সাবিনে পিশেল, আমাদের সহকর্মিনী, ডয়েচে ভেলের চীনা বিভাগে, গত শতকের নব্বুইয়ের গোড়ায় বললেন একদিন, ‘হানস্ ক্রিস্টক-বুখের নাম শুনেছ, কোনও লেখা পড়েছ?’ বললুম, ‘শঙ্খ ঘোষের নাম শুনেছ? নিশ্চিত, শোনোনি।’ চোখ ঘোলা করেন। খোলাসা করি, শঙ্খ ঘোষের ছাত্র ছিলুম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শঙ্খ ঘোষের বন্ধু হানস ক্রিস্টক, গ্রন্থেই আছে। শঙ্খর লেখা পড়েই হানসকে জেনেছি। বার্লিনে এসে হানসের লেখা পড়েছি, আগে পড়িনি। হানস জার্মান টিভি চ্যানেলে (এ আর ডি এবং জেডডিএস) পরিচিত মুখ। নানা বিষয়ে কথা বলেন রাজনীতি, সাহিত্য, ভ্রমণ, ফুটবল নিয়েও।
আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে শঙ্খ যখন মাস কয়েক আবাসিক, পৃথিবীর নানা দেশের লেখক সংসর্গে প্রীত, স্মৃতি ঝলসিয়েছেন ‘ঘুমিয়ে-পড়া অ্যালবাম’ গ্রন্থে। যুগান্তরের রবিবাসরীয় সাময়িকীতে ধারাবাহিক প্রকাশিত।
সাবিনে পিশেলকে এত কথা বলিনি। দরকারও নেই।
গত শতকের নব্বই দশকের কোনও এক মাসে, একটি সাহিত্যানুষ্ঠানে হানসের সঙ্গে পরিচয়। বলি, ‘শঙ্খ ঘোষের ছাত্র ছিলুম।’ জানান, সাবিনে আমাকে বলেছেন, কিন্তু শঙ্খর নাম বলতে পারেননি। এখন পরিষ্কার।’
গত তিরিশ বছরে হানসের সঙ্গে যখনই দেখা হয় (বছরে তিনচার বার, সাহিত্য সংস্কৃতির অনুষ্ঠানে), পয়লা প্রশ্ন, ‘শঙ্খ কেমন আছেন?’
শঙ্খ জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাওয়ার পরে হানসকে ফোন করলুম। জানতেন না জ্ঞানপীঠ পুরস্কার কী। বলি। ‘ভারতীয় নোবেল পুরস্কার, অভিনন্দন। দারুণ। ঠিকানা দাও ওঁকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখব।’ বলেন। লিখেছেন কিনা, জিজ্ঞেস করিনি কখনও। করোনা অতিমারির দাপটে বছরখানেক দেখা হয়নি অবশ্য।
শঙ্খ ঘোষের ছাত্র ছিলুম, তবে বাংলা বিভাগে নয়। পড়তুম তুলনামূলক সাহিত্যে। আর্টস্ বিভাগের বাংলা সিলেবাসে ‘পথের সঞ্চয়’ রবীন্দ্রনাথের পাঠ্য ছিল। পড়িয়েছেন সপ্তাহে একদিন, শনিবারে।
কলা বিভাগের (আর্টস) ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি ছিল দেখার মতন, প্রত্যেকে হাজির। বসার জায়গাও পাওয়া দুস্কর। সবই শঙ্খ ঘোষের জন্যে।
তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী তৃপ্তি ঘটকের আক্ষেপ ছিল, বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা শঙ্খ ঘোষকে সপ্তাহে পাঁচদিন কাছে পায়, আমরা শুধু শনিবারে, তাও এক ঘণ্টার জন্য। একটি মাত্র ক্লাসে।
তৃপ্তি ঘটকের আক্ষেপের আরও কারণ, ‘বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শঙ্খ স্যার নাটক, সিনেমা দেখতে যান, আমাদের কোনও মাস্টারমশাই নন, বরং দূরে ঠেলেন।’
বাংলাদেশ শঙ্খর ফেলে-আসা দেশ। স্মৃতি কুরে খায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক পরেই যাননি, সময় নিয়েছেন কিছুকাল (তার মধ্যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঝুটঝামেলাও)। গিয়ে শৈশব-কৈশোর-যৌবনের শুরু খুঁজেছেন। পাবনার পাকশি স্কুলে (বিদ্যাপীঠ) পড়েছেন। বাবা ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। গিয়েছেন পাকশির বিদ্যাপীঠে। স্মৃতি কতটা কাবু করেছিল, লেখেননি। স্কুলের মাস্টারকুল আনন্দিত। সাদরে সম্বর্ধনা।
বাংলাদেশের আমন্ত্রণ সানন্দে লুফে নিয়েছেন, একবারই যেতে পারেননি। কারণ অজানা। আমন্ত্রণকর্তাদের অধ্যাপক (তুলনামূলক সাহিত্যের) অমিয় দেবের নাম প্রস্তাব করেন। গৃহীত।
গত দুই দশকের বেশি বাংলাদেশে শঙ্খ ঘোষের প্রতিপত্তি এতটাই, তিনজন কবি ঘোষণা করেছেন ‘আমরা শঙ্খ ঘোষের চ্যালা। তাঁর মতো কবিতা লেখার চেষ্টা করছি। তিনিই আমাদের গুরুদেব।’ চ্যালাদের একজন বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন কবিতায়।
শঙ্খর গদ্যের ‘চ্যালাও’ ইদানীং কয়েকজন। ভালোই মকশো করেছেন শঙ্খর গদ্য।
শঙ্খর বই শঙ্খর অনুমতি নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে, বিনা অনুমতিতেও (একটির কথা জানি)। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শঙ্খ বিপুল, বিশেষত রবীন্দ্রসাহিত্য পঠনে। রবীন্দ্রনাটক বিচারবিশ্লেষণে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে অপরিহার্য, অবশ্যপাঠ্য। ‘কি বিপুল তরঙ্গ রে।’
কবি-প্রাবন্ধিক-নাট্যকার-অধ্যাপক জিয়া হায়দার বলছিলেন একবার, ‘শঙ্খ ঘোষের পরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা ইতরামি। কিভাবে, কোন দিক থেকে রবীন্দ্রবিচার দেখিয়েছেন পরতে-পরতে। শঙ্খই নতুন মাত্রা দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রচিঠি, বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় রবীন্দ্রসাহিত্য কী বিপুল তরঙ্গে তরঙ্গায়িত।’
শঙ্খর একটি গদ্যের শিরোনাম : ‘আমার কোনো ছাত্র নেই।’ অধ্যাপক সুবীর রায়চৌধুরীর স্মৃতিতর্পন, লেখা। লেখার মূলে কি এই অমার্জিত অধম? ঘটনা : তুলনামূলকের এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন ‘কোথায় যাচ্ছো?’ বললুম, ‘বাংলা বিভাগে ঝিনুকবাবুর কাছে। ঝিনুকের মধ্যেই শঙ্খ।’ সিঁড়িতে তিনি দাঁড়িয়ে। দেখিনি।
সুবীর রায়চৌধুরী, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ক্লাস শেষে (ওঁদের ছাত্র ছিলুম) জিজ্ঞেস করলেন, ‘শঙ্খদা সম্পর্কে কী বলেছ?’
—লজ্জায় মাথা হেঁট, মরণ। ধরণী দ্বিধা হয় না।
বহু বছর স্যারের (শঙ্খ ঘোষ) ধারে কাছে ঘেঁষেনি। অপরাধ বোধে দিশেহারা। মার্জনাপ্রার্থনা অপরাধ। চাইনি। মহাত্মা তিনি। অশিক্ষিত ছাত্রকে ক্ষমা করেছেন হয়তো।
সারের জন্মদিন আজ। প্রণতি।