X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরা আকর্ষণ

দাউদ হায়দার
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:০৭আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:১১

দাউদ হায়দার পিতৃকুলের আদি নিবাস করাচির জাহাঙ্গীর রোডে। সিন্ধ প্রদেশের আভিজাত্য এখনও ঠারেঠোরে ঝালাই করেন, বুঝিয়ে দেন বঙ্গীয় বন্ধুদের। ঠাকুরদার ঠাকুরদা গত শতকের প্রথম দশকে কলকাতায় স্থিতু, তখন অবশ্য অখণ্ড ভারত। গর্ব করেন, বহিরাগত নন, বরং ‘বঙ্গাল’। বাড়িতে সিন্ধ না উর্দুভাষা বলেন, জিজ্ঞেস করিনি কখনও। দেখা হলে, বা, বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলে, বাংলায় কথাবার্তা। উচ্চারণে কিছু অবাঙালি টান। এও বাহ্য। ‘আরে দোস্ত, কাল ইভিনিং-এ, সাতটায় আমার মোকামে ডিনার, প্লিজ আইয়ে।’ সময় নির্ধারিত, কিন্তু কলকাতার রাস্তাঘাট, যানবাহন, ট্রাফিকের যা অবস্থা, পনের কুড়ি তিরিশ মিনিট দেরি হতেই পারে। গোস্বা করে বলেন, ‘তোমার বিলম্বের দেরি হলো কেন?’ যতবারই শুধরিয়ে দিই ‘বিলম্ব’ আর ‘দেরি’ একই মানে, শুনে, ‘আরে ইয়ার ছোড় দো।’ ছেড়ে দিয়েছি। ‘বিলম্বের দেরি’র এই ভণিতার হেতু আছে বৈকি। যথসময়ে লেখা হয়নি। সংবাদপত্রের ভাষায় ডেটলাইন।

৬ ফেব্রুয়ারি বিগত, ১৯৭২-এ ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কলকাতার ব্রিগেডে। মঞ্চের একেবারে সামনে উপস্থিত। সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কুষ্টিয়া-পাবনার সেক্টর কমান্ডার বাবুল। কমান্ডার বাবুল নামে অধিক পরিচিত। কেন, কীভাবে উপস্থিত, ঘটনায় রস আছে।

মুক্তিযুদ্ধের (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন। বিজয় দিবস হিসেবে চিহ্নিত এখন) পাঁচ সপ্তাহ পরে বললেন, ‘কলকাতায় যাওয়ার হাউস [সাধ বা ইচ্ছে। পাবনার ভাষা] হয়ছে? যাবু?’

তিনি যখন বলছেন, নিশ্চয় সব দায়দায়িত্ব তাঁর। মুহূর্তে রাজি। ঢাকা থেকে যেতে হবে গাড়িতে। ঢাকা থেকে পাবনা, পাবনা থেকে কুষ্টিয়া, কুষ্টিয়া থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বনগাঁ হয়ে কলকাতায়। বাবুলের চ্যালা নেহাল, জগলু, বারি ঠিক করলে, ধানমন্ডির তিন নম্বর রোডে এক পাকির (পাকিস্তানি/ব্যবসায়ী) গাড়ি আছে। টয়োটা। স্টেইনগান দেখিয়ে নিতে হবে (আসলে ছিনতাই)। যাহা বুদ্ধি তাহা কর্ম। সাত সকালে পাকির বাড়ি গিয়ে হাজির। স্টেইনগান দেখে রা নেই মুখে। ভয়ে তিনি চাবি দিয়ে কান্নাকাটি। ‘মারবেন না, মারবেন না।’ শুধু চাবি, গাড়িই নয়, ঢাকা-কলকাতা-কলকাতা-ঢাকা যাতায়াতে পেট্রল খরচ হতে এই হিসাবের বাইরেও হাজার টাকা দাবি। চারশ’ ছাপ্পান্ন টাকা (তখনও পাকিস্তানি টাকা) দিয়েছেন।

আমাদের কোনও পাসপোর্ট নেই, কলকাতায় তথা ভারতে বাংলাদেশ থেকে টয়োটা নিয়ে যাওয়ার অনুমতিও নেই, চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে দুই ঘণ্টায় সব ফয়সালা। বেনামে ছাড়পত্র (যাওয়ার কাগজ। দরকার নেই পাসপোর্টের, তখন)। গাড়ি নিয়ে যাওয়ারও অনুমতি। চুয়াডাঙ্গার প্রশাসকের কাগজই যথেষ্ট। সীমান্তেও ঝামেলা করেনি। হাস্যমুখে: ‘আপনারা মুক্তিযোদ্ধা? এ দেশ তো আপনাদেরই।’

আমরা আছি কলকাতার মেটিয়াবুরজে। বাবুলের বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধু খাঁটি মুসলমান। বিহারের। বাবুলের সঙ্গে পরিচয় চুয়াডাঙ্গার রণাঙ্গনে। বন্ধু ব্যবসায়ী, শীতের সময় রণাঙ্গনে গিয়েছিলেন কম্বল বেচতে। বেচারসূত্রে আলাপ, বন্ধুতা। ভদ্রলোক বিপদগ্রস্ত হন, ‘পাকিস্তান ভাঙার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্যে।’ বিহারি মুসলিমরা চাননি পাকিস্তান ভাঙুক।
কলকাতার বড়লোকের পাড়ায় নতুন টয়োটা (সাদা) নিয়ে ঘুরছি, গোয়েন্দার কবলে নানা অজুহাত দেখিয়ে রেহাই।

ফিরবো দশ তারিখে। তিন বা চার তারিখে চোখে পড়ে, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাগতম, ‘শেখ মুজিবুর রহমান স্বাগতম।’ ‘ব্রিগেড চলো।’ তারিখ ছয়  (ফেব্রুয়ারি)। আমরা বিস্মিত। নানা পোস্টারে শহর সয়লাব। বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধির ছবিও।

বাবুলের বড় ফুপির বাড়ির ৩২ ধানমন্ডির প্রবেশমুখে। বড় ফুপি আমাদেরও আত্মীয়া। বত্রিশ ধানমন্ডির কয়েক বাড়ি পরেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। বহুবার দেখেছি। বাবুলের বড় ফুপির বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে (শেখ হাসিনা) যখন-তখন দেখেছি। বড় ফুপুর কন্যার বন্ধু।

ব্রিগেডে বঙ্গবন্ধুর অনুষ্ঠানে ইন্দিরা গান্ধি? ইন্দিরাকে দেখার জন্যেই হাজির। সেই প্রথম দেখলুম। মাথা নত হলো। সেদিন ছিল ৬ ফেব্রুয়ারি। দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টি। জনতার ঢলে কমতি নেই। দেখি দুটি মঞ্চ। এক মঞ্চে গান বাজনা। অন্য মঞ্চে ইন্দিরা, বঙ্গবন্ধু, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। আরও কেউ কেউ।

বাবুল স্লোগান দিলেন, ‘জয় ইন্দিরা’। পাবলিকও বললেন। আমরা যখন মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ে মঞ্চের দিকে আগুয়ান, এক বৃদ্ধা, ‘আমি টুঙ্গিপাড়ার, আমার মুজিবরে দেখুম।’

বাবুল তাঁকে হাত ধরে মঞ্চের সামনে নিয়ে বসিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে দেখুন।’

বিলম্বের দেরি হলেও।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ