X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

উগ্রবাদ ও বাকস্বাধীনতার রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া

আমীন আল রশীদ
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:০৮আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:০৮

আমীন আল রশীদ
ছয় দিনের ব্যবধানে দুটি আলোচিত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হলো, যেখানে ১৩ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। যে ঘটনাগুলোর সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতি ও উগ্রবাদ এবং বাকস্বাধীনতার বিষয় জড়িত। সঙ্গত কারণে জড়িত আইনের শাসনও।  

নিহতদের একজন লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় এবং অন্যজন জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন, যার নিহত হওয়ার পরে তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছিলেন, তিনি সন্তান হত্যার বিচার চান না। কারণ, বিচার পাবেন না। কিন্তু বিচার হয়েছে। রায় ঘোষণার পরে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। উচ্চ আদালতেও যেন এই রায় বহাল থাকে সেই প্রত্যাশার কথাও জানিয়েছেন।

এই দুটি মামলায় যাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে দুটি মামলার অভিন্ন আসামি তিন জন। তারা হলেন সেনাবাহিনীর বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ এবং মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রায়ের আগে ও পরে আদালতে অভিজিৎ হত্যা মামলার আসামিরা ছিল ‘উৎফুল্ল ও উদ্ধত’। শুধু তা-ই নয়, তাদের একজনের দুই আঙুল তুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখানোর ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। ফাঁসির আদেশ শুনেও আসামিরা কী করে হাস্যোজ্জ্বল থাকতে পারে? কয়েকটি কারণ হতে পারে–

১. তাদের হয়তো ধারণা বা বিশ্বাস যে, ফাঁসির রায় হলেও তা কার্যকর হবে না।

২. তারা হয়তো মনে করছে এই রায় উচ্চ আদালত ও সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হতে হতে দেশে সরকার পরিবর্তন হয়ে যাবে অথবা এমন কোনও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটবে, যার ফলে তারা জেল থেকে বেরিয়ে আসবে।

৩. তারা হয়তো বিশ্বাস করে যে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও তারা যেহেতু তাদের কথিত জিহাদের অংশ হিসেবে অভিজিৎ ও দীপনকে হত্যা করেছে, অতএব তারা বেহেশতে যাবে। এর বাইরে আরও কোনও কারণ থাকতে পারে। তবে প্রথম দুটি কারণ সত্যি হলে ধরে নিতে হবে দেশে আইনের শাসন নেই। আর তিন নম্বর কারণটি সত্যি হলে, অর্থাৎ মানুষ খুন করে বেহেশতে যাওয়া যাবে– এমন ভাবনা যদি সত্যিই তাদের মগজে গ্রথিত থাকে তাহলে সেটি প্রথম দুটি কারণের চেয়েও বেশি ভয়ংকর। কারণ, এই ভাবনাটি আর গুটিকয় লোকের মগজেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং মানুষ হত্যা করে বেহেশতে যাওয়া বিষয়ক মগজ ধোলাইয়ের যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তারই একটি বড় প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল ২০১৬ সালের পয়লা জুলাই রাজধানীর হলি আর্টিজান বেকারিতে। এরকম তরুণের সংখ্যা ভেতরে ভেতরে কত– সে পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই।

তাছাড়া মৃত্যুদণ্ডের আদেশ মানেই ফাঁসি কার্যকর নয়। কারণ, আসামি পক্ষ উচ্চ আদালত বা হাইকোর্টে যাবে। সেখানে নিষ্পত্তি হলে থাকবে সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ সর্বোচ্চ আদালতেও যদি মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে, তাহলেই কেবল আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে এবং এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ধরা যাক, সেসব প্রক্রিয়া শেষ করে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে কারণে দীপন ও অভিজিতদের খুন করা হলো; যে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার কারণে তারা খুন হলেন– রাষ্ট্র কি সেই পরিস্থিতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে পেরেছে বা পারছে?

১০ ফেব্রুয়ারি দীপন হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের হত্যার অংশ হিসেবে অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের জন্য জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়। যারা বই প্রকাশের দায়ে মানুষ হত্যা করতে পারে, তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যায় অংশগ্রহণকারীরা বেঁচে থাকলে আনসার আল ইসলামের বিচারের বাইরে থাকা সদস্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহী হবে বলেও আদালত পর্যবেক্ষণ দেন।

এর ছয়দিন পর ১৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণেও বিচারক বলেন, নাস্তিকতার অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা এবং এ মামলার আসামিরাসহ মূল হামলাকারীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে তাকে। স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশের জন্য অভিজিৎ রায়কে নিজের জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়।

যদিও রায় ঘোষণার পর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ইংরেজিতে লেখা পোস্টে প্রতিক্রিয়া জানান অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আহমেদ। তিনি জানান, গত ছয় বছরে এই মামলার তদন্তকারী কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। অথচ তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং হামলার একজন ভিকটিম। বন্যা আহমেদ লিখেছেন, ‘প্রকাশক দীপন হত্যা মামলায় একজন হত্যাকারী জবানবন্দিতে বলেছে, ২০১৫ সালে ব্লগার, প্রকাশক এবং সমকামীদের হত্যা করার জন্য প্রচুর টাকা সরবরাহ করা হয়েছিল। আমি জানতে চাই, এই টাকার তদন্ত কেউ করেছে কিনা? এই রায়ে কী হবে যদি আমরা জানতেই না পারি, টাকা কোথা থেকে এসেছে? অথবা এই হত্যার মূলহোতা কে?’

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে খুন করার মধ্য দিয়ে যে ব্লগার হত্যা শুরু হয়, তারপর একে একে খুন হন অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ ও নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় এবং সবশেষ জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন।

অস্বীকার করার উপায় নেই, ২০১৬ সালের পয়লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে দেশে জঙ্গিবাদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। কারণ, ওই ঘটনার পরে জঙ্গিরা বড় ধরনের কোনও আক্রমণ চালাতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং শীর্ষ জঙ্গি হিসেবে যাদের নাম জানা গিয়েছিল, তাদের প্রায় সকলেই বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। সুতরাং ধর্মীয় উগ্রবাদের বিস্তার ঠেকাতে রাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা দেশের ভেতরে তো বটেই, বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু বাকস্বাধীনতা ও ভিন্নমত কেবল ধর্মীয় ইস্যুতেই নয়। রাজনৈতিক বা সমসাময়িক অন্যান্য ইস্যুতে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা কতটুকু রয়েছে এবং কথা বললে রাষ্ট্রীয়ভাবে এর কী প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়– তার অনেক নজির এরইমধ্যে স্থাপিত হয়েছে।

সুতরাং অভিজিৎ ও দীপন হত্যা মামলার রায় হয়েছে এবং ধরা যাক খুনিদের ফাঁসিও কার্যকর হবে। কিন্তু ধর্মীয় উগ্রবাদ, ধর্মের নামে মানুষ খুন করে বেহেশতে যাওয়ার সহজ অঙ্ক এবং বাকস্বাধীনতার তর্ক শেষ হওয়ার নয়। আর বাকস্বাধীনতা ও ভিন্নমতের প্রশ্ন শুধু ধর্মীয় ইস্যুতেই নয়, বরং রাষ্ট্রও তার নাগরিকদের কতটুকু কথা বলতে দেয় এবং রাষ্ট্রীয় নীতি বা ক্ষমতাবানদের ব্যাপারে কোনও মন্তব্যের পরে কী প্রতিক্রিয়া দেখায়– সেই আলোচনাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অন্তত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এযাবৎ যত লোক ভিকটিম হয়েছে, তাদের কতজন সত্যিই অপরাধী এবং এই আইন যেসব বিষয়কে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে অথবা ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থাকা লোকজন যেভাবে এই আইনটি প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে করে আইনটিকে একটি ‘কালা কানুনে’ পরিণত করেছেন– অভিজিৎ বা দীপনদের বাকস্বাধীনতার পক্ষে কথা বললে এসব বিষয় নিয়ে তর্ক করার পরিবেশও থাকতে হবে। না হলে ধর্মীয় উগ্রবাদের আলোচনার ভিড়ে রাষ্ট্রে অন্যান্য সকল বিষয়ে নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি চাপা পড়ে যাবে।

দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক যে প্রেক্ষাপট বা বাস্তবতায় ‘বিচার চাই না’ বলে খেদ প্রকাশ করেছিলেন, সেই বাস্তবতা কি পাল্টে গেছে? দেশে কি আইনের শাসন নিশ্চিত করা গেছে? সব অপরাধের শাস্তি কি রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে? একই অপরাধে কেউ জেল খাটে অথচ অন্য আরেকজন কি ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে না? বিনা বিচারে বছরের পর বছর ধরে অনেকেই কি জেল খাটছেন না? অসংখ্য মানুষ কি শুধু রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে অন্যায়ভাবে, মিথ্যা মামলায় জেল খাটছেন না? যদি তা-ই হয়, তাহলে শুধু অভিজিৎ বা দীপন হত্যা মামলার বিচার করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো বলে উপসংহারে পৌঁছানোর কোনও কারণ নেই।

লেখক ও ব্লগারদের হত্যার পথটি মূলত রাষ্ট্রই প্রসারিত করে। কারণ, যে দেশে ইন্টারনেটে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সমসাময়িক কোনও বিষয়ে মন্তব্যের কারণেও মানুষকে জেল খাটতে হয়, সেই দেশে কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে খুন করা বড় বিষয় নয়। যদিও যে প্রশ্নটি বহুদিন ধরেই জনমনে রয়েছে তা হলো, কোন বক্তব্যে বা কী কথায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে বা ধর্মীয় অনুভূতির মানদণ্ডই বা কী? এই মানদণ্ড আইনও ঠিক করে দেয়নি। অথচ কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে মানুষ পিটিয়ে মেরে তাকে পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনাও এই দেশে ঘটেছে। সুতরাং একটি দুটি মামলায় অপরাধীদের ফাঁসির দণ্ড হলেই যে ভেতরে ভেতরে দেশের মানুষের চরিত্র বদলে যাবে– সেই আশা করা কঠিন।

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ