X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবিরন হত্যার বিচারে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:৫৫আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:৫৫

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২০০৪ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘Bad Dreams: Exploitation and Abuse of Migrant Workers in Saudi Arabia’। সৌদি আরবে বিদেশি শ্রমিকদের বাঁচার স্বপ্ন কীভাবে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় তার বিস্তারিত বিবরণ আছে এই রিপোর্টে। রিপোর্টে বাংলাদেশের অনেক পুরুষ শ্রমিকের সাক্ষাৎকার আছে। তখন পর্যন্ত নারী শ্রমিক, বিশেষ করে নারী গৃহকর্মীদের বিষয়টি আলোচনায়ই আসেনি।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ থেকে বাংলাদেশের অনেক নারী শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরছেন। অনেকে ফিরছেন সর্বস্ব হারিয়ে, সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে। যারা ফিরে আসেননি, তারাও ফেরার পথ পাওয়ার জন্য মাথা কুটে মরছেন। এই কাহিনিগুলো গত কয়েক বছরের।

সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশের নারী কর্মীদের হত্যা, ধর্ষণসহ ভয়ংকর নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ বহুদিনের। কিন্তু থেমে নেই যাওয়া। বহু সংগঠনের দাবি সত্ত্বেও সরকার সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী গৃহকর্মী পাঠানো আইন করে বন্ধ করছে না। ২০১৮-১৯ সালে একের পর এক নির্যাতনের শিকার নারীর দেশের ফিরে এসে নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা দেখে পুরো জাতি বিমর্ষ হলেও কাজটি সোৎসাহে করে গেছে এবং এখনও করছে জনশক্তি রফতানিকারকরা।

করোনায় আলোচনা থেমে গেলেও বিষয়টি আবার সামনে এলো সৌদি আদালতের এক রায়ে। দেশটিতে কোনও বাংলাদেশিকে হত্যায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো একজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন সেখানকার আদালত। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আদালতের রায়ে বাংলাদেশের গৃহকর্মী আবিরন বেগম হত্যাকাণ্ডে দোষী প্রমাণিত এক সৌদি গৃহকর্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড এবং গৃহকর্তাকে কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়েছে।  

খুলনার পাইকগাছার বাসিন্দা আবিরন বেগম স্থানীয় এক দালালের সহযোগিতায় ঢাকার একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ২০১৭ সালে সৌদি আরবে যান গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে। এরপর ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ রিয়াদের আজিজিয়ায় নিহত হন তিনি। তার মরদেহের ফরেনসিক প্রতিবেদনে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সামনে আসে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিহতের পরিবার, নিয়োগকারী সংস্থা, মন্ত্রণালয়, দূতাবাস সব জায়গায় খোঁজ-খবর নিয়ে ডিসেম্বরে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, সৌদি আরবে যাওয়ার পর থেকেই মধ্যবয়সী আবিরনকে পিটিয়ে,গরম পানিতে ঝলসে এবং আরও নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুপারিশ করা হয়। এরপর নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় আবিরন হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ।

মামলার প্রধান আসামি গৃহকর্ত্রী আয়েশা আল জিজানীর বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত এবং সুনির্দিষ্টভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটনের দায়ে আদালত কেসাস বা ‘জানের বদলে জান’-এর রায় প্রদান করে। সেই মামলায় গৃহকর্তা বাসেম সালেমের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের আলামত ধ্বংস, আবিরন বেগমকে নিজ বাসার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় কাজে পাঠানো ও চিকিৎসার ব্যবস্থা না করার অভিযোগে মোট ৩ বছর ২ মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে তাকে ৫০ হাজার সৌদি রিয়াল জরিমানা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আবিরন বেগম হত্যার বিচার হয়েছে বলেই উৎসাহিত হওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। সুখে থাকা, পরিবারকে সুখে রাখার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় একদম শুরু থেকেই। কাউকে হয়তো হাসপাতালে ক্লিনারের কাজ বা হোটেল কর্মীর কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তারা দেখেন কাজ আসলে একটাই–  বাসায় কাজ করা। আর সেসব বাসা একেকটি নরক।

সৌদি আরবে নারীর কাজের চাহিদা আছে। কিন্তু বেতন ও কাজের বিনিময়ে প্রাপ্য সুবিধার চেয়ে নির্যাতন বেশি। ২০১৫ সালে এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানো শুরু হয়। ২০১৯ সালের হিসাব মতে প্রায় ৯ লাখ বাংলাদেশি নারী সেখানে কাজ করছেন। এই যে এত নারী সেখানে গেলেন, তাদের বড় একটা অংশই আসলে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বেশিরভাগকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের কথা বলে নিয়ে যাওয়ার পর দেখা যায় ৯৯ শতাংশই পরিণত হয় গৃহকর্মীতে।

যে ভয়ংকর নির্যাতনের বর্ণনা আমরা ফিরে আসা নারীদের মুখেও শুনেছি তারপরও সরকার কি করে এ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকে, এখনও কি করে নারী গৃহকর্মীদের সেখানে পাঠানো হয়, সেটা এক বড় প্রশ্ন।

সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার নারীদের বেশিরভাগই নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী থাকেন না। এ কারণে সৌদি সরকার কিংবা সে দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের কিছু করার থাকে না বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার নারী তার নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে কোনও মামলা দায়ের করতে চান না। এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তারা দ্রুত বাড়ি ফিরতে চান। দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চলবে, সে আশঙ্কায় তারা আর সৌদিতে কালক্ষেপণ করতে চান না।

এটাই বাস্তবতা। নরক থেকে বের হয়ে তারা দ্রুতই পরিবারের কাছে ফিরতে চান। সৌদি আরবে যে নারীরা গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হন তাদের প্রটেকশনের জন্য কোনও আইন নেই। ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক আইন অনুযায়ী, কেউ  যদি প্রতারণার শিকার হন, কাজের শর্ত ভঙ্গ হয়, নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে দায়িত্ব হলো রিক্রুটিং এজেন্সির। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সব সময় থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।  

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এই নারীদের বিদেশ গমন আমাদের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাদের শারীরিক-মানসিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে রাষ্ট্র ও তাদের নিয়োগ কর্তৃপক্ষ কখনও গুরুত্ব দিয়ে ভাবেনি। মানবিকতা ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে এমন ঘটনা নিঃসন্দেহে মর্মবেদনার। আবিরনের পরিবার বিচার পেয়েছে– এটা স্বস্তির হলেও সামগ্রিকভাবে আমাদের নারীদের এমন দুরবস্থার দায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল এড়াতে পারে না।

আবিরন বেগম হত্যায় বিচারের খবরে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। বরং আমাদের ভাবা দরকার, বিশেষ করে সেই পরিবারগুলোর কথা, যারা তাদের মেয়েটিকে সৌদি আরব পাঠাতে চান। বিদেশ যাওয়া মানে স্বপ্ন পূরণ নয়। প্রান্তিক মানুষ রুটি রুজির টানে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। কিছুটা ভালো থাকার আশায় সংসার, ছেলেমেয়ে, স্বামী ও আপনজনদের ছেড়ে উচ্চ সুদে ধারের টাকায় এই নারীরা যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তারা ভালো নেই। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী জায়গা থেকে ভাবা দরকার, সৌদি আরবে সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার ধরে রাখতে আমাদের দরিদ্র পরিবারের নারীরা নিশ্চয়ই কোনও বিনিময়যোগ্য উপাদান নয়।    

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ