X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

হায় রিজওয়ান!

শেগুফতা শারমিন
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:১১আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৫:০৮

শেগুফতা শারমিন আর দশটা বিষয়ের মতো, আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নগরবাসীরা গত ১০ দিন তুমুল আলোচনায় রেখেছিলেন নাটক রিজওয়ান। শহরকেন্দ্রিক মানসিকতার মানুষগুলো যারা  গত কয়েক বছর যাবৎ যে কোনও ইস্যুকে, যে কোনও মানুষকে আলোচনায় রাখতে চরম পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। যারা কেউ মারা গেলে আলোচনা করে, কারও ডিভোর্স হলে তাদের আলোচনার জোয়ারে বিষয়টা হয়ে যায় জাতীয় ইস্যু। অফট্র্যাক পোশাকে বিয়ে করে যাদের আলোচনার বদান্যতায় কেউ হয়ে যায় বিরাট ‘বিষয়’। তাদের আলোচনায় এবার বন্যা, কোরবানি না ত্রাণ, ত্রাণ না কোরবানি, ঈদ যাত্রা, রোহিঙ্গা পার হয়ে এসে গেলো ‘রিজওয়ান’। ১০ দিনের প্রদর্শনীর রিজওয়ান আলোচনায় থাকলো প্রায় সপ্তাহখানেক। একটা মঞ্চ নাটকের জন্য এত আলোচনা সম্ভবত এই প্রথম, অন্তত এই হুজুগে যুগে।
ঢাকা শহরে মঞ্চ নাটক হয়। ছোট বড় নাটকের দল তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় নিয়ে আসে একেকটা নাটক। ধরাবাঁধা গুটিকয় দর্শক সেই নাটক দেখতে যায়। আলোচনা হয় আরো কম পরিসরে। সেই হিসেবে এইবার পুরো ব্যতিক্রম ঘটে গেলো রিজওয়ানকে নিয়ে। মঞ্চ নাটক দেখতে উপচে পড়া মানুষের ভীড়, টিকেট নাই। একদিন আগে সব টিকেট বুকড। এ কখনও ঢাকার মঞ্চ নাটকের নিয়মিত চিত্র না। শিল্পকলার প্রাঙ্গনে ঢুকতেই এত মানুষের ভীড়, টিকেটের হাহাকার মনে আশা জাগায়। মনে হয় মঞ্চ নাটকের দিন বুঝি ফিরে এলো এই দেশে। সাথে সাথে এক তরুণ নাট্যকর্মী ভুল শুধরে দেন। বলেন, শুধু এ নাটকের জন্যই এ অবস্থা! সবসময় এমন হলেতো আমাদের হাল বদলে যেত।

অতএব প্রত্যাশা বাড়ে। কী আছে রিজওয়ানে? ঢাকার মঞ্চ নাটকে আসল সুঅভিনয় আর শক্তিশালী কনটেন্ট ছাড়া খুব বড় কিছু প্রত্যাশাও করতে পারি না। কারণ বড় বড়  গ্লোবাল শহরগুলোতে অপেরা মঞ্চে যে সুবিধা আছে, ঢাকা তার চেয়ে বহুগুণে পিছিয়ে। প্রিন্স এডওয়ার্ড থিয়েটারে কাহিনির প্রয়োজনে ইনডোর মঞ্চে নেমে আসে হেলিকপ্টার। আর শিল্পকলার মঞ্চে যখন ওপর থেকে দড়ি নেমে আসে আমরা বিস্মিত হয়ে যাই। প্রযুক্তি আর আর্থিক সামর্থ্যে যেমন পিছিয়ে আছে নার্ট্যদলগুলো তেমন দর্শক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশার মাত্রাও নেমে আছে অনেক নিচে। সুতরাং রিজওয়ান দেখতে গিয়েছি প্রত্যাশার মুখে লাগাম দিয়েই। কিন্তু ওই যে আলোচনা! হালের নাগরিক দর্পন ফেসবুকে আলোচনার বহর দেখে অতি বাস্তববাদী দর্শকের ভেতরেও তৈরি হয় প্রত্যাশার, নতুন কিছু দেখার।   

দুঃখজনক সত্য হলো, সেই প্রত্যাশাকে মেটাতে পারেনি রিজওয়ান। বহু আগে যেমন মুগ্ধ করেছিল ধাবমান। তার কাছাকাছি যেতে পারেনি রিজওয়ান। একটার সঙ্গে আরেকটার তুলনা করা ঠিক নয়। তারপরও কেন যেন রিজওয়ান দেখে বারবার মনে পড়ে গেলো ধাবমানের কথা। যে ধাবমানে সুশাসনের সংকট তুলে ধরা হয়েছিল। স্থান, কাল, পাত্র কোন বিশেষ বিবেচ্য ছিল না। সেই ধাবমান দেখতে গিয়ে মনে হয়েছিল, এ আমার গল্প। আমার পারিপার্শ্বিক, আমার সংকট। রিজওয়ানে চেষ্টা করা হয়েছে সুশাসনের অভাবের সার্বজনীন রুপ দেখাতে। কাশ্মিরের প্রেক্ষাপটে রচিত কবিতার আলোকে তৈরি নাটকে তাই এসেছে চাকমা ভাষায় সংলাপ। তারপরও মনে হয়নি এ আমার গল্প। হয়তো এ আমার ব্যর্থতা।  যতবার নাটকে জান্নাত মানে বোঝানো হয়েছে কারো নিজ জন্মভূমি। ততোবার মনে হয়েছে কাশ্মিরকেই বুঝি বোঝানো হচ্ছে। যদিও কেউ বলে দেয়নি এটা কাশ্মিরের গল্প। কিন্তু মাথায় ঢুকে ছিল কাশ্মির।

ছোট্ট প্যাম্পলেটে বলা ছিল, কবি আগা শহিদ আলীর কবিতা ‘কান্ট্রি উইথআউট এ পোস্ট অফিস’ অবলম্বনে নাটকটি রচিত। এইটুকু তথ্য নিয়েই নাটক দেখতে বসি। একটা কাহিনির মাঝে বা বলা যায় একটা কবিতার মাঝে আরেকটা কাহিনিকে এনে একসঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশনার যে ব্যাপারটা ছিল, সেখানে মিশ্রণটা ঠিকমতো হয়নি। দর্শক হিসেবে তাই বার বার হোঁচট খাচ্ছিলাম। হয়তো এই দূর্বলতাটা তৈরি হয়েছে তখনই, যথন মূল নাটকটা রচিত হয়। মানে অভিষেক মজুমদার নামে যে ভারতীয় নাট্যকার রিজওয়ান রচনা করেন, সেখানেই হয়তো এই দূর্বলতার সূচনা। খোলা চিঠি লেখার যে সময় ছিল ১৯৯০ তে। সেই সময়ের নায়ক করে রিজওয়ানকে নাটকে নিয়ে আসা হলেও কোথায় যেন ছাড়াছাড়া ভাব রয়ে গেছে। আবার অন্য দিকে এক রিজওয়ানের যে গল্প তার সাবলীল প্রকাশ ঘটেনি, কবিতার ধারা থেকে বের না হওয়ার চেষ্টায়।

আগেই বলেছি ঢাকার মঞ্চে সুঅভিনয়ের প্রত্যাশা ছাড়া কিছু থাকে না। রিজওয়ান নাটকে মনে হয়েছে অভিনয়ের পাশাপাশি অ্যাক্রোবেট প্রাধান্য পেয়েছে বেশি, যা কিনা নাটকটিকে লম্বা করেছে কিছুটা। একই নাটকের ওপর ভিত্তি করে একটা শর্ট ফিল্ম আছে যেখানে গল্পটা সহজ এবং সরাসরি। ঢাকার মঞ্চের রিজওয়ানের ব্যতিক্রমী সৌন্দর্যই হয়তো শারীরিক কসরতের ব্যবহার। মূল কবিতার বড় চরিত্র পোস্টম্যানের ভূমিকাটা নাটকে পরিষ্কারভাবে ধরা যায়নি। হয়তো সেক্ষেত্রে সমস্যা করেছে অভিনেতার মেকাপ এবং মুখভঙ্গি। রিজওয়ান চরিত্রের গড়পড়তা অভিনয় ছাড়া ফাতিমাসহ অন্য উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলোর অভিনয় ভালো ছিল। সবকিছু দেখে মনে হয়েছে, মঞ্চের নানামাত্রিক ব্যবহার, আলো আর অন্যান্য অনুসঙ্গের ব্যবহারে যতটা যত্নশীলতা ছিল, তার চেয়ে কম ছিল অভিনয়ে। তারপরও এই যে নগরবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ্য হয়েছে। টানা সপ্তাহখানেক তাদের আলোচনায় থেকেছে। অন্তত এক সপ্তাহের জন্য রিজওয়ান দেখাটা একটা স্ট্যাটাস সিম্বল বিষয় হয়ে উঠতে পেরেছে মধ্যবিত্তদের কাছে, তাই বা কম কী?

যদিও শেষ পর্যন্ত যে প্রশ্ন মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম, সিনেমার যৌথ প্রযোজনার মতো কি আমরা শেষ পর্যন্ত মঞ্চ নাটকেও ভাষান্তরিত ‘কপি-পেস্টে’র যুগে প্রবেশ করছি?

লেখক: উন্নয়নকর্মী

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ