X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

যে চার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায় ব্র্যাক

উদিসা ইসলাম
১৯ মার্চ ২০২১, ১৬:৫৪আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২১, ১৯:৫৩

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর মনপুরাতে গিয়ে মানুষের ভোগান্তি দেখে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার আইডিয়াটা এসেছিল স্যার ফজলে হাসান আবেদের মাথায়। স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের মধ্য দিয়ে সূচনা করেন ব্র্যাকের। পায়ে পায়ে তা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সংস্থা। সেই প্রতিষ্ঠানের আগামীর পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।

বাংলা ট্রিবিউন: প্রতিষ্ঠার প্রায় ৫০ বছর হতে চললো। এর মাঝে স্যার ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যু বেশ খানিকটা ধাক্কা দিয়েছে ব্র্যাককে। আবেদ স্যারের অনুপস্থিতিতে কী পার্থক্যগুলো দেখতে পাচ্ছেন?

আসিফ সালেহ: ব্র্যাক একটি আইডিয়া। কাদের জন্য কীভাবে কাজ করা যায় তার সমাধানের পথ বের করা এর উদ্দেশ্য। আমরা লক্ষ রাখি, যাদের প্রয়োজন বেশি তাদের পাশে যেন আগে দাঁড়াতে পারি।

কাজের ধরনের কথা যদি চিন্তা করি, মানুষকে কেন্দ্র করে সামাজিক সমস্যাগুলো বিভিন্ন সময়ে বিবর্তিত হয়। সেগুলোর সমাধান বের করতে হয়। এই মূলমন্ত্র থেকে ব্র্যাক কোনও দিনই সরবে না। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা যেভাবে শুরু করে গিয়েছিলেন, সেভাবেই চলছে, চলবে।

এখন যে সমস্যা নিয়ে কাজ করছি তাতেও পরিবর্তন আনতে হবে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ চেয়েছেন যে ব্র্যাক ততদিনই নিজের লক্ষ্যে থাকবে যতদিন পরিবর্তিত সমাজের সঙ্গে বদলে যাওয়া সামাজিক সমস্যাগুলোর সেরা সমাধান বের করতে পারবে।

তিনি সংগঠন তৈরির পেছনে জোর দিয়েছেন। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। গত এক বছর করোনা দুর্যোগটা বড় পরীক্ষা ছিল। এ পরিস্থিতি সব প্রতিষ্ঠানই ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে। যোগ্য নেতৃত্বকে সামনে আনার যে প্রবণতা স্যারের ছিল, এটি তারই ফল।

বাংলা ট্রিবিউন: প্রতিষ্ঠাতার কোন বিষয়গুলো বেশি মিস করবেন?

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ আসিফ সালেহ: একটি ভালো প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য প্রবৃদ্ধি দরকার। লাভজনক হওয়া জরুরি। কিন্তু সেটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। আমরা সামাজিক সমস্যার সমাধান নিয়েই আগ্রহী। যে চ্যালেঞ্জটা আগামীতে মোকাবিলা করতে হবে, সেটা হচ্ছে উনি যে বড় ঝুঁকিগুলো নিতেন, যে রাজনৈতিক-সামাজিক চাপ ম্যানেজ করতেন, সেই জায়গাটা। সেই সাহস ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আমাদের আছে কিনা ও আগামীতে কী হবে আমরা এখনও জানি না। ওই জায়গাগুলোতে উনার দিকনির্দেশনা অনেক বেশি মিস করবো।

বাংলা ট্রিবিউন: কোভিডকালে ব্র্যাক আলাদা কী করলো?

আসিফ সালেহ: লকডাউনের মাঝে অর্থনৈতিক দুর্যোগ দেখা গেছে। প্রথমেই আমরা মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দিতে চেয়েছি। পরে সরকারও টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা যেভাবে কাজটা করেছি সেটা কতটা কার্যকর হয়েছে সেটা জানতে চেয়েছে সরকার। আমরা উদ্ভূত সমস্যার দিকে আলোকপাত করে সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি সেটা যাতে অন্যরাও অনুসরণ করতে পারে সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী এবং ব্র্যাকের ৪৯ বছর। দেশের অগ্রগতিতে ব্র্যাক কী ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলে মনে করেন?

আসিফ সালেহ: একটা কথা পরিষ্কার, বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে ব্র্যাক হতো না। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে মনপুরাতে গিয়ে নিজের চোখে ভোগান্তি দেখে প্রতিষ্ঠাতার মনে বড় পরিবর্তন ঘটে। তখন থেকেই তিনি দেশের মানুষের জন্য কিছু একটা করতে চান। তারপর স্বাধীনতার পর যে পুনর্গঠনের স্বপ্ন সবার ভেতর,  ব্র্যাক সৃষ্টির পেছনে সেটাও বড় কারণ। উনি পিছিয়ে পড়া মানুষদের সবার আগে সাহায্য করার চিন্তা করেছিলেন। যা ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা থেকেই এসেছিল। শরণার্থীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করেন স্বাধীনতার পরপরই।

বাংলা ট্রিবিউন: প্রতিটি সময় ব্র্যাকের কাজে ভিন্নতা দেখা দেছে, নতুন কিছু করার চেষ্টা দেখা গেছে, সেটা নিয়ে কিছু বলতে চান?

আসিফ সালেহ: প্রত্যেক দশকে নতুন ফোকাস ছিল। সত্তরের দশকে ব্র্যাকের উদ্যোগে শিশুমৃত্যু কমানো ছিল মূল লক্ষ্য। আর ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ। একটা পরিবারে দেখা গেলো শিশুর সংখ্যা অনেক। কেন এত ছেলেমেয়ে জানার চেষ্টা করলাম আমরা। দেখা গেলো বাবা-মায়েরা জানেন না ক’টা ছেলেমেয়ে বাঁচবে। সেই চিন্তা থেকে আমরা ভাবলাম শিশুমৃত্যুর হার কমাতে হবে। ব্র্যাকের সেটা সবচেয়ে বড় ক্যাম্পেইন ছিল। প্রতিটি বাসায় বাবা-মাদের শেখানোর কাজটি করা হয়েছে। স্যালাইনের গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। তাতে শিশুমৃত্যুও কমেছে।

পরে আশির দশকে শিশুদের টিকা নিয়ে সরকার ও ব্র্যাক একসঙ্গে কাজ করেছে। নব্বইয়ের দশকে ফোকাস ছিল শিক্ষা। বিশেষ করে মেয়েদের পড়ানোর উদ্যোগ ছিল। ৬৪ হাজার স্কুল চালিয়েছে ব্র্যাক। এক কোটি ২০ লাখ ছেলেমেয়ে শিক্ষার আলো পেয়েছে। এখন স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। এর পেছনে ব্র্যাক বড় ভূমিকা পালন করেছে। এর পাশাপাশি স্যানিটেশনের কথাও বলতে চাই। টয়লেট ব্যবহারের অভ্যাস করানোর পেছনেও ব্র্যাক কাজ করেছে।

প্রতিটি দশকে ফোকাস বদলেছে। ২০১৫ সালে তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছি আমরা।

বাংলা ট্রিবিউন: নারীরা বাইরেও কাজ করবে, সমাজের এমন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে ব্র্যাক কী ভূমিকা রেখেছে?

আসিফ সালেহ: দুটো জায়গায় আমাদের প্রতি দশকেই ফোকাস ছিল। প্রথমত, মানুষের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণ। দ্বিতীয়ত, নারীদের এগিয়ে নেওয়া। কোনও দেশ ভাগ্য বদলাতে পারবে না, যদি তাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়ে। আবেদ স্যার যেটি করেছিলেন, নারীদের সাহায্য করবো, এমনটা না ভেবে তিনি ভেবেছিলেন উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হবে নারী। তাতে তাদের ক্ষমতায়ন হবে এবং উন্নয়নের কাজটাও হবে। এই যে বাংলাদেশে ব্র্যাকের ৬৪ হাজার স্কুলের শিক্ষক নারী, ৪০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীও নারী- এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিকল্পনারই অংশ। এর মধ্য দিয়ে গ্রামবাংলার ধারণায় পরিবর্তন এসেছে।

সরকার অবকাঠামো তৈরি করতে ভালো পারে। কিন্তু মানুষকে সেই অবকাঠামোর কাছে নিয়ে আসায় এনজিওর অবদান আছে। এই সম্মিলনটা ভালো হয়েছিল বলে আমরা বিভিন্ন সামাজিক সূচকগুলোতে এগিয়েছি।

আসিফ সালেহ’র সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রধান প্রতিবেদক উদিসা ইসলাম বাংলা ট্রিবিউন: এখন সেই সম্মিলনে খানিকটা ঢিলেমি দেখা যাচ্ছে কী? আগামীতে সামাজিক সূচকগুলোতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না তো?

আসিফ সালেহ: ঢিলেমি হয়েছে বলবো না। নানা বাস্তব সমস্যা এসেছে। নব্বইয়ের দশকে বা তারপর এনজিওদের প্রভাব বেশি ছিল। এখন সেটা কমেছে। বড় কারণ অর্থনৈতিক। এনজিওগুলো দাতাদের ওপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ এনজিও নিজস্ব আয়ের পথ করেনি। সে কারণে তাদের কার্যক্ষেত্র ছোট হয়েছে।

অন্যদিকে রাষ্ট্র গত ২০-৩০ বছরে শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা রাষ্ট্রকে আরও অর্জন করতে হবে। করোনা ভ্যাকসিনের কথাই ধরুন। সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে যে এর তথ্য যাওয়া দরকার, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার, ভুল বোঝাবুঝি দূর করা দরকার, সেখানে তেমন কাজ হচ্ছে না। দেশজুড়ে ব্যাপক উদ্যোগ থাকার কথা, সেটি হচ্ছে না। উন্নত দেশে উন্নতির একটা ধরন হলো, এনজিওগুলোকে বিভিন্ন প্রকল্পে সম্পৃক্ত করে কাজগুলো বাস্তবায়ন করা। সেটার জন্য কী প্রয়োজন, তা সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। যদি তা না হয়, তবে দেখবেন সামাজিক সূচকগুলো পড়ে যাচ্ছে। আগামীর জন্য এটা হবে বড় বিপদ।

বাংলা ট্রিবিউন: ব্র্যাক এখন অনেক বেশি গবেষণা কিংবা কাগজ-কলমের কাজে মনোযোগ বেশি দিচ্ছে কি?

আসিফ সালেহ: আমরা গবেষণা বাড়িয়েছি। কিন্তু সেটা আগেও হতো। আমরা প্রকাশ করতাম না। প্রত্যেকটা কাজের পেছনেই বড় গবেষণা ছিল। এখন আমরা চেষ্টা করছি আমাদের এই তথ্যজ্ঞান সীমাবদ্ধ না থাকুক। কথা বলাটাও কাজের অংশ। মাঠে একই গতিতে কাজ হচ্ছে।

বাংলা ট্রিবিউন: কর্মী নিয়োগে ব্র্যাক কোন কোন দিক বিবেচনা করে?

আসিফ সালেহ: মাঠের কাজ হলে কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করার সক্ষমতা থাকতে হবে। বিশেষ কিছু দক্ষতা ও জানার আগ্রহ আছে কিনা, দেশের প্রতি টান আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করা হয়। ঢাকার অফিসে ব্যবস্থাপকের সংখ্যা বেশি। তারা দাতা সংস্থা ও সরকারের সঙ্গে কাজ করে। এখানে ভিন্ন ধরনের দক্ষতার দরকার হয়। আমরা প্রতিবছর সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে থাকি। সেখানে দক্ষতার চেয়েও বেশি দেখা হয় সে মানুষের সঙ্গে কাজ করতে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। সমস্যা দিয়ে সমাধান করতে দেওয়া হয়। কে কীভাবে সমাধান করছে সেটাও দেখা হয়। এগুলো ইন্টারভিউ দিয়ে বের করা সম্ভব নয়। বাকিটা আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে নিই। তবে ব্যক্তির আচরণ ও মনোভাব সহজে বদলানো যায় না, সেটাও খেয়াল করা হয়।

বাংলা ট্রিবিউন: ব্র্যাককে আগামী দিনে কোথায় দেখতে চান? সামনের চ্যালেঞ্জগুলো কী?

আসিফ সালেহ: প্রথমত, জলবায়ুর পরিবর্তন। এর কারণে সামনে নানা দুর্যোগ বাড়বে। এরপর আছে নগরায়ণ। এখানে পরিকল্পনার দারুণ সংকট। দরিদ্র মানুষের কথা না ভেবেই সব করা হচ্ছে না। তৃতীয়ত, তরুণদের কর্মসংস্থান। এ শতাব্দীর উপযোগী করে তাদের গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জও আছে। তারা প্রত্যেকে যেন নিজেদের পরিবর্তনের কাণ্ডারি করে গড়ে তুলতে পারে।

ব্র্যাককে আমরা তরুণদের প্রিয় সংগঠনে পরিণত করতে চাই। যেটা তরুণদের কথা বলবে, তাদের মতো করে চিন্তা করে কাজ করার প্ল্যাটফর্ম দেবে। শেষটা হলো, নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম

/এফএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে