X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামের ভোট নিয়ে চারটি প্রশ্ন

আমীন আল রশীদ
০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:০৫আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:০৫

আমীন আল রশীদ
সদ্য অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ভোট দিতে এসে মো. রশিদ নামে এক ভোটার জানিয়েছেন, তিনি আর জীবনে ভোট দিতে আসবেন না। কারণ, নিজের পছন্দ মতো স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেননি। গণমাধ্যমের খবর বলছে, নগরীর ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রশিদ চট্টগ্রাম সিটির বন গবেষণাগার উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়ার পর কয়েকজন ব্যক্তি তার কার্ড নিয়ে মেশিনে দেন। আঙুলের চাপ নেন। তারপর নিজেরাই মেশিনের সুইচ টিপে দেন। এরপর তারা বললেন, “আপনার ভোট হয়ে গেছে।” এই তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মো. রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জীবনে যে কদিন বাঁচব, আর ভোট দিতে আসবো না।’ এই কেন্দ্রে আরও অনেক ভোটারের একই অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

প্রশ্ন হলো, এগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে কিনা? দ্বিতীয় প্রশ্ন, নাগরিক যদি নিজের পছন্দ মতো ভোট দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে আর ভোটের ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন আছে কিনা? তৃতীয় প্রশ্ন, ভোটের ফলাফল যদি নির্ধারিতই থাকে, তাহলে ভোট আয়োজন করে করে রাষ্ট্রের পয়সা ও সময় খরচ না করে নির্বাহী বিভাগ থেকে কাউকে মনোনীত করে দেওয়াই যথাযথ কিনা? এই প্রশ্নগুলো সামনে রেখে এগোনো যাক। সেই সাথে প্রতিটি নির্বাচনের পরে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার যে ‘ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া’ ব্যক্ত করেন, তারই বা ব্যাখ্যা কী— সে প্রশ্নটিও মাথায় থাকলো।

গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী। ফলাফল যে এরকমই হবে, তা নিয়ে কারও মনে সংশয় ছিল না। অর্থাৎ এই যে ভোটের আগেই ফলাফল ‘জেনে যাওয়া’ যায়, এটিই বিগত বছরগুলোয় দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ক্ষতি বলে মনে হয়।

তারপরও দেখা গেলো এই নির্বাচন সহিংসতামুক্ত হয়নি। নগরীর খুলশী থানার আমবাগান এলাকায় গুলিতে আলম মিয়া নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। চট্টগ্রামের এই নির্বাচন যে পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ হবে না বা বিতর্কমুক্ত থাকবে না, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিলো অনেক আগ থেকেই— যা ভোটের দিনে অধিকতর দৃশ্যমান হয়। ভোটের দিন সকালেই সব কেন্দ্র থেকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ইভিএমে ভোট দেওয়ার গোপন কক্ষে প্রত্যেক ভোটারের সঙ্গে অন্য একজন ছিলেন বলেও অভিযোগ ওঠে। কোনও কোনও কেন্দ্রে ভোটারদের মেরে বের করে দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে।

এরকম বাস্তবতায় খোদ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও চট্টগ্রাম সিটির এই নির্বাচনকে ‘অনিয়মের মডেল’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘আগামীতে দেশব্যাপী যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে এই মডেল অনুসরণ করা হলে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বসভায় আমরা আত্মমর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারবো না।’

প্রসঙ্গত, প্রতিটি নির্বাচনের পরেই নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এরকম মন্তব্যই করেন— যা কমিশনের অন্য সদস্য এবং কর্মকর্তাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। সঙ্গত কারণে যে প্রশ্নটিও এখন সামনে আসছে যে, নির্বাচনে এত অনিয়ম দেখে তিনি যদি ক্ষুব্ধই হন, তাহলে তিনি এই পদে বসে আছেন কেন? নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করে তিনি কেন উদাহরণ তৈরি করেন না?

জনমনে ক্রিয়াশীল থাকা তিনটি প্রশ্ন দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে: চট্টগ্রামের ঘটনাগুলো ‘বিচ্ছিন্ন’ কিনা? নাগরিক নিজের পছন্দে ভোট দিতে না পারলে নির্বাচনি ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন আছে কিনা এবং ভোটের ফলাফল নির্ধারিত থাকলে মনোনীত ব্যক্তির নাম ঘোষণা করে দেওয়া যায় কিনা?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো, কোনও ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়। কারণ, প্রতিটি ঘটনারই একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে এবং একইরকম ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামে যা ঘটলো তা নতুন কিছু নয়। কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারা; নির্দিষ্ট কোনও প্রার্থীর কর্মীদের সামনে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট কোনও প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য হওয়া; ভোটকেন্দ্রে গিয়ে অপমানিত বা অসম্মানিত হওয়ার মতো ঘটনা আগেও ঘটেছে। সুতরাং চট্টগ্রাম সিটিতে মো. রশিদ নামে যে লোক ভোট দিতে না পেরে জীবনে আর ভোট দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটিও বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। কারণ, অতীতে আরও অনেকেই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং ভোটের পরিস্থিতি উন্নতি না হলে এই মানুষদের সংখ্যা আরও বাড়বে এবং তখন নির্বাচন কমিশনের তরফে বলা হবে, ‘দেশ উন্নত হচ্ছে বলে ভোট দিতে আসা মানুষের সংখ্যা কমছে।’

দেশ যে উন্নত হচ্ছে তা নিয়ে নিশ্চয়ই কারও দ্বিমত নেই। কিন্তু শুধু এই কারণেই ভোটকেন্দ্রে মানুষের আগ্রহ কমছে, সেই উপসংহারে পৌঁছানোর সুযোগ নেই। কারণ, ভোটের শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশ এবং সেই সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলে মানুষ যেকোনও অর্থনৈতিক অবস্থার ভেতরেই ভোট দেয়।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো, নাগরিক নিজের পছন্দে ভোট দিতে না পারলেও নির্বাচনি ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হবে। কারণ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়েছে যেসব কারণে, তার মধ্যে সবশেষ কারণটি ছিল এই ভোট বা নির্বাচনের ফলাফল তথা ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ছিনিমিনি। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ব্গিত ৫০ বছরে এমন কোনও একটি জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা হয়তো দেশবাসী স্মরণ করতে পারবেন না, যেটি নিয়ে কারও কোনও প্রশ্ন ছিল না বা যে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক নেই।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোকে তুলনামূলক ভালো ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হলেও এগুলোও শতভাগ ত্রুটিমুক্ত ছিল, সে দাবি করা ন্যায়সঙ্গত নয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ভোট ব্যবস্থাটি বাতিল করে দিতে হবে। বরং বিতর্ক মাথায় নিয়েও ক্ষমতায় পালাবদল ঘটেছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো তা-ই হবে। সেক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হয় বিতর্কের মাত্রা ও প্রশ্ন কতটা ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা যায়। সেজন্য শুধু সরকার, নির্বাচন কমিশন বা ক্ষমতাসীন দলই নয়, বরং ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোকেও অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্বাচনি ব্যবস্থার ক্ষতটি যেভাবে বেড়েছে, সেই ক্ষত সারাতে ভালো চিকিৎসক ও ওষুধ লাগবে— যে চিকিৎসকের নাম ‘রাজনীতি’ এবং ওষুধের নাম ‘পলিটিক্যাল উইল’।

তৃতীয় প্রশ্নের সহজ উত্তর ‘না’। কারণ এটি অসাংবিধানিক। সংবিধানে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। সিলেকশন বা মনোনয়নের সুযোগ নেই। তবে কোথাও একাধিক প্রার্থী না থাকলে সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা বিনা ভোটে নির্বাচিত ঘোষণার বিধান রয়েছে। এই বিধানটি অসাংবিধানিক বা বেআইনি না হলেও যৌক্তিক বা নৈতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ কিনা, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিনা ভোটে বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, সেটি সাংবিধানিক ও আইনি হলেও কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নয়। কারণ, অনেক সময়ই কোনও একজন নির্দিষ্ট (মনোনীত) প্রার্থীর জয়কে নির্বিঘ্ন করতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বা আইনি মারপ্যাঁচে ফেলে ভোটের মাঠ থেকে আউট করে দেওয়ার অসংখ্য উদাহরণ আছে। সুতরাং এই পদ্ধতিতে ভোট হলে সেটিকে যেহেতু নির্বাচন বলা যায় না এবং সংবিধান বলছে নির্বাচন, অতএব এই প্রক্রিয়ায় ভোট হলে সেটি অসাংবিধানিক কিনা— তা নিয়েও বড় পরিসরে আলোচনা ও বিতর্কের সুযোগ রয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উপজেলা নির্বাচন: জেলা-উপজেলায় আ.লীগের সম্মেলন বন্ধ
উপজেলা নির্বাচন: জেলা-উপজেলায় আ.লীগের সম্মেলন বন্ধ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ