(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।)
১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নির্বাচনি সফর শুরু করেন। ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলায় দুই দিনব্যাপী গণসংযোগের মধ্য দিয়ে তিনি সফরসূচি শুরু করবেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়।
বঙ্গবন্ধু এই সফরের শুরুতে পাঁচটি জনসভায় ভাষণ দেবেন। সকালে তিনি টাঙ্গাইলে যাত্রা করবেন এবং সেখানে পৌঁছে কিছুক্ষণ পরেই জনসভায় ভাষণ দেবেন। টাঙ্গাইল থেকে তিনি জামালপুরে যাবেন। জামালপুর থেকে বিপিআই জানায়, বঙ্গবন্ধু সেখানে পৌঁছালে পুলিশ ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তাকে গার্ড অব অনার দেবে। সেখানে তিনি পদস্থ সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সফরকালে শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর সঙ্গে থাকবেন।
বাসসের খবরে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু দুপুর ১২টায় জামালপুরে এক জনসভায় ভাষণ দেবেন। সেখান থেকে তিনি ময়মনসিংহে যাবেন এবং বিকাল তিনটায় সেখানকার জনসভায় ভাষণ দেবেন। বঙ্গবন্ধু রাতে ময়মনসিংহে থাকবেন, পরদিন সকালে নেত্রকোনা যাবেন। সেখানে পৌঁছার পর তিনি হজরত শাহ সুলতানের মাজার জিয়ারত করবেন। দুপুর ১২টায় তিনি সেখানে জনসভায় বক্তৃতা করবেন। নেত্রকোনা থেকে কিশোরগঞ্জ গিয়ে বিকাল তিনটায় সেখানকার একটি জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে।
লোক বিনিময়ে পাকিস্তানের বাধা সৃষ্টি
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমস্যা যা-ই থাকুক না কেন, সে দেশে আটকে পড়া বাঙালিদের বিনিময়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের বাংলাদেশ সরকার ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত। ১৯৭৩ সালের এই দিনে রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা মেঘনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা। লোক বিনিময় প্রশ্নে কোনও বাধা দেওয়া উচিত নয়।’ সেই সময় পাকিস্তান লোক বিনিময় প্রশ্নে সংখ্যার ওপর জোর দিয়ে প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করছিল। তার কঠোর সমালোচনা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে যেসব পাকিস্তানি নাগরিক নিজ দেশে ফিরে যেতে চেয়েছে, তাদের সবার বিনিময়ে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের দেশে ফিরে আসার বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সদিচ্ছার বিপরীতে পাকিস্তান কোনও সাড়া দেয়নি। পক্ষান্তরে তারা সমস্যাকে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ তার এই নীতি অনুযায়ী, যুদ্ধাপরাধীসহ সব সামরিক বন্দি পরিবারের নারী ও শিশুদের ছেড়ে দিতে চেয়েছে। বাংলাদেশ মনে করেছিল, পাকিস্তান এতে সাড়া দেবে। কিন্তু পাকিস্তান বিষয়টিকে প্রচার ও দেনদরবারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এই উপমহাদেশের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সব ধরনের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রতি বারবার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বারবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন এবং বিষয়টিকে ক্রমে জটিল করছেন।’
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান লোক বিনিময়ের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনও ধরনের প্রশ্ন তোলেনি।’ তিনি পাকিস্তানকে লোকবিনিময় ইস্যুটিকে অন্য কোনও দৃষ্টিতে না নিয়ে সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে আহ্বান জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চলতি মাসের ১ তারিখে (ফেব্রুয়ারির) বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানে থাকা ১৫ হাজার বাঙালি নাগরিকের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তা আবার পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্পষ্ট করা হয়নি।’
নিজেদেরই সমস্যার সমাধান করতে হবে
সম্প্রতি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কুর্ট ওয়াল্ডহেইম বাংলাদেশ সফরে এলে তাকে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলা হয় বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জাতিসংঘ মহাসচিব সমস্যার বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। পাকিস্তান বিদেশে যে কূটনৈতিক প্রচারণা ও তৎপরতা শুরু করেছে, তাতে কোনও লাভ হবে বলে তিনি মনে করেন না। কারণ, সমগ্র বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের নীতি খুবই পরিষ্কার। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক সহজ করার ব্যাপারে তৃতীয় কোনও পক্ষ অথবা জাতিসংঘের কোনও ভূমিকা থাকতে পারে কিনা, প্রশ্ন করা হলে এদিন কুর্ট ওয়াল্ডহেইম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সমস্যা নিজেদের মধ্যে সমাধান করা সম্ভব। উপমহাদেশের সমস্যা সমাধানের এখনও পুরোপুরি সময় হয়নি।’