X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ এলো যেভাবে

সাদ্দিফ অভি
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৭:০০আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২০:৪৫

বাংলার মাতৃভাষা তো বাংলাই হবে- এ চেতনার পটভূমি রচিত হয়েছিল ভারত ভাগের আগেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পূর্ববাংলায় শাসকবিরোধী তীব্র মনোভাবের মাঝেই বাংলা ভাষার জন্য জ্বলে ওঠে স্ফূলিঙ্গ। ভাষা সৈনিকরা তাদের লেখনিতে একইভাবে জানিয়েছেন মহান একুশে ফেব্রুয়ারির সূচনার কথা। ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। আর তাই একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের আগেই শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন (ভাষা মতিন) ও আহমেদ রফিক তাদের লেখা ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য বইয়ে উল্লেখ করেছেন- ‘প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ।’ তাদের ভাষ্য– ৪০ দশকের শুরুতেই সাহিত্যিকরা ভাষা নিয়ে কথা বলেছেন। ভারতভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত হওয়ার পর উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন। ততদিনে মুসলিম বাঙালিদের আত্ম-অন্বেষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকিট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষার ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এই ঘোষণায় পর ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

কমিশনের বাঙালি কর্মকর্তারা সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন। পাকিস্তান গঠনের সময় তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে আইন পরিষদের অধিবেশনে বলেছিলেন, ভাষা সম্পর্কিত বিতর্ক শুরু হওয়ার আগেই এসব ছাপা হয়ে গেছে। যদিও তার এই বক্তব্য সবাই গ্রহণ করেনি।

বাঙালির মনে ক্ষোভের অনুভূতি তখন থেকেই দানা বাঁধতে থাকে। সেই সালের শেষের দিকে 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারপরও ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ এক সমাবেশে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে - 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। সমাবেশে উপস্থিত অনেকেই সেখানে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানায়। স্লোগান হয়- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

ভাষা নিয়ে যুবসমাজের মধ্যে তীব্র শাসকবিরোধী মনোভাব আর দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে থেমে থেমে শুরু হয় আন্দোলন। আর তাতে বড় স্ফূলিঙ্গটি দেখা যায় ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখে। ওই দিন পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। রাজনৈতিক এমন অস্থিরতার মধ্যেই ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহর কথারই পুনরাবৃত্তি করেন। সেসময়ও একইভাবে জোরালো প্রতিবাদে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগান ওঠে।

খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদসভা হয়। ৩০ জানুয়ারি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডাকা হয়। ছাত্রদের মুখে মুখে উত্তাপের স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ চলতে থাকে। এরপর ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে সরকারবিরোধী সব দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। যার মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা।

প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে ৩ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিষয়টি হালকা করার চেষ্টা করেন খাজা নাজিমুদ্দিন। সংবাদ সম্মেলনে অবশ্য তিনি মূল বক্তব্য থেকে সরেননি। জিন্নাহর ঢাকা সফরকালীন বক্তৃতার কথা উল্লেখ করে খাজা নাজিমুদ্দিন বলেন তিনি ‘কায়েদে আযমের মতামত উল্লেখ করেছেন মাত্র। কারণ, তিনি কায়েদের নীতিতে দৃঢ়বিশ্বাসী। তবে এ বিষয়ে গণপরিষদই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।’ একইসঙ্গে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এ বিষয়ে যারা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চাইবে, তারাই পাকিস্তানের দুশমন।

সংগ্রাম পরিষদের তৎপরতার অপেক্ষায় না থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটি, যুবলীগ এবং বিভিন্ন কলেজ ইউনিয়নের মতো একাধিক ছাত্র সংগঠন আন্দোলনে নেমে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৪ ফেব্রুয়ারির ছাত্রসভায় ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কর্মসূচির মধ্যে ছিল দেশব্যাপী হরতাল, সভা, শোভাযাত্রা এবং ঢাকায় অ্যাসেম্বলি (আইন পরিষদ) ঘেরাও।

৪ ফেব্রুয়ারি সভা শেষে ১০-১২ হাজার ছাত্রছাত্রীর বিশাল মিছিল রাজপথ ঘুরে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বাসভবন বর্ধমান হাউসের সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’, ‘ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র চলবে না’ ইত্যাদি। ছাত্রসভার এ সিদ্ধান্ত সমর্থন করে এই দিনই সর্বদলীয় পরিষদের সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং মওলানা ভাসানী ওই কর্মসূচি সফল করে তোলার জন্য দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার প্রতি আহ্বান জানান।

একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সফল করার জন্য ঢাকায় বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মতৎপরতা শুরু হওয়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শহরের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগেরও চেষ্টা চলে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই- রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা। এই কাজে মূল ভূমিকায় ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা।

২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি হয়েছিল। ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতা গর্জে উঠে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। মিছিলে চালানো হয়েছিল অতর্কিত গুলি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছেই গুলিবর্ষণ হয়েছিল শিক্ষার্থীদের ওপর।

ভাষা আন্দোলনে ঠিক কতজন শহীদ হয়েছিলেন সেবিষয়ে সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে সেদিন ও পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং শফিউর ছাড়াও আরও অনেকে শহীদ হয়েছিলেন বলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে। এই ঘটনার পর দুই বছরেরও বেশি সময় পরে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সংসদ বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হতে লেগেছিল আরও দুই বছর।

/এফএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
এফএ কাপে হাল্যান্ডকে নিয়ে সংশয়ে সিটি
এফএ কাপে হাল্যান্ডকে নিয়ে সংশয়ে সিটি
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা