X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাইক সন্ত্রাস, গণউপদ্রব ও পুলিশের অভিযান

আমীন আল রশীদ
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:৫১আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:৫১

আমীন আল রশীদ
রাজধানীর মতিঝিল এজিবি কলোনিতে বাইক সন্ত্রাসের শিকার হয়ে গণপূর্ত বিভাগের হিসাব সহকারী রুনা আক্তারের নিহত হওয়ার ঘটনাটি হয়তো আপনার মনে আছে। ডজনখানেক কিশোর-তরুণের এক একটি দল—মোটরবাইক যাদের বাহন; মতিঝিলের এজিবি কলোনি ঘিরে ছিল তাদের ত্রাসের রাজত্ব। এদেরই একটি দলের বখাটেপনায় প্রাণ যায় রুনা আক্তারের। ঘটনার পরে মামলা হয়েছিল। কিন্তু উল্টো মামলা তুলে নিতে পরিবারের ওপর চাপ তৈরি হয়। সেই মামলাটির এখন কী অবস্থা; অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে কিনা এবং রুনা আক্তারের পরিবার এখন কেমন আছেন—তা নিয়ে অনুসন্ধান হতে পারে।

তবে শুধু এই এজিবি কলোনিই নয়; রাজধানীসহ সারা দেশেই কিশোর-তরুণদের মোটরসাইকেল কেন্দ্রিক এই ‘সন্ত্রাস’ বিদ্যমান এবং সম্প্রতি রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে যে তিন শতাধিক বখাটেকে পুলিশ আটক করেছে, তাদেরও মূল বাহন এই মোটরবাইক—যাদের বিরুদ্ধে হাতিরঝিলে ঘুরতে আসা মানুষজনকে, বিশেষ করে নারীদের নানাভাবে হয়রানির অভিযোগ আছে। এদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে গণউপদ্রব ও অহেতুক হইচই করার অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাকিদের হাতিরঝিল এলাকায় আর আসবে না এবং প্রতি সপ্তাহে একবার হাতিরঝিল থানায় হাজিরা দিতে হবে—এমন মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকদের জিম্মায় দেওয়া হয়। এর আগে পুলিশ সদর দফতরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি এক ব্যক্তি পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ শাখার ফেসবুক পেজে অভিযোগ করেন, অবসরে বিনোদন এবং সুন্দরভাবে সময় কাটাতে বিনোদনপ্রেমী মানুষ হাতিরঝিল এলাকায় যায়। কিন্তু কিছু কিশোর তাদের হয়রানি করছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে বিষয়টি হাতিরঝিল থানায় জানানো হয়। এরপর অভিযানে নামে পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক গণমাধ্যমকে জানান, বেশ কিছু দিন ধরে গ্যাং কালচার বিরূপ আকার ধারণ করেছে। গ্যাং কালচারের বলি হতে হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। সর্বশেষ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মো. মহসিন আলী নামে এক কিশোর খুন হয়। তিনি বলেন, বেশ কয়েকজন অভিভাবক ও স্কুল পড়ুয়া উঠতি তরুণী ইভটিজিংয়ের শিকার ও বেপরোয়া আচরণের অভিযোগ করেছেন।

স্মরণ করা যেতে পারে, রাজধানীর উত্তরায় আদনান কবির নামে ১৪ বছরের এক কিশোর খুন হয়েছিল তার সমবয়সীদের হাতে। ক্রিকেট ব্যাটের অসাবধানতাবশত আঘাতে নয়; বরং তাকে পেশাদার খুনির মতো নির্মমভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়। যে নিহত হয়েছে এবং যারা খুন করেছে—তারা সবাই শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। যারা বেড়ে উঠেছে প্রাচুর্যের ভেতরে; যাদের কাছে ‘জীবনটা মস্ত বড়, খাও-দাও ফুর্তি করো’; যারা ফেসবুকে ‘লেটস ফান’ লিখে স্ট্যাটাস দেয় এবং প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেলের সাইলেন্সার পাইপ খুলে যুদ্ধবিমানের মতো শব্দ করে রাস্তায় দ্রুতবেগে ছোটে; যাদের কাছে অন্যের অসুবিধা পাত্তা পায় না; যারা চাহিবামাত্রই সবকিছু হাতের কাছে পেয়ে যায়; যাদের সামনে কোনও স্বপ্ন নেই; কোনও আদর্শ নেই। আমরা স্মরণ করতে পারি ফরিদপুরের আরেক কিশোর ফারহিন মুগ্ধর কথা; নতুন মডেলের মোটরসাইকেলের বায়না পূরণ না করায় যে তার বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল।

এই তারুণ্যেরই একটি অংশ জানে না, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা অপরাধ। রাজধানীর বনানীতে দুই ছাত্রী ধর্ষণের আসামি সাফাত আহমেদ পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে অকপটেই বলেছিল, তারা ‘মেয়ে বন্ধুদের’ সঙ্গে প্রায়ই পার্টিতে ‘এমনটা’ করে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা এতে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাদের ভাষ্য, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হিসেবে সাফাত উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতো। অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তার স্বাভাবিক বলেই মনে হতো।

এই তরুণদেরই একটি অংশ হাতিরঝিল, বোটানিক্যাল গার্ডেন বা আরও যেসব জায়গায় মানুষ পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যায়, সেখানে গিয়ে গণউপদ্রব সৃষ্টি করে। দুজন নারী-পুরুষকে আলাদা দেখলে তাদের ব্ল্যাকমেইল করে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে এরা একটি বিশাল চক্রও গড়ে তুলেছে এবং সম্প্রতি পুলিশ এখান থেকে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে।

কীভাবে এই তরুণরা এরকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ে? অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এর পেছনে মূলত কাজ করে পাড়া-মহল্লা বা স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি। কারণ, কিশোর-তরুণদের মধ্যে সব সময়ই যে হিরোইজম বাস করে, পরিবার ও সমাজের সমর্থন পেলে সেটি প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ পারিবারিক শাসন বা শৃঙ্খল দুর্বল হলে সেসব কিশোর-তরুণকে দ্রুতই নিজেদের দলে ভিড়ানো যায়। ফলে যখনই তারা কোনও না কোনোভাবে ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায়, সেটি পাড়ামহল্লা কেন্দ্রিক রাজনীতি হোক বা অন্য কিছু, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা হিরো হতে চায়। নিজের বা বন্ধুর মোটরসাইকেল থাকলে সেই হিরো হওয়ার পথটি আরও সহজ হয়। তখন তারা একসঙ্গে আট দশটি মোটর সাইকেল নিয়ে মূল রাস্তায় বা গলির ভেতরে দাপিয়ে বেড়ায়। তাদের মাথায় হেলমেটও থাকে না।

ইদানীং বাইক নিয়ে এরকম ‘মাস্তানি’ করার একটি বড় জায়গায় পরিণত হয়েছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নবনির্মিত প্রশস্ত সড়কটি। বিকেলে এখানে কেউ পরিবার নিয়ে ঘুরতে গেলে এই মোটরবাইকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হবেন। এই তরুণদের মধ্যে না আছে বিনয়, না ভদ্রতা। কারণ, তাদের ভেতরে কাজ করে এক ধরনের উন্মাদনা—যার উৎস ক্ষমতা। যে ক্ষমতা হতে পারে রাজনৈতিক, হতে পারে আর্থিক সচ্ছলতার। আবার গরিব ঘরের সন্তানরাও এরকম উন্মাদ হতে পারে। সেক্ষেত্রেও দেখা যাবে তাদের পেছনে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী কোনও না কোনও রাজনৈতিক নেতার পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। কারণ, নিজের প্রভাব বজায় রাখার জন্য সেই নেতাদের ‘লোক’ প্রয়োজন—যারা তাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করবে এবং যেকোনও সময় অনেক মোটরসাইকেল নিয়ে তারা ভাইয়ের ডাকে সাড়া দেবে। আর এভাবেই স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের কর্মী বা অনুসারী তৈরি করতে গিয়ে এমন কিশোর-তরুণদের গ্রুপ বা গ্যাং তৈরি করছেন, যাদের দৃশ্যমান হওয়ার মূল মাধ্যম এই মোটরবাইক।

সুতরাং, হাতিরঝিলে অভিযান চালিয়ে দুই তিনশ’ কিশোর-তরুণকে আটক এবং এরপরে অভিভাবকদের ডেকে তাদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়াই সমাধান নয়। কারণ, কিছু দিন পরে তারা আবারও এভাবে রাস্তায় নেমে মাস্তানি করবে এবং নানা জায়গায় গিয়ে গণউপদ্রব সৃষ্টি করবে। ফলে এসব বন্ধের জন্য তাদের ক্ষমতায়িত করা বা হিরোইজম তৈরির পেছনে যেসব অনুষঙ্গ দায়ী, বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের আধিপত্য—সেখানে রাশ টানা দরকার। কিন্তু সেই রাশ কে টানবে? কারণ, স্থানীয় পর্যায়ের এসব রাজনৈতিক নেতার জোরেই বড় বড় নেতা তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা হতে গেলে স্থানীয় পর্যায়ের এরকম নেতাদের প্রয়োজন। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি ক্ষমতার চেইন। কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে গেলে পেশিশক্তির বিকল্প নেই। সেই শক্তির প্রাথমিক উৎস পাড়া-মহল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে গণউপদ্রব সৃষ্টিকারী এই কিশোর-তরুণরা।

লেখক: সাংবাদিক 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
চাঁদপুরে লঞ্চে আগুন, হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত ১০
চাঁদপুরে লঞ্চে আগুন, হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত ১০
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দেওয়া ব্যক্তির মৃত্যু
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দেওয়া ব্যক্তির মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ