X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যাশ্রমের দিনগুলো

শোয়াইব জিবরান
০৮ এপ্রিল ২০২১, ১০:৫৪আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২১, ১১:০৩

তাঁরা, সে শ্রমণেরা এক বস্ত্রেই গুরুগৃহে যেতেন, হাজার বছর আগে। সৌতি যেমন বলেছিলেন—‘চরাচরগুরু হৃষিকেশ হরিকে নমস্কার করিয়া আমি ব্যাসপ্রোক্ত অমৃতকথা বয়ান করছি। কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন আবার ভবিষ্যতের অন্য কবিরাও বলবেন।’ তাদের সেসকল মন্ত্রধ্বনি আজও বাতাসে গুঞ্জরিত হতেছে ময়নামতিতে, দূর নালন্দা, তক্ষশিলায়। বহুবহু ক্রোশ পার হয়ে, রক্তধুলোমাখা পায়ে তাঁরা পৌঁছতেন সেসকল পবিত্র আশ্রমে, ব্রহ্মবিদ্যালাভের আশায়। আমাদের বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রাম হতে যেমন গিয়েছিলেন শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর তেমনি সুদূর চীন হতে এসেছিলেন মান্ডারিন মানুষেরা। তাঁদেরও গল্প এমনি লেখা আছে কালের পৃষ্ঠায়।

আমরা তিনবন্ধু—মুজিব ইরম, ফখরউদ্দীন আর আমি এক ঘোরলাগা সন্ধ্যায় রওয়ানা দিয়েছিলাম সেরকমই পবিত্র আশ্রম গৃহের সন্ধানে। ট্রেনটি অনেক অনেক মাঠ, প্রান্তর পার হয়ে যখন ক্লান্ত পথিকের মতন কমলাপুর দাঁড়িয়েছিল তখন বেশ গভীর রাত। আলো দিয়ে ঢাকা এ শহরকে আমরা তখন চিনতাম না। সে আশ্রমের পথেই আমরা ঠাঁই নিয়েছিলাম সিদ্দিক বাজারের অচেনা এক গুহার মতন হোটেলে। তারপর ভূতগ্রস্তের মতন কতগুলো দিন আমাদের কেটে গিয়েছিল এ শহরের অচেনা গলিতে গ্রহণ লাগা সন্ধ্যায়। আমরা একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম ১৮৪, ফকিরাপুল দারোগাবাড়ির দ্বিতীয়তলায়। বাংলা সাহিত্যপাঠ যাতে মিস না হয় সেজন্য ভর্তি হয়েছিলাম ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগে। সেবাড়িতে এক সময় আমার কাজিন আতিক রহমানও যোগ দেয়। পরে সে ‘স্বাতন্ত্র্য’ নামে একটা লিটলম্যাগ প্রকাশ করে বিখ্যাত হইছিল। এক সময় আমার জাহাঙ্গীরনগরের বহুল কাঙ্ক্ষিত বাংলা বিভাগে চান্স হয়ে যায়।

এক শীতের সকালে আমি ১৮৪ ফকিরাপুলের মেস থেকে বোচকাবুচকি নিয়া জাহাঙ্গীরনগরের আশ্রমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। যে হলটিতে আমার আবাসন হয় তার নামটি ছিল বড়ই অদ্ভুত- জিল্লুর রহমান টেক্সটাইল হল। গার্মেটস শিল্প তখনে মাত্র দাঁড়াইতেছে। না, তাই বলে ওখানেও কোনো গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। ছাত্রদের চাপ সামলাইতে এক সময় তৎকালীন উপাচার্য ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী অতিথি পাখির কলকাকলি মুখরিত লেকের দক্ষিণ পাড়ে টিনসেডের অনেকগুলা ঘর তৈরি করেন। এগুলো ছিল আসলে আল বেরুণী হলের এক্সটেনশন। ঘরগুলোর গঠনের কারণে নাম হইছিল এমন। সাথে ব্যঙ্গ হিসেবে স্যারের নামও জুইড়া দেওয়া হইছিল।

তখনে শীতকাল। ক্যাম্পাসে হাজার হাজার অতিথি পাখি এসেছে। টেক্সটাইল হলের লাগোয়া উল্টোদিকেই মেয়েদের ফ. ন হল। শীতের পাখি আর আপাদের কলকাকলি মুখরিত চারপাশ। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আমাদের মনে শান্তি নেই। হলে ওঠার পরই এই অশান্ত মন নিয়া কী যে করি, কী যে করি। প্রথমে হলের সামনের মাঠে ঘোট পাঁকাতে থাকি।

আগে সন্ধ্যা নামলেই ঘরে ফেরার তাড়া থাকত। প্রস্তুত থাকত পাখির নীড়ের মতন মায়ের নীড়। সন্ধ্যার নাশতা আর রুটিন করে পড়তে বসার নিয়ম। জিল্লুর রহমান টেক্সটাইলে ওঠার পর এ নিয়ম পুরোটাই পাল্টে গেল। এখন কেউ সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার জন্য ডাকে না, অপেক্ষা করে না খাবার নিয়ে, মাস্টার এসে পড়াতে বসান না, কেউ যেন কোথাও নেই, যেখানে নিজেই নিজের সম্বল। এক ধরনের অভিভাবকহীন একাকিত্ব পেয়ে বসে মনে। হলের রুমে এসে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা ধমকে গেলে, বিছানাপত্র বাইরে ফেলে দিলে, প্রহারের হুমকি দিলে বিচার দেওয়ার মতো পাওয়া যায় না কাউকে। নিজেকে নিয়ে নিজে পালাতে হয়, মোকাবিলা করতে হয়। একাকিত্ব সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে চেপে বসে সন্ধ্যাবেলা। তাই আমরা একাকিত্ব কাটাতে জড়ো হই সন্ধ্যার পর হলের সামনের মাঠে। রাতে কাগজের মতো পাতলা করে টুকরো করা মাছ আর ততোধিক পাতলা ডাল খেয়ে মাঠে ফিরে এলে সে জমায়েত আরো ঘন হয়ে আসত। কখনো কখনো আড্ডা রূপ নিত হল্লায়। কোনো উপলক্ষ্য পেলে তো কথাই নেই। একবার মনে আছে আমাদের সিনিয়র ব্যাচের র‌্যাগ চলছিল। এ উপলক্ষ্যে সামনের হলের বড় আপারা হল্লা করছিলেন। দেখাদেখি আমরাও বাইরে থেকে যোগ দিলাম সে হল্লায়। কিন্তু আমাদের হল্লাটা মনে হয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। রুম থেকে নিয়ে এলাম হাঁড়ি, পাতিল, প্লেট। সেগুলো বাজানোসহ নাচানাচিও হলো খুব। হয়তো সবার পোশাকআশাকও ঠিক থাকল না একসময়। সে হলে থাকতেন আমাদের বিভাগের বড় দিদি ক্যাম্পাসের বিখ্যাত কাকলী মুখোপাধ্যায়। তিনি বিখ্যাত ছিলেন অনেকগুলো কারণে—প্রথমত তাঁর বাবা সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যতাত্ত্বিক। কাকলীদি দেখতেও ছিলেন বিরাটকায়। কথা বলতেন মাস্তানদের মতো। ধমকের সুরে। পরদিন সকালবেলা বিভাগের সামনে দেখা হলে বললেন, কীরে ছোকড়া, খুব তো দেখি নাচতে জানিস। মনে রাখলাম। তিনি মনে রেখেছিলেন—না নাচালেও পরে বসন্তবরণ অনুষ্ঠানে সমবেত গানের দলে গান গাইয়ে ছেড়েছিলেন।

আমাদের হলের সামনের এই দলপাঁকানোতেও এক সময় যেন নিঃসঙ্গতা দূর হচ্ছিল না। তাই রাত হলে আমরা আরো আরো দূরে যেতে থাকি। রাতে হাঁটতে হাঁটতে যেতে থাকি প্রান্তিক পেরিয়ে দূরের বিশমাইলের দিকে। ওই দিকটা তখন বিখ্যাত ছিল নেশা করার জন্য। আমাদের দলের কেউ নেশাতে না জড়ালেও কবিতা আর গানের নেশা আমাদের পেয়ে বসে। পরে আবিষ্কার করেছি আমাদের বন্ধুরা সবাই আসলে কমবেশি কবি কবি ছিল। আমরা অবিরাম আউড়ে চলতাম জীবনানন্দ, বিনয়, সমর সেন। সমর সেনের ‘কী আনন্দ পাও তুমি সন্তান ধারণে’, জীবনানন্দের  ‘আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে’ বা ‘এন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’ এই লাইনগুলো আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের চরণের সমান হয়ে উঠেছিল। সাথে যুক্ত হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন লোকসঙ্গীত। আমার হাড় কালা করলাম রে থেকে শুরু করে ঠাকুর কেউ বাদ যেতেন না। 

গান গাইতে গাইতে যখন নবাব ফয়জুন্নেসা হল পার হতাম তখন আমাদের গানের ভেতর দিয়া এক অজানা হাহাকার তীব্র আর্তি ঝরে পড়ত। কোনো নির্দিষ্ট জনের উদ্দেশ্যে হয়তো নয়, তবু মেয়েদের হলে ঘুমন্ত সকলের উদ্দেশ্যে যেন নিবেদিত হতো আমাদের সেসকল কান্নাভরা গান। কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে এ গানগুলো নিবেদিত হতো তাতে তাদের যে ঘুম ভাঙ্গত, তা নয়। এক পাষাণ হৃদয় নিয়া তারা ঘুমায়া থাকত। এই সদ্য মাতৃবিচ্ছিন্ন অনাথ বালকগুলোর প্রতি তাদের যেন কোনো মমতাই ছিল না। তাদের সে মমতা পাওয়ার জন্য আমাদের আরো বছর দুয়েক অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সে আরেক মর্মান্তিক কাহিনি। নিশ্চয় বলা হবে অন্য কোনো দিন, অন্য কোনোখানে।

আমাদের সময় ক্যাম্পাসে লেখালেখি করতেন সেলিম আল দীন, মোহাম্মদ রফিক, আনু মুহাম্মদ, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস আরো আরো অনেকে। বড় ভাইদের মধ্যে ছিলেন কফিল আহমেদ, শিমুল মাহমুদ, সুমন রহমান, মাহবুব পিয়াল, হাসিবুল হক, মাসুদুল হক আরো অনেকে। জুনিয়রদের মধ্যে ছিল শামীম রেজা, প্রশান্ত মৃধা, শামীম সিদ্দিকী, সোহেল হাসান গালিব, মাহবুব আজীজ, হামীম কামরুল হক, শিমুল সালাহউদ্দিন আরো নাম এক্ষুনি মনে পড়ছে না এমন জোনাকজ্বলা পোকারা। ঢাকা থেকে সাভারে আমার হলে প্রায়ই গিয়ে উপস্থিত হতেন গল্পকার সাদ কামালী, সরকার আমিন, শাহনাজ মুন্নী, মুজিব ইরম, কবির হুমায়ূন, ‘নদী’র তাজুল ইসলাম, মাহবুব আর আসত আত্মহননকারী শামীম কবীর।

আমিন-সাদী ভাইরা এলে রাতে থেকে যেতেন। আমি ততোদিনে আল বেরুণী হলের লাল ভবনের নীচতলার ১১০ নম্বর রুমে উঠেছি। আমি তাদের সাধারণত রাতে রুম ছেড়ে দিতাম। সারা রাত ধরে হল্লা করতেন। একদিন সকালে রুমে ফিরে দেখি রাতে পান করে বমি করে পানি ফেলে রুমের মেসি ফ্লোরে তার ওপর শুয়ে আছেন, অঘোরে কবিরা। তাজুল আর শামীম কবীর দুজনই সম্ভবত পার্টটাইম প্রেম করত আমাদেরই কোনো বন্ধুর সাথে। তারাও রাতে থাকতে চাইলে রুমে জায়গা দিতাম। শামীম কবীর ছিলো ভীষণ অন্তর্মুখি, সারাক্ষণ থাকত আনমনা। মুখের দিকে তাকিয়েও মনে হতো অন্য কোনো জগতে আছে। ও আত্মহত্যা করার পর বুঝতে পারি ও আসলে অনেক আগেই নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিল। নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

ততদিনে ক্যাম্পাস থেকে কিউপিড নামে একটা লিটলম্যাগাজিন বের করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ কাজে আমার সঙ্গী হয়ে উঠেছে সহপাঠী কবি আজিজুন মাগফুরা। আমরা একটি সংখ্যা বের করার পরই ক্যাম্পাসে সাড়া পড়ে গেল। তারপর বের হলো কয়েকটি সংখ্যা। প্রতি সংখ্যায়ই থাকত তরুণতম লেখকদের প্রোট্রেটসহ গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা। এ কবির তালিকায় ছিলেন—চঞ্চল আশরাফ, জেনিস মাহমুন, সরকার আমিন, শাহনাজ মুন্নী, আয়শা ঝর্না, মুজিব ইরম কবির হুমায়ুন আর আরো আরো কবি। ছবিগুলো এঁকে দিত বন্ধু নাজিব তারেক। পরে তাঁরা প্রত্যেকেই নব্বইয়ের প্রধান কবি শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। তবে কিউপিড ছিল কেবল ‘কবিতাপত্র’। একসময় গদ্যসহ অন্যান্য জঁর নিয়া ‘শব্দপাঠ’ নামে একটা সিরিয়াস লিটলম্যাগ প্রকাশের উদ্যোগ নিলাম। আল বেরুণী হলেরই ১১০ নম্বর রুম হতে। সঙ্গে যোগ হলো বন্ধু সাবিরুল ইসলাম। লেখাপাতি জোগাড় হলো। সিরিয়াস সিরিয়াস লেখা। উত্তরাধুনিকতা, সাবঅল্টার্ন, ডিকন্স্ট্রাকশন এগুলো তখন সবে ঢাকায় আলোচিত হতে শুরু করেছে। এ বিষয়গুলো নিয়েই গদ্য লিখলেন আজফার হোসেন, মঈন চৌধুরী, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, মাসুদুল হক আরো অনেকেই। লেখাপাতি সবই জোগাড় হলেও সমস্যা দেখা দিলো টাকা নিয়ে। আবারো এগিয়ে এলো সহপাঠী বন্ধু কবি আজিজুন মাগফুরা। ইলাট্রেশন বরাবরের মতো করে দিলো নাজিব তারেক। ‘শব্দপাঠ’ সেসময়ের লিটলম্যাগাজিনের জগতে সাড়া জাগিয়ে ছিল। সেকারণেই কিনা জানি না পরে বিলাত থেকেও ‘শব্দপাঠ’ নামে আরেকটি সাহিত্যপত্রিকা বের হয়েছিল। ‘শব্দপাঠ’ বেশিদিন বের করি নাই। কিন্তু এই শব্দপাঠকে কেন্দ্র করে আমার হলরুমে এক সাহিত্যচক্র গড়ে উঠেছিল। বিশেষত কবি মাসুদুল হক নিয়মিত আসতেন। আড্ডা হতো। তাকে নিয়ে রাত বিরাতে আমরা নানা জায়গায় ঘুরতে বেরুতাম ভূতে পাওয়া মানুষের মতো। অনেক রাত আমরা কামালউদ্দিন হলের পাশের বটতলায় কাটিয়েছি। ভোররাতে শিশির ঘাসে জমা হলে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে গেয়েছি—আমি কান পেতে রই। রাত হলে মাসুদ খুব মেটাফিজিক্যাল গল্প বলতে ভালো বাসতেন। যেমন একবার এম এইচ হলে হয়েছে কী এক ভাই তার রুমমেটকে রাতে ঘুমানোর সময় বললেন ভাই লাইটটা নিভায়া দাও। রুমমেটটি তার বিছানায় শুয়েই হাত লম্বা করে দশফুট দূরের বাতিটি নিভিয়ে ফেলল। এটা দেখে রুমমেটের রাতেই জ্বর এলো আর পরদিন সকালে সে দশহাত লম্বা হাতের ছেলেটিকে আর কখনো ক্যাম্পাসে দেখা গেল না। বা একদিন রাতে তিনি একা ফিরছিলেন। দেখলেন যে, বিশমাইলের ওইদিক হতে একটা রিকশা আসতেছে। পাশে আসার পর দেখা গেল রিকশাটা কোনো চালক নেই রিকশার মেঝেতে সাদা কাফনে মোড়ানো একাটা লাশ শুয়ে আছে।  রাতের কুয়াশার জড়ানো সে গল্পগুলো মাথায় নিয়ে আমি শেষরাতে হলে ফিরতাম। আর খুব ঘনঘন জ্বর আসত। আমার ‘কাঠ চেরাইয়ের শব্দ’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই সে জ্বরের দিনগুলোতে লেখা।

জ্বরের দিনগুলোতে খুব সমস্যা হতো। রুমমেট চলে যেত ক্লাসে। পুরা হল খালি হয়ে যেত। একা একা হলের ১১০ নম্বর রুমে পড়ে থাকতাম। মোবাইল তখনও আসে নাই। বিকেলবেলাটাকে খুব ধূসর আর হলদেটে মনে হতো। একবার টাইফয়েডে আক্রান্ত হলাম। খুব জ্বর। সাত দিন ধরে চলল একটানা। কোনো ঔষুধেই কাজ হলো না। জ্বরের ঘোরে চোখমুখ লাল হয়ে শুয়ে থাকি। মনে পড়ে এমন জ্বরে বাড়িতে থাকলে বাবা কোলে নিয়ে ঘুরতেন। আমার খুব মনে আছে গ্রামের শেষ জ্বরে বাবা যখন কোলে নিয়ে আমাকে হাঁটতে চেষ্টা করছিলেন তখন আমার পা মাটিতে গড়াগড়ি  খেয়েছিল। কেননা, আমি উচ্চতায় তাকে তখন ছাড়িয়ে গেছিলাম। জ্বরের ঘোরে একলা হলে মাকে খুব মনে পড়ত। জ্বর ১০৩-৪ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেত আমার ভ্রম হতো মা আমাকে মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছেন। আর মাথার চুল শুকাবার জন্য যখন আঁচল দিয়ে নিচু ঝুঁকে আমার মাথামুখ মুছছেন তখন তার শরীরের ঘ্রাণ আমি পাচ্ছি।

একদিন জ্বরের ঘোরে আমার মনে হলো মা যেন আমাকে মাথা মুছে দিচ্ছেন। হ্যাঁ, আমি তার ঘ্রাণ পাচ্ছি ঠিক ঠিক। চেতন-অবচেতনের মধ্যে আমার মন বলছে না একটা শাড়ি নয়। কারো ওড়না। মা তো ওড়না পরেন না। একটু একটু চেতনা আমি ফিরে পাচ্ছি আর বুঝতে পারছি হ্যাঁ এটি কবি আজিজুন মাগফুরা। সেই আমার পাশে হাসি হাসি মুখে মাথা জল দিয়ে ধুয়ে অখনে হাসি হাসি মুখে পাশে বসে আছে।

বিদ্যাশ্রমের সে অনাথ কুয়াশাঘেরা, হলদে অনাথের দিনগুলোতে এমনি নির্ভয় দেওয়া হাসিমুখের প্রসারিত হাতও পেয়েছিলাম। সেরাঙা দুহাত নিয়ে সে আজ চলে গেছে দূরে। জাহাঙ্গীরনগর বিদ্যাশ্রমসূত্রে সেস্মৃতি ক্রমে মনে আসিতেছে, দুঃখ জাগানিয়া।

কবি শোয়াইব জিবরান ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন, মৌলবীবাজারে। তার ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে লেখাটি সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘ধুলো ও জলে লেখা জীবন’ থেকে প্রকাশ করা হল—বি.স.

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সিজারে প্রসূতির মৃত্যু, মুচলেকা নিয়ে মরদেহ হস্তান্তর
সিজারে প্রসূতির মৃত্যু, মুচলেকা নিয়ে মরদেহ হস্তান্তর
পহেলা বৈশাখের নির্দেশনা উপেক্ষা উদীচীর: যা বলছে ডিএমপি
পহেলা বৈশাখের নির্দেশনা উপেক্ষা উদীচীর: যা বলছে ডিএমপি
সিডনির গির্জায় ছুরিকাঘাতকে সন্ত্রাসী হামলা ঘোষণা
সিডনির গির্জায় ছুরিকাঘাতকে সন্ত্রাসী হামলা ঘোষণা
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
সর্বাধিক পঠিত
কিছু আরব দেশ কেন ইসরায়েলকে সাহায্য করছে?
কিছু আরব দেশ কেন ইসরায়েলকে সাহায্য করছে?
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, আবেদন শেষ ১৮ এপ্রিল
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, আবেদন শেষ ১৮ এপ্রিল
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
ঈদের সিনেমা: হলে কেমন চলছে, দর্শক কী বলছে
ঈদের সিনেমা: হলে কেমন চলছে, দর্শক কী বলছে