জব্বার আল নাঈম কবি ও কথাসাহিত্যিক। এবছর পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার। জন্ম ১১ নভেম্বর, ১৯৮৬; চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার বদপুর গ্রামে। কবিতার বই : তাড়া খাওয়া মাছের জীবন; বিরুদ্ধ প্রচ্ছদের পেখম; এসেছি মিথ্যা বলতে। পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি ও লেখালেখি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।
প্রশ্ন : জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার পেলেন, কেমন লাগছে?
জব্বার আল নাঈম : যেকোনো পুরস্কারই আনন্দের।
প্রশ্ন : আপনার লেখালেখি শুরুর গল্প জানতে চাই। কেমন ছিল সেই সময়টা?
জব্বার আল নাঈম : গ্রামে আমার জন্ম, লেখাপড়া ও বড় হওয়া। তখন কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা বেশি পড়তাম। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তাঁদের কবিতা আবৃত্তি করতাম। যদিও সেগুলো আবৃত্তি হতো না। আমার মেজো-বোন নাসিমা আকতার বলতেন, `দেখি নজরুলের মতো কবিতা লিখতে পারো কিনা।‘ তখন আমিও লিখতে চাইতাম। হতো না। হলেও ছড়ার মতো হয়ে যেত। আপা বলতেন হয় না। তখন নকল করা শুরু করলাম পাঠ্যবইয়ের কবিতা। এসব প্রাইমারি স্কুলের ঘটনা। ততদিনে বন্ধুরাও জেনে গেছে আমি কবিতা লিখি। কেউ কেউ কবি বলে ডাকত। এভাবে আমার ভাবনার আলাদা জগৎ তৈরি হয়ে যায়। সেই ভাবনাগুলো নিজের মতো লিখে আঞ্চলিক পত্রিকায় পাঠাতাম।
প্রশ্ন : যে পাণ্ডুলিপির জন্য পুরস্কার পেলেন সেটি কখনকার লেখা? পাণ্ডুলিপি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে যদি কিছু বলেন।
জব্বার আল নাঈম : কবিতা আমার কাছে প্রথম পছন্দ। তাহলে গল্প লিখছি কেন? কারণ, সাদাত হাসান মান্টো পড়ার পর মনে হলো গল্প লেখা যায়। মো ইয়ানের গল্প বড় রকমের ধাক্কা দিল। চিনুয়া আচেবেও ভালো লাগল। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অসাধারণ। আরো অনেকে আছেন যাদের গল্প ধাক্কা দিয়েছে। সেই উৎসাহ থেকে গল্প লেখার সূচনা। তবে, এসময়ের সমৃদ্ধ কথাসাহিত্যিক শামস সাইদ আমাকে গল্প লিখতে বারবার উৎসাহিত করতেন। হয়ে গেল ‘জীবনের ছুটি নেই’ পাণ্ডুলিপি।
আরেকটা কথা বলে রাখি, গল্প লেখার আগে উপন্যাস লিখেছি। তাও দুইটি। ‘চিৎকার’ নামের উপন্যাসটি দৈনিক পত্রিকার ঈদসংখ্যায় ছাপাও হয়েছিল। জুন-জুলাইয়ে প্রকাশ করব উপন্যাস `নিষিদ্ধশয্যা`।
প্রশ্ন : বাংলা কথাসাহিত্যের পরম্পরা বেশ দীর্ঘ। আপনিও লিখছেন। আপনার মূল্যায়ন কী?
জব্বার আল নাঈম : চীনারা চাইনিজ ভাষাকে, ইউরোপিয়ানরা স্প্যানিশ ভাষাকে পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
এশীয় ল্যাটিন আমেরিকান কিংবা আফ্রিকার সাহিত্য অঙ্গনের দিকপাল সাহিত্যিকরা ইংরেজি ভাষাকে দিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যে অন্যতম মর্যাদা। ফলে, ইংরেজি ঔপনিবেশিকতার অন্তর্হিত শক্তিও বেড়েছে। অ্যাংলো-স্যাক্সনদের জিম মরিসন, ডেরেল ওয়ালকট কিংবা একজন সিমাস হিনির চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ কিংবা আবুল হাসান।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ বা শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ কি গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ বা নাদিয়া গর্দিমারের ‘লা মাদ্রে’ হতে কোনো অংশে কম সংবেদনশীল রচনা? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্ন হয়তো অবাস্তব। কারণ, মহত্তর কিংবা শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াই হতে আমরা অনেক দূরে। ধরতে গেলে লাগে লম্বা জার্নি। নির্মম সুন্দরের ধ্বনি আমাদের এখানে কম। মাতৃভাষা বাংলা ছাপান্ন সাল থেকে নয়। অষ্টম শতাব্দী থেকে। অথচ, মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম ও তাঁর ‘বঙ্গবাণী’ বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারিনি। সেখানে অ্যালফ্রিক, হোমার পড়ে নিজেই নিজেকে ঈর্ষা করি। মুখে যতই বলি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরম্পরার সন্তান, বাস্তবতা হলো, জানিই না সব লেখকের নাম। বুঝিয়ে দিতে চাই না তাদের অধিকার। ফলে অগ্রজ সাহিত্যিকরা বড়ো হচ্ছে না। আমাদের রেটিংও বাড়ছে না।
প্রশ্ন : কথাসাহিত্যে আপনি কোন দিকটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন? পেরেছেন কী?
জব্বার আল নাঈম : পারছি কিংবা পারছি না কিংবা কতটা পারা হয়েছে পাঠক বলতে পারবে। গল্প নির্মাণের দিকেই অবচেতনগতভাবে হাত গেছে বেশি। আমার মনে হচ্ছে, ভাষা ও বাক্য সমৃদ্ধকরণের লক্ষ্যে সামনের দিনগুলোতে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে ভাবব। কাজও করব।
প্রশ্ন : সমসাময়িক এবং পূর্বজ লেখকদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
জব্বার আল নাঈম : সমসাময়িক অনেকের লেখা আমার প্রিয়। বেশি প্রিয় কবিতা। সত্তরের পরে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু প্রাণের অভাববোধ করি। জহির রায়হান, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শহীদুল্লাহ কায়সার, শওকত ওসমান, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু ইসহাক, শাহেদ আলী, মীর মশাররফ হোসেনের লেখায় প্রাণ আছে।
তিতাস একটি নদীর নাম, পদ্মানদীর মাঝি, হাজার বছর ধরে, লালসালু, সংসপ্তক—অন্যরকম সাহিত্য। বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় ধারণও করতে। যদিও অবচেতনভাবে আমরা তা ধারণ করি।
হাজার বছরের আবহমান বাংলাদেশ গ্রামীণ ছিল। এখনও আছে। গত শতকের সত্তর দশকের পরে গ্রামীণ পটভূমি নিয়ে কথাসাহিত্য নেই। কেন নেই? এজন্যেই কথাসাহিত্য সত্তরের আগের ও পরের দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
প্রশ্ন : কোনো বই আপনার লেখার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিলো?
জব্বার আল নাঈম : প্রথম উপন্যাস পড়েছিলাম `বিষাদ সিন্ধু`। পড়ে বেশ কান্নাকাটি করেছিলাম। কয়দিন পর পড়ি `দেবদাস`। তাও কান্না করতে হয়েছে। এরপর হুমায়ূন আহমেদের `নন্দিত নরকে` পড়ি। ততদিন পড়া হয়ে যায় লালসালু, সূর্যদীঘল বাড়ি, নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু, জাদুকরের মৃত্যু, পাক সার জমিন সাদ বাদ। এই বইগুলো সম্ভবত অনুপ্রাণিত করেছিল।