X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুশতাকের মৃত্যু, কিশোরের ওপর অত্যাচার ও কিছু প্রশ্ন

রুমিন ফারহানা
০৬ মার্চ ২০২১, ১৪:৩১আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২১, ১৪:৩৪

রুমিন ফারহানা লেখক মুশতাকের মৃত্যু এবং কার্টুনিস্ট কিশোরের দীর্ঘ কারাবাসের পর নতুন করে আবার আলোচনায় এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, এর বিভিন্ন ধারা, তাদের অস্পষ্টতা, অজামিনযোগ্যতাসহ আরও নানা কিছু। আইনটি কত কালো, কতটা নিপীড়নমূলক সে আলোচনা উঠে এসেছে বারবার– এসেছে কলামে, সাক্ষাৎকারে, সভা-সমাবেশে, টকশো’র টেবিলে। সাম্প্রতিক ঘটনার পর প্রাথমিক পর্যায়ে আইনটির ব্যাপারে সরকারের মনোভাব ছিল অনমনীয়। সরকারের সকল পর্যায় থেকে একযোগে দাবি করা হয়েছিল আইনে কোনও সমস্যা নেই, এমনকি পৃথিবীর বহু উন্নত, আধুনিক রাষ্ট্রেও এই ধরনের আইন আছে। চাপ বাড়তে থাকলে অবশ্য সরকার স্বীকার করে আইনটির কিছু সমস্যার কথা যা তাদের মতে বিধি প্রণয়নের মাধ্যমেই সমাধান করা যাবে। পরবর্তীতে ওইসিডি দেশগুলোর ১৩ রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ।

শুরুতেই বলে রাখি আমার আজকের লিখার বিষয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা এর ধারাগুলোর সমালোচনা নয়। যে আইনের ব্যবহারে শতভাগ সম্ভাবনা থাকে অপব্যবহারের, যে আইনের ধারাগুলো সুপরিকল্পিতভাবে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে এর ব্যবহারকারীকে অপব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার জন্যে, যে আইনের অধিকাংশ ধারাই অজামিনযোগ্য যাতে এই আইনে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি কোনোভাবেই জামিনের অধিকার প্রয়োগ করতে না পারে, এবং যে আইনটি করাই হয়েছে সরকারের সকল অপকর্মের রক্ষাকবচ হিসাবে। সেই আইন নিয়ে নতুন করে একই কথা বলা অর্থহীন। 

মুশতাক এবং কিশোরের ঘটনা আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে আরও কিছু বিষয় যেগুলো এ রাষ্ট্রে ক্রমাগত ঘটতে থাকায় ক্রমশ গা সওয়া হতে হতে আলোচনার বাইরেই থেকে যায়–

১. ঘটনার শুরু থেকেই বলা হচ্ছে মুশতাকের মৃত্যু স্বাভাবিক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিও বলেছে মৃত্যুটি স্বাভাবিক। ৫ ফেব্রুয়ারি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত কিশোরের জবানবন্দি থেকে দেখা যায় আটক হয়ে মুশতাকের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার পর কিশোর জানতে পারেন মুশতাকের যৌনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। যার প্রচণ্ডতায় মুশতাক পোশাক নষ্ট করে ফেলেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো সেই নোংরা পোশাক পরা অবস্থায়ই মুশতাককে থানায় নিয়ে আসা হয়। থানায় জিজ্ঞাসাবাদে কিশোর  যখন তার ওপরে ঘটা নির্যাতনের কথা বলতে যাচ্ছিল তখন মুশতাক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে চুপ থাকতে। কারণ সেটা বললে নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে পারে। কিশোরের জবানবন্দি পড়লেই বোঝা যায় মুশতাকের উপরে আসলে কী ঘটেছিল। শারীরিক নির্যাতনের সাথে সাথে ছয় ছয় বারের জামিন নাকচ, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়ে দীর্ঘ ১০ মাস কারা প্রকোষ্ঠে বাস, সামনের দিনের অনিশ্চয়তা, স্ত্রীর হঠাৎ মানসিক অসুস্থতা, বাড়িতে থাকা অসুস্থ-বৃদ্ধ মা-বাবার চিন্তা সবকিছু মিলিয়ে মুশতাকের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল সেটি সহজেই অনুমেয়। এসব কিছুর পর কেউ যদি জেলে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়, তবে এটি কোনোভাবেই স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এটা একটা হত্যাকাণ্ড যেটি ঘটিয়েছে সরকার; মুশতাকের ওপর অন্যায়ভাবে তীব্র শারীরিক এবং মানসিক চাপ তৈরি করে। যেহেতু এই মৃত্যু গুম, বিচারবহির্ভূতভাবে গুলিতে হত্যা নয় সেহেতু এটাকে এখন আর হত্যা বলা যাবে না, তাই কি? বর্তমান বাংলাদেশে এটা কি ‘নতুন স্বাভাবিক’?

২. মুশতাক যখন হাই সিকিউরিটি কারাগারে বিনা বিচারে বন্দী, তখন তার ছোট পরিবারের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য তার স্ত্রী এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে মানসিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো হাসপাতালে। মুশতাকের মরদেহ যখন তার বাসায় পৌঁছে, তখন তার স্ত্রীকে মানসিক হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়।

আমরা বিভিন্ন সময় নিবর্তনমূলক আইনে বন্দী ব্যক্তিদের কথা শুনি, গুম বা বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার মানুষদের কথা পড়ি কিংবা রাজনৈতিক মামলায় মাসের পর মাস কারাগারে আটকে থাকা পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তিটির কথা জানি, কিন্তু একবারও কি আমরা বুঝতে চেষ্টা করি, যে এই মানুষদের পরিবারের কী অবস্থা। এর কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় যখন গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের পরিবারগুলোকে নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ কোনও আলোচনা সভায় তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং তাদের পথ চলার কিছু ধারণা আমাদের দেন। আমরা কক্সবাজারে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার একরামুলের গুলির শব্দে কেঁপে উঠি, কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি সেই গুলির শব্দ বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা তার পরিবার কেমন আছে? কীভাবে বেঁচে আছে? মুশতাক বা একরামুলের মৃত্যু কেবল একটি ব্যক্তির মৃত্যু উপাখ্যান নয়, তাদের এই মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে আছে তাদের পরিবারের নাম না জানা আরও কিছু মানুষের গল্প, যা কোনোদিন আমাদের সামনে আসে না।

৩. আইনের খুব বেসিক কথা হচ্ছে উপযুক্ত আদালত দ্বারা যতক্ষণ কেউ দোষী সাব্যস্ত না হন, ততক্ষণ তিনি নিরপরাধ। তদন্ত বা মামলা চলাকালীন সময়ে আটক কোনও ব্যক্তি যদি পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই সময় ফিরিয়ে দেবে কে? আর সে কারণেই কোনও দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে সাজা নিশ্চিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ জামিনের সুবিধা পায়। অথচ এই মামলায় দশ মাস কারাগারে থেকে ছয়বার তাদের জামিনের আবেদন নাকচ হয়। অবশেষে কিশোর অবশ্য জামিন পান, তবে তারই ভাষ্যমতে এই জামিনটি ছিল তার জন্য বেদনার। কারণ তাকে শুনতে হয়েছে তার এই জামিনটি দাঁড়িয়ে আছে তার সুহৃদ মুশতাকের মৃত্যুর ওপর, যা কখনোই চাননি তিনি।

৪. এ দেশে বর্তমানে কারাগারে সবচেয়ে আরাম আয়েশে থাকে তারাই যারা কোনও না কোনোভাবে সরকারি দলের সাথে যুক্ত এবং কোনোভাবেই সরকারের সমালোচক নন এবং প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক। আমরা নিকট অতীতে দেখেছি তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের নামে জনগণকে আইওয়াশ দেওয়ার জন্য সরকারি দলের কিছু লোকজনকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে আলোচিত দুই জন সম্রাট এবং জি কে শামীম এবং কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী আমিন হুদা মাসের পর মাস হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে কাটিয়েছে কোনোরকম শারীরিক অসুস্থতা ছাড়াই।

ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনে কিশোরের কানের পর্দা ফেটে তাতে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল। সেই ইনফেকশন এতই খারাপ পর্যায়ে গিয়েছিল যে, ডেইলি স্টার পত্রিকার সাংবাদিককে বলা প্রথম কথা ছিল ‘আমার কাছে এলে পাবেন পুঁজের দুর্গন্ধ’। এ ছাড়াও নির্যাতনে পায়ে তৈরি হওয়া ক্ষত খারাপের দিকে গেছে কারণ কারাগারে চিকিৎসার অভাবে তার স্বল্প মাত্রার ডায়াবেটিস অনেক খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। আর সবকিছু বাদ দেই, শুধুমাত্র এই অসুস্থতাই ছিল কিশোরের জামিন পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আলোচনার খাতিরে যদি ধরেও নেই তার জামিন পাওয়ার কথা না, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায় এত বড় অসুস্থতার জন্য কিশোর কি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারতেন না চিকিৎসার জন্য? আচ্ছা ভীষণ অসুস্থ কিশোরের চোখে কি ভেসে উঠেছিল কুখ্যাত অপরাধী সম্রাট-শামীম-হুদা দের মুখ? তখন কেমন লেগেছিল তার?

৫. কিশোরের মূল অপরাধ ছিল কার্টুন আঁকা। কিশোর যখন ‘অজ্ঞাত’ স্থানে আটক হয়ে জিজ্ঞাসবাদ এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন তখন তাকে একটা প্রজেকটরে তার কার্টুন দেখিয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হচ্ছিল, তিনি সেটা দিয়ে কী বোঝাচ্ছেন। নির্যাতনের মধ্যে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় কেন তিনি ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকেন?

ভাবতে অবাক লাগে, কার্টুন আঁকা এই দেশে এখন মস্ত এক অপরাধ। অথচ বিএনপির সর্বশেষ সরকারটির সময়ে (২০০১ – ২০০৬) দেশের প্রায় সব পত্রিকা, বিশেষ করে প্রথম আলো’র প্রথম পাতায় সরকারের মন্ত্রী তো বটেই প্রধানমন্ত্রীর ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ করতো নিয়মিতভাবে। কী অদ্ভুত কবরের নিস্তব্ধতা এখন চারপাশে, কী ভয়ানক অসহিষ্ণুতা।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার নতুন দেখছি না আমরা। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন বলছে সিজিএস এর এক সমীক্ষার ফল অনুযায়ী ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই আইনে মামলা হয়েছে ৭৮৩টি, যার মধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলাই সবচেয়ে বেশি। এই আইন হয়তো এখন সংশোধিত হবে, কিন্তু সরকার যখন কোনও আইনকে অস্ত্র হিসেবে বা সমালোচনার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহার করতে চায় তখন সেই পরিবর্তন নিয়ে কতটা আশাবাদী হওয়া যায় সেটি একটা বড় প্রশ্ন। একজন নাগরিকের ওপর রাষ্ট্রের অবিচার কেবল তার ওপর আঘাত নয়, এটি পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থার মর্মমূলে আঘাত করে যার প্রভাব সুদুরপ্রসারি। যতদিন রাষ্ট্র হবে নিপীড়নমূলক ততদিন একটি আইন, তার প্রয়োগ, অপপ্রয়োগ  কিংবা সংশোধন নিয়ে আলোচনা খুব বেশি ফল দেবে বলে মনে হয় না।            

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

 

      

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
টাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগটাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কোন পদে লড়ছেন কে
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কোন পদে লড়ছেন কে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ