X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
স্মরণে জানে আলম

৭২ সালের এক ঘোরলাগা সন্ধ্যায় আমাদের পরিচয়...

ফেরদৌস ওয়াহিদ, পপ তারকা
০৩ মার্চ ২০২১, ১২:৩৮আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২১, ২২:৩২

সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত বাংলাদেশে যখন যে যার মতো গাইবার চেষ্টা করছিলাম, ১৯৭২ সালের তেমনই এক ঘোরলাগা সন্ধ্যায় আমাদের পরিচয়। কারণ, আমরা তো মূলত একই পথের পথিক। আমাদের রক্তে বইছিল তখন পপ গানের স্রোত। অথচ ‘আমাদের’ জন্ম, গ্রাম, শিক্ষা, বেড়ে ওঠা পুরো আলাদা আবহে।

এখানে আমি ‘আমাদের’ বলতে বোঝাচ্ছি, ফিরোজ সাঁই, আজম খান, আমি (ফেরদৌস ওয়াহিদ), জানে আলম আর ফকির আলমগীরের কথা। মানে যাদের সবাই বলে থাকেন বাংলা পপ গানের স্রষ্টা ও প্রচারক হিসেবে। এটা তো সত্যি, আমরা এই ক’জনই তখন সময় ও স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছি গান দিয়ে। যেটি শেষে দাঁড়ালো পপ গানে।

বলতে চাইছি, এই পাঁচ পপ শিল্পীর মধ্যে জনপ্রিয়তা, যোগ্যতা ও ভাগ্য- কারও কম কারও বেশি। এটা তো স্বাভাবিক না? ফিরোজ সাঁই তো গাইতে গাইতে সেই কবে মারাই গেলো। গানের ফসল আর ঘুরে তুলতে পারলো না। আজম খানকে আমরা পপ গানের মুকুট বলি। এটাও একদম সত্যি। কিন্তু জানে আলমকে তো নাকচ করার সুযোগ নেই। সেও কম জনপ্রিয় ও যোগ্য নন। আমি নিজে তার অসংখ্য স্টেজ শো দেখেছি। তার জনপ্রিয়তাও বাঁধ ভাঙা। হতে পারে সুপারস্টার খ্যাতিটা জানে আলম পাননি। কারণ, তার পুরো জীবনটাই কেটেছে ডাউন টু আর্থ ওয়েতে। অথচ এই মানুষটাই করোনায় বিছানায় পড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত গানের জন্য কাজ করে গেছেন নিরন্তর। শুরু থেকেই নিজে যেমন গাইতেন, তেমনি অন্যদের গাওয়ানোর জন্য হাসিমুখে জীবন দিয়ে দিতেন।

বলে রাখি, ভুলে যাবো। জানে আলমের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ৭২ সালের এক সন্ধ্যায় একটি স্টেজ শোর মাধ্যমে। যে শোয়ের আয়োজক জানে আলম, পারফর্মার আমি আর ফিরোজ সাঁই। শো ছিল জামালপুর সুগারমিলে, সম্ভবত। সেই থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব-সখ্য। বয়সে আমরা একেবারেই সমসাময়িক; ৬৮ রানিং। অথচ আমাদের সম্পর্কটা ছিল অন্য উচ্চতার। দেখা হলে একে অপরের প্রতি সম্মান, স্নেহ ও বিশ্বাসের কমতি হতো না।

‘‌একটি গন্ধমের লাগিয়া’-খ্যাত শিল্পী জানে আলম আর নেই

জানে আলম শুরু থেকেই গাওয়ার পাশাপাশি অনুষ্ঠান আয়োজন এবং গান তৈরি ও প্রকাশের কাজটি করতো। মানে সংগীতের বাইরে তার মাথায় আর কিছু ঘুরতো না। অনেকে বলবেন, শো আয়োজক আর প্রযোজকরা হচ্ছে টাকার খনি! এটা একেবারে বাজে ও ভুল কথা। তখনকার আয়োজক আর প্রযোজকরা ছিল আমাদের মতো শিল্পীদের জন্য আশীর্বাদের মতো। আমি মনে করি, এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে এরকম হাতে গোনা কয়েকজন আয়োজক-প্রযোজকের উদয়-অস্ত শ্রমের বিনিময়ে। কারণ, তখন তো এই লাইনে টাকা বলতে কিছু ছিলে না। জানে আলম দিনের পর দিন আমাদের নিয়ে নানা প্রান্তে শো আয়োজন করতো। নিজেও গাইতো। শো শেষে আমাদের খুশি করার জন্য সর্বোচ্চ ৫শ’ টাকা তুলে দিতো। তার জন্য হয়তো সর্বোচ্চ ৫০ বা ১শ’ টাকা বাঁচতো। তাতেই আলম খুশি। কারণ, সে আসলে গানের সঙ্গটা উপভোগ করতো, অর্থ নয়। সফল শো আয়োজন করেছে, শ্রোতারা হাত তালি দিয়েছে, তাতেই তার আনন্দ।

ফলে এই মানুষটাকে অবমূল্যায়নের সুযোগ নেই। সে হয়তো সুপারস্টার উপাধি পায়নি। কিন্তু সংগীতে তার অবদান তো আমার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। বরং বেশি। সে গেয়েছে, সুর করেছে, লিখেছে, প্রকাশ করেছে। অসংখ্য শিল্পীকে জীবন দিয়েছে। আজীবন এই কাজগুলোই করেছে। ফলে মৃত্যুর পরেও রাষ্ট্রীয় ও সাংগঠনিকভাবে জানে আলমের সাংস্কৃতিক মূল্যায়নের সুযোগ রয়ে গেছে।

প্রিয় জানে আলম, আমরা তো একই সময়ের একই পথের যোদ্ধা ছিলাম। আমি এখন গ্রামের বাড়ি থাকি। শহর আর আমাকে টানে না। কিছু দিন আগেও হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ফিরলাম। গতকাল রাত ১০টার দিকে যখন ফোনে জানতে পারলাম ফিরোজ সাঁই ও আজম খানের কাছে আপনিও চলে গেলেন, বুকটা ভেঙে গেল। নিজেকে আরও একা মনে হলো। আমারও বুঝি যাওয়ার সময় হলো।

অনুলিখন: মাহমুদ মানজুর

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম