। বাসার পাশের প্লটে কমিউনিটি সেন্টার রাতভর উচ্চ আওয়াজে হিন্দি গান। গেট খুলে বের হলে টেম্পু আর বাসের হাকডাক। ফুটপাতে ফেরিওয়ালার ভীড়। নীরবতা এখানে দুষ্প্রাপ্য। নিরাপত্তা এখানে নৈবচ।

শহর এগিয়ে যায় মানহীনতার চরম উদাহরণ হয়ে। যে শহরে জীবন যাপন হয়ে ওঠে এক ক্লান্তিকর দীর্ঘ যাত্রা । সে পঁচা শহরে আমরা কেবল বড় বাসা খুঁজি। ভালো বাসা খুঁজি। অথবা আমাদের বড় বাসার নেশা, ভালো বাসার নেশা প্রতিনিয়ত শহরকে বানিয়ে চলে এক কংক্রিটের জঙ্গল, যেখানে আকাশ নেই আকাশে। যেখানে একদিন আকাশের নীল হয়ে মিশে থাকার কথা ছিল আকাশে আকাশে। শিশুর গালের মতো লাল রঙের রোদ নেমে আসার কথা ছিল এখানে ওখানে। সেখানে এখন কেবল পেঁচা আর ইঁদুরের গন্ধ লেগে থাকে।

শহরবাসী নাক চেপে ঢুকে পড়ে নিজস্ব, বড় আর ভালো বাসার খাঁচায়।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা: তুরস্ক
স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা: তুরস্ক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ