X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে কি শিশু-কিশোররা আছে?

রুমিন ফারহানা
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:২৭আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:২৭

রুমিন ফারহানা ২০২০ সাল যে বীভৎসতা পৃথিবীর বুকে নিয়ে এসেছিল, তার অনেকটাই কেটে যেতে শুরু করেছে ২০২১ এর শুরুতে। এই লেখা যখন লিখছি তখন গত এক বছরে সারা পৃথিবীজুড়ে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ৩২ লাখের বেশি আর মৃত্যুবরণ করেছে ২৫ লাখ ১১ হাজার জন। পরীক্ষার অপ্রতুলতা, চিকিৎসা ব্যবস্থায় চরম অব্যবস্থাপনা, মানুষের অসচেতনতা, সব মিলিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো। জীবন-জীবিকার টানাপোড়েনে বাংলাদেশে কখনোই সত্যিকার অর্থে লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি, যদিও পাশের দেশ ভারতে দীর্ঘ সময় কার্যকরভাবে লকডাউন ব্যবস্থা জারি ছিল। এমনকি বাংলাদেশে যেখানে পরীক্ষার হার ছিল প্রতি দশ লক্ষে ২৪ হাজার সেখানে ভারতে এই সংখ্যা হলো ১ লক্ষ ৫৩ হাজার। সুখবর হলো বাংলাদেশের আক্রান্তের হার কখনোই ২৩/২৪ শতাংশের উপরে ওঠেনি। আর সরকারি ভাষ্যমতে গত এক মাস ধরে বাংলাদেশে আক্রান্তের হার ৫ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী বাংলাদেশের করোনা এই মুহূর্তে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।

করোনা জ্বরে যখন পুরো পৃথিবী পুড়ছে বিশ্বজুড়ে চলছে লকডাউন, সেই সময়ে, ২০২০ সালের আগস্ট মাস থেকেই জীবিকার ‘ধোয়া’ তুলে বাংলাদেশে খুলে দেওয়া হয়েছিল অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু। খোলেনি কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যুক্তি ছিল কোমলমতি শিশু-কিশোরদের কোনোভাবেই ঝুঁকিতে না ফেলা। আমি সেই সময়ের কথা বলছি যখন করোনা আক্রান্তের হার ছিল ২০ শতাংশের বেশি। বিস্ময়কর বিষয় হলো আজকে যখন করোনার হার নেমে এসেছে ৫ শতাংশের নিচে তখনও বন্ধ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। অবস্থা শেষমেশ এমন দাঁড়িয়েছে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহীসহ সারাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে জোরপূর্বক হলগুলোতে উঠে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত সাতটি কলেজের পরীক্ষা হঠাৎ করেই স্থগিত করা হয়েছে, যার জেরে শিক্ষার্থীরা ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করে আন্দোলন করেছে। এমনকি গার্হ্যস্থ অর্থনীতি কলেজের মেয়েরাও পরীক্ষা দেওয়ার দাবিতে পথে নেমে এসেছে।

আমরা জানি, করোনার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় বয়স্ক মানুষ এবং যাদের কো-মর্বিডিটি আছে তাদের। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকলেই এই দুই শ্রেণির বাইরে। এদের করোনা হওয়ার ঝুঁকি খুব কম আর যদি হয়ও সেটা তাদের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করবে না, এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। দেশে যেহেতু টিকাও চলে এসেছে, সেহেতু আর সব পেশায় যুক্ত মানুষের মতই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিজেদের সুরক্ষিত করে ফেলতে পারেন। তাছাড়া কেবলমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া ছাড়া এর সঙ্গে যুক্ত সকলেরই স্বাভাবিক জীবনধারা অব্যাহত আছে। তাই করোনার ঝুঁকি তৈরির কথা যদি হয়েই থাকে তাহলে তার জন্য অফিস, আদালত, হাট, বাজার সব কিছু চালু থাকা বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নতুন কোনও মাত্রা যোগ করে না কোনোভাবেই।    

আমাদের শিক্ষার মান গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাবনমনের দিকে। গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে আমাদের অবস্থান ১৩৮ টি দেশের মধ্যে ১১২ তম, যা এই দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। আর টাইমস হায়ার এডুকেশনের সর্বশেষ সূচক বলছে, বিশ্বের সেরা ১৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আছে কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১০০০ থেকে ১৪০০ এর মধ্যে। অথচ এই তালিকায় ভারতের ৫৬ টি, পাকিস্তানের ১৪ টি, মালয়েশিয়ার ১৩ টি, শ্রীলংকার দুইটি ও নেপালের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আছে। এই সরকারের সময় আমরা দেখেছি নকলের মহামারি, প্রশ্ন ফাঁসের মহোৎসব, পরীক্ষায় ভালো ফল দেখানোর জন্য পরীক্ষার খাতায় ঢালাওভাবে বেশি নম্বর দেওয়া, যার প্রতিফলন ঘটেছে এইসব সূচকে। এবার করোনাকালে যুক্ত হলো অটোপাস অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার যাবতীয় আয়োজন গত ১২ বছরে সুসম্পন্ন করেছে বর্তমান সরকার।   

যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব সূচকে ১০০০ এর মধ্যেও আসতে পারে না, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ নিয়েও ভরতির সুযোগ দূরে থাকুক ন্যূনতম পাস নম্বরও পাচ্ছে না অধিকাংশ শিক্ষার্থী। কী ভয়ঙ্কর অবস্থা, তাই না? আরেক গবেষণায় দেখা গেছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করা শিক্ষার্থীদের ৬৫ শতাংশ বাংলাও পড়তে পারে না। এই দুইটি পরিসংখ্যান আমাদের কাছে স্পষ্ট করে, এই দেশে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার নামে কী চলছে। আর শিক্ষার এই হাল নিয়ে বাংলাদেশ তৈরি হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলার জন্যে!

স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা, কোচিং সবকিছুর পর এই যদি হয় শিক্ষার হাল, তখন গত এক বছরের সবকিছু বন্ধ থাকা আর অটোপাসের ফল কী হবে সেটা খুব সহজে অনুমেয়। অবাক কাণ্ড এই দেশেই গত বছর আগস্ট মাস থেকেই নিয়োমিতভাবে খুলে দেওয়া হয়েছিল কাওমি মাদ্রাসা যেখানে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ লাখ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। সেখানে করোনা কোনোরকম কোনও সমস্যা তৈরি করেছে বলে জানা যায় না। কাওমি মাদ্রাসাগুলোতে যেভাবে স্বল্প জায়গায় অনেক সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে তাতে করোনার যে স্বাভাবিক চরিত্র তাতে এই এক ক্ষেত্রেই বহু মানুষের আক্রান্ত হওয়ার কথা। বাস্তবে কিন্তু তেমনটি দেখা যায়নি। আর এখনতো পুরো দেশেই সংক্রমণ আর মৃত্যুর হার অনেক কমে এসেছে। সুতরাং এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, পরীক্ষা না নিয়ে অটোপাস চালু করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খুলে না দেওয়া স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন তৈরি করে, করোনা কি কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আছে? নাকি অন্য কোনও আশংকা থেকে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখেছে? 

কেবল মাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার এই আজগুবি সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন প্রভাব ফেলছে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মানে তেমনই দীর্ঘ সময় শিশু, কিশোর, তরুণদের তাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে সরিয়ে রেখে তার একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া রেখে যাচ্ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর। সরকার বলছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও বহু জায়গায় ক্লাস চলছে অনলাইন মাধ্যমে। ক্রনি ক্যাপিটালিজমে বিশ্বাসী সরকার এভাবে ভাববে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ দেশের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র পরিবারের শিশুদের হাতে স্মার্টফোন কিংবা ডাটার সুবিধা নেই। তাদের কাছে স্মার্টফোন কিনে ডাটা ব্যবহার করে ডিজিটাল ক্লাস করা একেবারেই আকাশ কুসুম একটা কল্পনা। ‘ডিজিটাল ডিভাইড’  শব্দযুগল এই করোনাকালীন সময়ে অনেক বেশি উচ্চারিত। আফসোসের ব্যাপার বাংলাদেশ হচ্ছে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ অর্থাৎ ডিজিটাল মাধ্যমে প্রবেশগম্যতাজনিত বৈষ্যমের সবচাইতে শক্তিশালী উদাহরণ। তাছাড়া যারা স্মার্টফোন কিংবা ডাটা ব্যবহারের সামর্থ্য রাখেন তাদের পক্ষেও ডাটার যে গতি তাতে ঠিক ভাবে ক্লাস করা অসম্ভব। কয়েক মাস আগে ওকলা’স স্পিড টেস্ট এ দেখা গেছে মোবাইল ডাটা স্পিডে ১৩৩ তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শুধুমাত্র আফগানিস্তানের আগে আছে।

এছাড়াও সরকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার তুঘলকি সিদ্ধান্তের চরম মাশুল দিয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নন-এমপিও ভুক্ত স্কুল, কলেজ, প্রাথমিক ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা। করোনার সময় ছাড়াও স্বাভাবিক সময়ে তাদের জীবনযাপন অতি কষ্টকর। ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন থেকে স্কুল-কলেজ পরিচালনার খরচ মেটানোর পর তাদের যে বেতন দেওয়া হয়, সেটার পরিমাণ বর্তমান বাজারে খুবই অপ্রতুল। আর করোনা তো সবার জীবনেই এক চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। তাদের অনেকের বেতন বন্ধ, এমনকি চাকুরিচ্যুতও করা হয়েছে অনেককে। এই সময়েই বহু স্কুল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে, এমনকি অনেক স্কুল/কিন্ডারগার্টেনের মালিকানা হস্তান্তরের বিজ্ঞাপন দেখেছি আমরা। এই করোনার সময়ই উপায়ান্তর না দেখে অসংখ্য শিক্ষক পেটের দায়ে কৃষিকাজ করছেন, ভ্যান চালাচ্ছেন, ইজি বাইক চালাচ্ছেন, ফল ও সবজি বিক্রি করছেন। এই সবই গণমাধ্যমের খবর। করোনার এই এক বছরে সরকার নন-এমপিও শিক্ষকদের এককালীন অনুদান হিসাবে যে ৫০০০ টাকা আর কর্মচারীদের আড়াই হাজার টাকা দিয়েছে তা একেবারেই অপ্রতুল। এই সামান্য সাহায্যও তাদের হাতে যথাযথ ভাবে পৌঁছেছে কিনা সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।

করোনা তার ভয়াল থাবার ছাপ রেখে গেছে সর্বত্র। কিন্তু তারপরও মানুষ উঠে দাঁড়ায়, ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, জীবন থেমে থাকে না কিছুতেই। করোনার সময়ে এই দেশে কখনও কঠোর লকডাউন ছিল না। নামকাওয়াস্তে সাধারণ ছুটির সময়ও মোটামুটি সবকিছুই চলেছে। আর তারপর থেকে তো সবকিছু খোলাই আছে। যতই বলা হোক নো মাস্ক নো সার্ভিস, সেই নির্দেশনাও মানছে না কেউই। তাই প্রবল বিস্ময় নিয়ে বারবারই প্রশ্ন জাগে ‘ কেবলমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ কেন?’ যার সাথে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের ভাগ্য জড়িত।      

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

    

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ