X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘ক্রিকেটীয় দেশপ্রেম’

ডা. জাহেদ উর রহমান
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:৪৮আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:৪৮

ডা. জাহেদ উর রহমান সাকিব আল হাসানের ‘মুণ্ডুপাত’ চলছে সামাজিক মিডিয়ায়—তার দেশপ্রেমের অভাব নিয়ে। খেলা দেখি না, এমনকি বাংলাদেশেরও না, অনেক দিন হয়ে গেলো। কিন্তু পত্রিকায় আসা খবর চোখে পড়ে। তাতেই দেখলাম, সাকিব আল হাসান আইপিএলে খেলার জন্য বাংলাদেশ দলের শ্রীলঙ্কা সফরে টেস্ট না খেলার অনুমতি চেয়েছেন বোর্ডের কাছে। মঞ্জুর হয়েছে সেটা এবং বোর্ড জানিয়েছে আইপিএলের নিলামে বিক্রি হওয়া আরেক খেলোয়াড় মুস্তাফিজ‌ও চাইলে দেশের হয়ে না খেলতে পারেন আইপিএলে।

সাকিবের এই অনুমতি চাওয়া নিয়ে ‘বিরক্ত’ হয়েছে বোর্ড। বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন চেয়ারম্যান আকরাম খান তার উষ্মা পুরোপুরি লুকাতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সাকিব আমাদের চিঠি দিয়েছে, সে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে খেলতে চায় না। আমরা মিটিং করেছি, অনেক আলোচনা হয়েছে এটা নিয়ে। লম্বা মিটিং হয়েছে। বোর্ড আগেও নানা সময়ে নানাজনকে ছুটি দিয়েছে। তবে জাতীয় দলের খেলার সময় সাধারণত আমরা দিতে চাই না ছুটি। কিন্তু আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে, জোর করে কাউকে বাংলাদেশ দলে খেলানো হবে না।’

সাকিব কেন দেশের হয়ে না খেলে টাকার পেছনে ছুটে আইপিএল খেলতে চাইছেন, সেটা নিয়ে ভীষণ সমালোচনা করছেন নেটিজেনরা। তাহলে তো খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানেও আসে সাকিব কি দেশের জন্য খেলছেন টাকা ছাড়া? শুধু জাতীয় দলের খেলেও যে বিপুল পরিমাণ উপার্জন করা যায় সেটা বাদ দিলে কেউ কি খেলতে চাইতেন দেশের হয়ে? একজন আপাদমস্তক পেশাদার খেলোয়াড় বেশি উপার্জনের দিকে যেতে চাওয়া কি অন্যায়, অনৈতিক?

আমি খুব ভালোভাবেই জানি, অনেকেই বলবেন দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে তিনি কেন টাকার কম্প্রোমাইজ করে শ্রীলংকা সফরে টেস্ট খেলছেন না? দেশকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসলে সাকিব এটুকু ছাড় দিতেই পারতেন, আসতে পারে এ‌ কথাও।

আইপিএল না থাকলে সাকিব নিশ্চয়ই মুখিয়ে থাকতেন জাতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য। যখন আইপিএল, অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ ‌ছিল না, তখনও তো বিভিন্ন দেশের (বিশেষত এই উপমহাদেশের) জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলার জন্য তরুণরা পাগল হয়ে থাকতেন। আচ্ছা শুধু জাতীয় দলের হয়েও ক্রিকেট খেলে যদি অনেক টাকা উপার্জন করা (পারিশ্রমিক এবং বিজ্ঞাপনসহ অন্যান্য খাত থেকে) না যেত, তাহলে ক্রিকেটার হওয়ার জন্য কি কিশোর-তরুণরা মুখিয়ে থাকতো?

জাতীয় দলে না খেলে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলার জন্য জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে নিয়েছেন এমন তথ্য আমরা পত্রিকায় দেখেছি। এর সঙ্গে দেশপ্রেমের কোন‌ও সম্পর্ক নেই, আছে হিসাব-নিকাশের। ফ্রাঞ্চাইজি লীগগুলো খেলোয়াড়দের সামনে ‘অপরচুনিটি কস্ট’ হিসাব করার একটা সুযোগ তৈরি করেছে।‌ পেশাদার খেলোয়াড়রা সেটা করছেন; সেটাই করার কথা।

খেলা মানুষের কাছে নিছক বিনোদন হয়ে থাকলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হলো সারা পৃথিবীতে খেলা এখন এক বিরাট বাণিজ্য। তাই খেলাকে ভিত্তি করে এর বিক্রেতারা নানা রকম ইন্টারপ্রিটেশন তৈরি করছে বাজারে। আমাদের এই অঞ্চলে যেহেতু ক্রিকেট‌ই মূল খেলা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে, তাই এখানে (বিশেষ করে বাংলাদেশে) খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইন্টারপ্রিটেশন হলো ক্রিকেট দিয়ে দেশপ্রেমিক হওয়া (পড়ুন, দেশপ্রেমিক সাজা)।

গ্যালারিতে নানা বেশে দেশপ্রেমের পসরা সাজায় দর্শকরা। কেউ গালে আঁকে পতাকা, কেউ মাথায় বাঁধে। কেউ পোশাক পরে পতাকার রঙে, কারও হাতে থাকে পতাকা, আর কেউ তো সারা গায়ে রঙ মেখে বাঘ সাজে।

মিডিয়া তো এসব উসকে দেয়ই, দেয় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও। দীর্ঘকাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলছে বাংলাদেশ কিন্তু এখন‌ও খেলায় দুর্বল জিম্বাবুয়ের সঙ্গে জিতলেও রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীর অভিনন্দন জানানোর হিড়িক পড়ে যায়। ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সামান্য ভাইরাস জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও তাকে দেখতে যান রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানুষরা। সবাই মিলে আমাদের শেখান ‘ক্রিকেটীয় দেশপ্রেম’।

আমাদের এই তথাকথিত দেশপ্রেম আছে, ভীষণভাবে যুদ্ধংদেহীও হয়ে ওঠে। বেশ কয়েক বছর আগে বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে আম্পায়ারের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত, আমাদের দলের হার, জনাব আ হ ম মোস্তফা কামালের কিছু মন্তব্য, তারপর তাকে নিয়ে আইসিসির চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসনের অন্যায় আচরণ, সবকিছু আমাদের দারুণ ক্ষুব্ধ করে। আমাদের দেশের মানুষের ‘দেশপ্রেম’ জেগে ওঠে, তারা ক্ষোভ উগড়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়– ভারতীয়দের সঙ্গে রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ বেঁধে যায় আমাদের দেশের মানুষদের। এমনকি আমাদের দেশের নানা ক্ষেত্রের ‘তারকা’রাও কোমর বেঁধে শামিল হন সেই ‘যুদ্ধে’। করপোরেট হাউজগুলোও নেমে পড়েছিল পাল্টাপাল্টি বিজ্ঞাপন বানানোর প্রতিযোগিতায়।

দেশে এখন‌‌ও যখন কোন‌ও গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়, কিংবা হয় কোন‌ও গুরুত্বপূর্ণ দলের সফর, তখন আমরা দেখি ভোররাতে গিয়ে টিকিট কাটার জন্য তরুণরা ব্যাংকের সামনে লাইন দেয়। এটার ইন্টারপ্রিটেশন অনেকেই এভাবে করেন, নিজের দলের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে আমাদের তরুণরা প্রকারান্তরে নাকি নিজের দেশের পক্ষেই দাঁড়াচ্ছে।

অনেকেই আবার বলেন ক্রিকেটের পেছনে যেহেতু মানুষ দল-মত-শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দাঁড়ায়, তাই এটা নাকি জাতীয় ঐক্য নিশ্চিতে কাজ করবে। সেটা হলে আসলেই খুব ভালো হতো। জাতি হিসেবে ক্রিকেট নিয়ে আমাদের উন্মাদনা প্রতিদিন বাড়ছে, কিন্তু এই জাতি বিভিন্ন ইস্যুতে ক্রমাগত আরও বেশি বিভক্ত হয়ে পড়ছে আগের চাইতেও বেশি। বিভক্তির মাত্রা এত ভয়ংকর পর্যায়ে চলে গেছে যে কোন‌ও বিষয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষের মতামতের প্রতি সহনশীলতা দেখানো দূরে থাকুক, হয়ে উঠছে প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক। না, ক্রিকেটীয় ঐক্য প্রভাব ফেলেনি আর সব অনৈক্যের ক্ষেত্রে।

ক্রিকেটের জন্য রাস্তায় বিজয় মিছিল হবে, কিন্তু দেশের হাজার স্বার্থ নষ্ট হয়ে গেলেও সেটা নিয়ে রাস্তায় নামা দূরেই থাকুক, চায়ের আড্ডায় কথাও হবে না, হবে না সামাজিক মাধ্যমেও। বীভৎস দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে দেশ; রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সব ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে; মাদকে দেশ সয়লাব হয়ে একটা প্রজন্ম ধ্বংসের পথে; ধর্ষণ, হত্যাসহ বীভৎস সব অপরাধ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে-কানাচে; ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ভয়ংকর রকম বৈষম্য তৈরি হয়েছে সমাজে। কই আমাদের বেশিরভাগ তরুণের তো খুব একটা বিকার দেখি না এসব নিয়ে।

কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। এক সভায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, মানব উন্নয়ন সূচকের প্রায় সবক’টিতে অনেক নিচুতে থাকার পরও ভারতের পত্রিকা দেখলে তাঁর অবাক লাগে— ওই দেশে ক্রিকেট আর সিনেমা হল মূল আলোচনার বিষয়; পত্রিকায় থাকে না অতি গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু।

আসলে বাজার চায়, আমাদের এই অঞ্চলের সরকারগুলো চায় মানুষ মেতে থাকুক নানা রকম নেশা নিয়ে— হোক সেটা গাঁজা, ইয়াবা, ফেসবুক, পর্ন বা আপাত ‘নির্দোষ বিনোদন’ ক্রিকেট। এতে তাদের ক্ষমতার আর বাণিজ্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয় না, করে যেতে পারে তাদের যা খুশি তা।

আমরাও এতটা মেরুদণ্ডহীন হয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত যে আমাদের দেশপ্রেম দেখানোর দৌড় এসে ঠেকেছে ক্রিকেটে। এতে খেলার একদিকে যেমন উত্তেজনা পাওয়া যায়, অন্যদিকে দারুণ ভেক ধরা যায় অসাধারণ দেশপ্রেমিকের– কী দারুণ ‘রথ দেখা আর কলা বেচা’। ক্রিকেটেই যেহেতু আমাদের দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ প্রদর্শনী হয়ে যায়, তাই আর সব বিষয়ে দেশপ্রেম দেখানোর কী দরকার?

‘দেশপ্রেমহীন জাতি’ বললে অনেকে হয়তো খুব আহত বা ক্ষুব্ধ হবেন। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমি আমাদের জাতিটিকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে চাই। আমার মনে হয়, সত্যিকারের দেশপ্রেম নেই বলেই এই জাতির প্রয়োজন হয় ‘ক্রিকেটীয় দেশপ্রেমের’।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ