X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমাদের শিক্ষা: রন্ধ্রে রন্ধ্রে যার শতবর্ষী ঘুনপোকা

শেগুফতা শারমিন
০৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৫০আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:৩৭

শেগুফতা শারমিন গত কয়েকদিন ব্যাপক শোরগোল চলছে, বিষয় শিক্ষা। চারিদিকে গেলো গেলো রব। প্রজন্ম গেলো, প্রজন্ম ধ্বংস হলো সংক্রান্ত হৈচৈ শুনতে শুনতে আড়মোড়া ভাঙছিলাম। আড়মোড়া ভাঙতে গিয়েই ভাবনা। স্রোতের উল্টোদিকে। যে প্রজন্ম আজ চিৎকার চেঁচামেচি করে অস্থির হয়ে গেলো, প্রজন্ম গেলো বলে। সেই প্রজন্মের আসলে কতটুকু আছে, সেটাই ভাবনাতে আছড়ে পড়ে। যে প্রজন্ম আজ রব তুলেছে তারা নিজেরাও পড়ে এসেছে ‘অ’ তে অজগরটি আসছে তেড়ে। কোমলমতি শিশুদের শৈশবের প্রথম পাঠই এ দেশে শুরু হয়েছে ভীতি দিয়ে। অজগরের ভয়, তেড়ে আসার ভয়। আক্ষরিক অর্থে অজগর নিরীহ জীব। সহজে তেড়ে আসে না। শুধু অ দিয়ে শুরু করতে হবে বলে অজগর ছাড়া একসময় এদেশের পণ্ডিতদের কিছু মনে পড়েনি। তার ওপরে অজগরের চরিত্র নিয়েও হয়তো তাদের জানাশোনা ছিল না বেশি। তাতে কী আর করা! এদেশের কোটি কোটি সন্তান বর্ণ পরিচয় শুরুই করলো ভুল তথ্য এবং ভীতি দিয়ে। সেই সেদিন থেকেই অ তে অজগর কোনদিন কারও দিকে তেড়ে না আসলেও অ তে অশিক্ষিত লোকদের হাতে হাতে নষ্ট হতে থাকলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।
এই উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর বা উপমহাদেশের দেশগুলো স্বাধীন হওয়ার পর অথবা যদি বলি ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কোনও দেশের শিক্ষাই এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, যতটা হয়েছে বাংলাদেশে। কোনও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মান এতটা নিম্নমুখী হয়নি, যতটা হয়েছে বাংলাদেশে। উপমহাদেশের কথা বাদ দেই। আমি নিশ্চিত যাদের জানাশোনা আছে, তারা অস্বীকার করবেন না যে তুলনামূলক বিবেচনায় আফ্রিকার অনেকগুলো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের চেয়ে উন্নত। শুধু মানের বিবেচনা নয়, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, গত ৪৬ বছরে শিক্ষা নিয়ে যত গবেষণা, যত পরিবর্তন পরিকল্পনা হয়েছে তা হয়তো সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশে। ফলাফল? আমরা দেখছি, মোটামুটি জীবন দিয়ে।
নিখুঁত পরিকল্পনা ছাড়া একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এতটা ক্ষতি করা সম্ভব বলে মনে হয় না। কি সুনিপুণভাবে, চতুর বুদ্ধিতে এদেশের মানুষকে ইংরেজিতে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। একটা সময় দেশাত্ববোধের দোহাই দিয়ে জাতিকে ইংরেজি বিমুখ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ ইংরেজি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, উচ্চবিত্তদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে উচ্চমূল্যের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। পুঁজিবাদের বিকাশ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোকে উচ্চশ্রেণির উচ্চবিত্তের হাতছাড়া করে নব্য পুঁজিপতিদের নাগালের ভেতর নিয়ে এসেছে। এইসব নব্য পুঁজিপতিরা নগরের উচ্চমূল্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি করেছে স্মার্ট জঙ্গি সন্তান। ১ জুলাইয়ের রাতের অন্ধকার আমাদের দিনের আলোর মতো পরিষ্কার করে দেখিয়ে দিয়েছে এই চিত্র। শুধু তাই নয়, একই দেশে বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের বহুভাগে ভাগ করে ফেলেছে।

আচ্ছা কেউ বলতে পারেন, কোন দেশে শিক্ষাক্রম বছর বছর পরিবর্তন হয়? শিক্ষার উদ্দেশ্য সার্টিফিকেট অর্জন নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য একটি সুনির্দিষ্ট সময়কালের ভেতর কিছু সুনির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন করা। হতে পারে সে দক্ষতা পথ চলা বিষয়ক, রাস্তার সিগনাল বাতি চেনা বিষয়ক, হতে পারে সে দক্ষতা ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে রান্না বিষয়ক, আদব কায়দা সংক্রান্ত, এর সঙ্গে লিখতে পারা, পড়তে পারার দক্ষতাতো আছেই। যেসব দক্ষতা মানুষ মাত্রই প্রয়োজন। সে আমার দাদার আমল হোক বা আমার আমল। আদব কায়দা সব সময় সব সমাজে এক। অন্য একজন ভুল করলেও জাপানিরা সরি বলে। নিজে ভালো কাজ করে দিয়েও অন্যকে ধন্যবাদ বলে। এইযে ভদ্রতা, এটা জাপানিরা স্কুলে শেখে। আমাদের স্কুল কী আমাদের দুঃখিত বা ধন্যবাদ বলতে শেখায়? জাপানে ৭ বছরের শিশুরা ঘর মুছতে শিখে, স্কুলে। রান্না করতে শেখে স্কুলে। ফসল আবাদ করতে শেখে স্কুলে। বাসন ধুতে শেখে স্কুলে। আমাদের ১০ বছরের শিশুরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ফাইভওয়ালা সার্টিফিকেট পেয়ে আসলে কী শিখে, যেটা তার ব্যক্তি জীবনে কাজে লাগে?  ক্লাস ফাইভ পাস একজন শিশু কি জীবন দক্ষতা নিয়ে প্রাইমারি স্কুল ত্যাগ করে?

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের প্রতিযোগিতা করতে শেখায়। তোমার সঙ্গে আমার, আমার সঙ্গে ওর। ছোট ছোট শিশুরা বন্ধু হয় না, হয় একে অপরের প্রতিযোগী। একজন আরেকজনকে টপকে যাবে, পেছনে ফেলবে, মনে প্রাণে এই চেষ্টা। শিশুদের সঙ্গে যুক্ত হয় মা-বাবা। এক লজ্জাহীন উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে সন্তান, মা, বাবা। এতে হয়তো একটা এ প্লাস আসে। কিন্তু শিশুর জীবন থেকে মাইনাস হয়ে যায় বন্ধুত্ব, অন্যের প্রতি ভালোবাসা, মানবতাবোধ, মমত্ব। নৈতিকভাবে অতি দুর্বল হয়ে বেড়ে ওঠে শিশুরা। সিস্টেম শিশুকে অসহনশীল করে তোলে। এর ফলাফলে সামগ্রিক জাতি হিসেবেই আমরা ক্রমেই অসহনশীল, অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। আমরা হয়ে উঠছি তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল জাতি। আমরা সামগ্রিকভাবে একটা বিষয় দেখতে ব্যর্থ হই। এর পরিবর্তে অতি ক্ষুদ্র বিষয়, যা কিনা সরাসরি আমার স্বার্থের সাথে সম্পৃক্ত তাই নিয়ে সাময়িক প্রতিক্রিয়া জানাই। কদিন পর আরেকটি ব্যক্তিস্বার্থ সামনে আসে, আমরা ভুলে যাই আগের ঘটনা।

আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল প্রজন্ম শৈশবে পড়া অ তে অজগরের মতো তেড়ে এসেছে ওড়না বিতর্ক নিয়ে। পুরা শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় ও তে ওড়না সমুদ্রে এক বিন্দু শিশির ছাড়া কিছু নয়। সেই ওড়না কে টেনে হিঁচড়ে নারীর স্বাধীনতা, ধর্মীয় মৌলবাদ পর্যন্ত টেনে নেওয়ার চেষ্টা আর ছাগলকে গাছে ওঠানোর চেষ্টা দুটোই দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থায় ক্রমে ক্রমে বানিয়ে তোলা মূর্খ প্রজন্মের মুখচ্ছবি স্পষ্ট করে দেয়। আমরা প্রশ্ন করিনা, ২০১০ এর শিক্ষানীতি নিয়ে। কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী-অভিভাবক, উন্নয়ন সংশ্লিষ্টদের মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে প্রণীত এই শিক্ষানীতি ছিল বেশ প্রশংসনীয়। শিক্ষানীতিতে পরিষ্কার বলা ছিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্য করতে পারবে না। অথচ বেশিরভাগ ইংরেজি মাধ্যম এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্য করছে বছরের পর বছর। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণের জন্য কমিটি করার কথা ছিল, সেটা আদতেই হচ্ছে কিনা আমরা ভেবে দেখি না।

হেফাজত যখন পরিকল্পিতভাবে সরকারের কাছে দাবি পেশ করেছে পরিবর্তনের, আমরা চুপ করে থেকেছি। কারণ, হেফাজতের প্রতিবাদ করাটা অনেকের ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত করেছে। আর ঠিক এই ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার শিক্ষাটাই আমরা পেয়ে আসছি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই।

তুমুলভাবে আলোচিত হচ্ছে, কুসুমকুমারি দেবী এবং হুমায়ুন আজাদের কবিতা। জনে জনে শেয়ার দিচ্ছে কবিতাগুলো।  বিপরীত স্রোত আমাকে ভাবিয়ে তোলে, কতজন এই দুটো কবিতা আগে পড়েছিল? এদেশে কতজন মানুষ জানে, লাল নীল দীপাবলী বা ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা’র হুমায়ুন আজাদ একজন কবিও? প্রথম দু’লাইন ছাড়া কতজন এর আগে কুসুমকুমারি দেবীর পুরো কবিতাটা জানতো? স্কুল মানুষকে সাহিত্য পড়ায় না। স্কুল মানুষের ভেতরে সাহিত্য পড়ার আগ্রহকে জাগিয়ে তোলে। স্কুলের কাজ সূত্র ধরে দেওয়া। সেই সূত্র ধরে মানুষ তার আগ্রহ নিয়ে পড়তে পড়তে এগিয়ে যাবে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের স্কুলগুলোতে বাংলা মানেই কতিপয় কবিতা মুখস্থ করা। এর বাইরে আর কিছু নয়। যে কারণে যারা এখন বইয়ের গ্রন্থনার কাজ করে, তারাও কোন কবিতা শুদ্ধ, কোন কবিতা অশুদ্ধ জানে না।

সব কিছু দেখে শুনে মনে হয়, মাথা আছে কিনা খোঁজ নেই। কিন্তু কানের চিন্তায় আমরা ছুটছি নাকি পরিকল্পিতভাবে ছুটিয়ে  দেওয়া হচ্ছে, কে জানে!

লেখক: উন্নয়নকর্মী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ