X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কিন গণতন্ত্রের ‘এসিড টেস্ট’

ড. শ্যামল দাস
১৯ জানুয়ারি ২০২১, ২০:২৫আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ২০:২৫

শ্যামল দাস
নতুন বছরের ৬ জানুয়ারি গণতান্ত্রিক আমেরিকার ইতিহাসে দুই বিপরীতমুখী সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার এবং দ্বন্দ্বের সাক্ষী হয়ে থাকবে। দিনটি এ দেশের ইতিহাসে একটি কালো দিন বলেই পরিগণিত হবে বলে আমার বিশ্বাস; আবার এই একই দিনকে হয়তো স্মরণ করা হবে গণতন্ত্র রক্ষার একটি স্বর্ণালি উদাহরণ হিসেবে। আড়াইশ’ বছরের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় এমন দিন আমেরিকার জনগণ কখনও দেখেনি। যে দেশের এক প্রেসিডেন্টের দেওয়া গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আজও সবচেয়ে নন্দিত, ব্যবহৃত, এবং গৃহীত হয় সে দেশটিতে এমন ঘটনা ভাবা যায় না। গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার এমন ঘটনা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই আধুনিক সময়ে সম্ভব তা এ দেশ কেন, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষেরাও ভাবতে পারেনি বা পারে না। তারপরও এটি ঘটেছে। ক্ষমতালিপ্সা মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা, কিন্তু একে সহনীয় করে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার এবং তাদের মধ্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের মাধ্যমে একে সিদ্ধ করার একটা সিস্টেম হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ৬ জানুয়ারি এবং এর পরবর্তী অনেক ঘটনা প্রমাণ করে যে কিছু মানুষের ক্ষমতালিপ্সা আধুনিক গণতান্ত্রিক সভ্যতার সব মানদণ্ডকে অতিক্রম করে যেতে পারে, কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দেশে শেষাবধি গণতন্ত্রের যে সৌন্দর্য তা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সব কুৎসিত উপাদানের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করে দেয়। এইটিই আমরা দেখলাম গত ক’দিনের আমেরিকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে।

আমার নিজের ধারণা, ইতিহাসের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন দেশ বা জাতিকে ঐতিহাসিক হিরোদের পাশাপাশি তাৎপর্যপূর্ণ ভিলেনদেরও মোকাবিলা করতে হয় বিশেষ সামাজিক বা রাজনৈতিক এপিসোডের প্রেক্ষাপটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন সেরকম একটি সময়কাল বা সোশ্যাল এপিসোড পার করছে। দেশটির ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প নামের এমন ঐতিহাসিক ভিলেন আর দেখা যায়নি, যে ভিলেন গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনও নিয়ম-কানুন, মানুষের সেন্টিমেন্ট, আমেরিকান সংস্কৃতির আইডিয়াল উপাদান কোনও কিছুরই পরোয়া করেন না শুধু নিজের ক্ষমতালিপ্সাকে চরিতার্থ করার জন্য। এমন ঘটনাই মার্কিনিদের যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা সেটিকে এক চরম নৈতিকতার সংকটে ফেলে দিয়েছিল। সিএনএন বলেছে, এ ঘটনাটি আমাদের পাকিস্তান, তাইওয়ান এবং এ জাতীয় দেশগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সমালোচনা করার নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের সেই শিশু অভিনেতা, যে নাটকে তার মৃত্যুদৃশ্যের অভিনয়ের সময় এ দৃশ্যে অংশ নিতে অস্বীকার করে। এ ধরনের অভিনেতা নাটকের জন্য সবসময়ই হুমকিস্বরূপ, এবং নাটকের সফল মঞ্চায়নের জন্য তাকে বহিষ্কার করাটাই নিয়ম।

ট্রাম্প ৬ জানুয়ারিকে বেছে নিলেন কেন? কী ছিল এদিন আমেরিকায়? নিয়ম অনুযায়ী আজই কথা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩রা নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সার্টিফাই করার। এটি সিনেটের মাধ্যমে করা হয়। এই সিনেটে আবার রিপাবলিকানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ট্রাম্প শুরু থেকেই ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াটিকে দেরি করিয়ে দিতে চাইছিলেন। তিনি বারবারই বলে আসছিলেন, এ যাত্রায় ক্ষমতা হস্তান্তর হবে না, কারণ নির্বাচনটি তার এবং আমেরিকানদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রাতিষ্ঠানিক রুটিন কর্মকাণ্ডটি করা হয় সেটিকে বিলম্বিত করে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন কোর্টে তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। সর্বশেষ তিনি জর্জিয়ার সেক্রেটারি অব স্টেটকে ম্যানিপুলেট করতে চেয়েছেন; সেটিও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ধরে নেওয়া যায় যে, ৫ জানুয়ারি জর্জিয়ার দুই সিনেট নির্বাচনে বিশ বছর পর ডেমোক্র্যাটদের জয়ের পেছনে এই ব্যাপারটি ভোটারদের কিছুটা হলেও প্রভাবিত করেছে। সহজভাবে বলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক দেশের সচেতন ভোটাররা যারা সংখ্যায় কম হলেও নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারে তারা এতটা নির্লজ্জ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে মেনে নেয়নি, এবং আমার ধারণা এই ভোটাররা ঐতিহ্যগতভাবে রিপাবলিকান অঞ্চলকে ডেমোক্র্যাটদের হাতে তুলে দেওয়ার কাজকে সহজ করেছে। এতে রিপাবলিকানরা সিনেটে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে, এবং এটি ঘটেছে একজন মানুষের অবিমৃশ্যকারিতা এবং ক্ষমতালিপ্সার জন্য।

যদিও ট্রাম্প নির্বাচন নিয়ে অসত্য বক্তব্যটি দিয়ে যাচ্ছিলেন নভেম্বরের ৩ তারিখ থেকেই, এর চরম প্রকাশটি ঘটেছে ৬ জানুয়ারি। ট্রাম্প ভেবেছিলেন, সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকানদের দিয়ে তিনি নির্বাচনের সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত করবেন, বা সম্ভব হলে এটিকে বাতিল করাবেন। যতদূর জানা যায়, সিনেটের সভাপতি দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি দিয়েছিলেন, কিন্তু পেন্স খুব সম্ভবত এ বিষয়ে তাঁর অবস্থানটি ট্রাম্পের কাছে পরিষ্কার করেননি, এবং ট্রাম্প সন্দিহান হয়ে ওঠেন। এ কারণেই তিনি দুর্বৃত্তদের উৎসাহিত করেছিলেন যেন তাদের কর্মকাণ্ড সিনেটকে সার্টিফিকেশনের কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য করে। তিনি তাদের র‍্যালিতে সরাসরি বলেছেন, তোমরা পেনসিলভেনিয়া এভিনিউতে নেমে এসো; আমাদের বিজয় যারা ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের প্রতিহত করো। অন্য অনেক রায়টারের মতো জেনা নামে একজন বলেছেন, আমরা ট্রাম্পকে অনুসরণ করছি (“উই আর লিসনিং টু ট্রাম্প”)। এ যেন হিটলারের সেই মন্তব্যের মতো, যেখানে তিনি জার্মানদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ডাক দিয়েছিলেন। একটি চমৎকার বিষয় দেখা গেলো গত কয়েকদিন ধরে; আমেরিকার অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেছেন, ট্রাম্প অনেকটাই ওসামা বিন লাদেনের প্রতিরূপ, যিনি মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে জীবন দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁদের। এ ব্যাপারটি নিয়ে ভবিষ্যতে আরও গবেষণা হবে, কিন্তু ট্রাম্পবাদ মার্কিন মননে একটি ক্ষত হিসেবেই বিবেচিত হবে ভবিষ্যতে। আরেকটি কথা; বিন লাদেন শক্তিশালী ছিলেন; তিনি তাঁর কমিউনিটির জন্য কিছু করতে চেয়েছেন, যেটি পথ হিসেবে অবশ্যই ঘৃণ্য। কিন্তু ট্রাম্প? তার যুদ্ধ কাদের জন্য এবং কাদের বিরুদ্ধে?

তিনি শুধু দেশকে বিভক্ত করেননি; তার নিজের দলও বিভক্ত হয়েছে প্রচণ্ডভাবে; প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; আমেরিকান আইডিয়াল নামের প্রতিরূপটির ন্যক্কারজনক চেহারা বেরিয়ে এসেছে যেন। এটি কি শুধুই নিও লিবারেল প্রণোদনা? আমার কাছে এটি একটি নতুন দিক উন্মোচিত করেছে রাজনীতি এবং সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায়। ট্রাম্পের ফ্যাকশনাল রাজনীতি কতটা সফল হবে ভবিষ্যতে জানি না; আপাতত এটি মার্কিনিদের বড় অংশটি প্রত্যাখ্যান করেছে এটাই বাস্তবতা। এরপরও আয়রনি হলো এই যে অর্ধেকের বেশি রিপাবলিকান সিনেটর এবং প্রতিনিধিরা বলেছেন, তাঁরা আবারও ট্র্যাম্পকে নমিনেট করবেন সুযোগ থাকলে। এটি কি রিপাবলিকান দলে নেতৃত্বের শূন্যতার ফল নাকি অর্থের ঝনঝনানির বিজয়ডঙ্কা? ঘটনাটি ভবিষ্যতে ঘটবে কিনা জানি না, তবে ট্রাম্পবাদ যে আমেরিকার রাজনীতিতে একটি জায়গা করে নিতে পেরেছে, এ মনোভাব তারই নিদর্শন। এটাই ড্যামেজ দেশটির জন্য।

আসলে মার্কিন রঙ্গমঞ্চের শিশুসুলভ অভিনেতা চেয়েছিলেন একটি ক্যু করে তাঁর মৃত্যুদৃশ্যকে জীবিত হয়ে ওঠার দৃশ্যে রূপান্তরিত করতে; হননি তিনি সফল, যদিও এর প্রভাব এবং প্রতিফলন রেখে গেছেন দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে। ট্রাম্পের শিশুসুলভ চেষ্টাটিকে আমি ‘ক্যু’ বলে মনে করি। কেন করি তার প্রক্রিয়াগত ছোটখাটো কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। ট্রাম্প নির্বাচনের সময় থেকেই বলে আসছিলেন নির্বাচনের ফলাফল অন্যরকম হতেই পারে না, এবং এটি ঘটলে তিনি মানবেন না। এ বিষয়টিকে আসলে তাঁর প্রতিপক্ষ বা আমেরিকার বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ খুব একটা পাত্তা দেয়নি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পচা শামুকে পা কেটেছে আমেরিকানদের। পরবর্তীতে ওয়াশিংটন ডিসিতে যে রায়টটি ঘটে গেছে তার মূল এবং প্রধান ইন্ধন এসেছে ট্রাম্পের নির্বাচন নিয়ে অসত্য এবং অসংলগ্ন বক্তব্য থেকে। উচ্ছৃঙ্খল জনতার মন (মব সাইকোলজি) বা আচরণের বিভিন্ন পর্যায়কে ব্যাখ্যা করার যে তত্ত্ব, তা থেকে বোঝা যায় ৬ জানুয়ারির ঘটনাটিকে ক্ষমতার শীর্ষ থেকে ফ্রেম করা হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো এ নিয়ে সিরিয়াস গবেষণা হবে।

তবে যা গড় আমেরিকানদের কাছে পরিষ্কার নয় তা হলো, এত বড় একটি ঘটনা ঘটে গেলো অথচ তা জানতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইন্টিলিজেন্স বা হোমল্যান্ড সিকিউরিটির বেশ কয়েকটি সংস্থা সবাই একসঙ্গে ব্যর্থ হলো কীভাবে? এখন পর্যন্ত একজন মহিলা এবং দু’জন পুলিশসহ ছয়জন গুলিতে নিহত হয়েছেন; এখনও পরিষ্কার জানা যায়নি এঁদের কারা গুলি চালিয়েছিল। এই গুলি কোত্থেকে এলো? আমি নিজেও অনেকটাই বিস্মিত। এটি কী করে হয়? এ ধরনের স্যাবোটাজ যদি ট্র্যাক করা না যায় তবে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির অর্থ কী তা বোধগম্য নয় মোটেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো তৃতীয় বিশ্বের কোন ছদ্ম গণতন্ত্রের (“সিওডো ডেমোক্র্যাসি”) দেশ নয় যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময়ই সরকারের অশুভ নিয়ন্ত্রণে থাকে পুরোটাই; অথচ ডিসির ঘটনাটি অনেকটাই যেন ক্ষমতার থার্ড ওয়ার্ল্ড সিন্ড্রোমকে তুলে ধরেছে। মার্কিন মিডিয়া যেসব দেশকে এ ধরনের ঘটনার উর্বর ভূমি মনে করে সেই পাকিস্তানেও পার্লামেন্ট ভবন আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি; কোনও দেশেই এটি ঘটেনি। এ লজ্জা আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তো বটেই, দেশের জন্যও একটি বিরাট ব্লো। কারণ, এ দেশটি পৃথিবীর অন্য সব দেশকে গণতন্ত্রের সবক দিয়ে থাকে নিয়ত।

এর আগে কেবল ১৮১২ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশ সেনাদের দ্বারা সিনেট আক্রান্ত হয়েছিল, আর এই ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি একই ব্যাপার ঘটলো স্বদেশিদের দ্বারা। রায়টারদের কাছে বর্ণবাদী কনফেডারেট ফ্ল্যাগ দেখা গেছে যথেচ্ছা; এই ফ্ল্যাগ ওড়ানো দেখে মনে হয়েছে এরা যেন ফিরে যেতে চায় সিভিল ওয়ারের বা নিদেনপক্ষে সিভিল রাইটস মুভমেন্টের আগের সময়ে; কনফেডারেট ফ্ল্যাগ এ দেশে রেডনেক বা বর্ণবাদী গোষ্ঠীর একটি সিম্বল বিশেষ আজকের আমেরিকায়। অনেক জায়গায় এই ফ্ল্যাগ ওড়ানোর ঘটনাটি বিচ্ছিন্নভাবে ঘটলেও ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের সামনে আমেরিকান গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আইডিয়ালকে নস্যাৎ করার যে সিম্বল সেই কনফেডারেট ফ্ল্যাগ প্রদর্শন এতটা নির্বিঘ্নে কীভাবে সম্ভব হলো সেটাই আমার মতো মানুষদের মাথায় আসছে না। আমার তো মনে হয় না বাংলাদেশে কোনও রাজনৈতিক মিছিলে পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শন করা সম্ভব, কিন্তু মার্কিন দেশে এটি দম্ভের সঙ্গে দেখিয়েছে রায়টররা। এটি কি শুধুই উদারতাবাদ? তাহলে কি ট্রাম্পের সমর্থনে ৬ জানুয়ারির রায়ট এলে সিভিল ওয়ার পূর্ববর্তী সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে শুধু? এটি কি সিভিলওয়ার-পূর্ববর্তী ন্যারেটিভের ফিরে আসা? আমার কাছে অন্তত এটিকে সে সময়ের এক ধরনের সিম্বলিক প্রতিনিধিত্ব (“সিম্বলিক রিপ্রেজেন্টেশন”) মনে হয়েছে। ট্র্যাম্প এবং তাঁর প্রশাসন সিভিল রাইটস আন্দোলনের ইতিহাস স্কুলে যেভাবে পড়ানো হয় তার সমালোচনা করেছেন; তারা এ দেশে মার্টিন লুথার কিং দিবসকে “স্বদেশপ্রেম দিবস” বা “প্যাট্রিয়টিক ডে” হিসেবে দেখানোর কথা বলেছেন। মোটা দাগে এটিও ট্রাম্পের একটি বর্ণবাদী আদর্শকে প্রতিফলিত করে। কাজেই আজ আমরা যে ‘ট্রাম্পবাদে’র কথা বলি এটি তারই একটি অনুষঙ্গ মাত্র।

৬ জানুয়ারি এবং তৎপরবর্তী ঘটনাবলিতে একটি আয়রনি দেখা গেলো মার্কিন ইতিহাসে। ১৯৪১ সালের ৬ই জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট বলেছিলেন, আমেরিকার জনগণ চারটি মৌলিক অধিকার সবসময়ই ভোগ করবে। এ চারটি অধিকারের মধ্যে প্রথমটিই হচ্ছে কথা বলার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, এবং শেষটি হচ্ছে ভীতি থেকে মুক্ত থাকার স্বাধীনতা। প্রথমটিরই অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের নির্বাচনি ব্যবস্থার মাধ্যমে, এবং এই যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সেটি ভয় থেকে মুক্ত থাকার স্বাধীনতাকেও নিশ্চিত করে অনেকটাই। অথচ ৮০ বছর পর ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি এ দুটি অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার একটি প্রবল চেষ্টা হয়েছে এক মহাভিলেনের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লিপ্সা থেকে; এ লিপ্সা এ জাতির সমস্ত অর্জনকে অস্বীকার করেছে চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে। ছয়টি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে এ রায়টে। এখন পর্যন্ত আশিটির বেশি চার্জ গঠিত হয়েছে এবং তিনশ’র বেশি রায়টারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত পর্দার অন্তরালের কুশীলবদের বিরুদ্ধে সরাসরি চার্জ দেওয়া হয়নি বলে আমার ধারণা।

তাহলে ৬ জানুয়ারি কি আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য শুধুই কালো দিন? না, অবশ্যই নয়। এই দিনটি দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ দেশের গণতন্ত্রের সৌন্দর্যটিও তুলে ধরেছে, যা থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। আমেরিকার মিডিয়া তো বটেই, কংগ্রেসের উভয় কক্ষের প্রতিনিধি এবং সিনেটররা এই ঘটনার বিরুদ্ধে যে অবস্থানটি নিয়েছেন সেটি আসলেই দেখার মতো। আমি এখানে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতাদের বক্তব্য দিচ্ছি না। কারণ, তাদের অবস্থানটি অনুমেয়। আমার সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের একটি ছোট্ট মন্তব্য, যা তিনি সিনেট প্রেসিডেন্ট হিসেবে দিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে পেন্স ট্রাম্পের প্রতিবিম্ব মাত্র; অন্য কথায়, ট্রাম্পের কথার বাইরে যাওয়া তার রীতি এবং স্বভাববিরুদ্ধ। সেই পেন্স সিনেটের স্থগিত হওয়া সেশন শুরুর আহ্বান জানিয়ে সিনেটরদের উদ্দেশে বললেন, “ভায়োল্যান্স কখনোই বিজয়ী হতে পারে না; স্বাধীনতাই কেবল জয়ী হয়; আসুন আমরা আমাদের কাজ (“২০২০ সালের নির্বাচন সার্টিফিকেশন”) শেষ করি।“ সিএনএন কর্তৃক প্রকাশিত জিওপি’র এক বিবৃতিতে দেখা যায়, তাঁরা সরাসরিই বলেছেন, “ট্রাম্প আসলে উন্মাদের মতো আচরণ করছেন (“হি ইজ আউট অফ হিজ মাইন্ড”)।

সিনেটে মেজরিটি নেতা ম্যাককোনেল, যিনি একজন প্রথিতযশা রিপাবলিকান এবং ট্রাম্পের নির্বাচন সম্পর্কিত অনেক বক্তব্যের সমর্থক, তিনিও আজ খুব শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। সিনেটে তার বক্তব্যে ম্যাককোনেল জানিয়েছেন, তারা ইতিহাসে ভিলেন হিসেবে পরিগণিত হতে চান না, এবং আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে তারা ধ্বংস হতে দিতে পারেন না। একটু বড় হলেও তার মন্তব্যের চুম্বক অংশটুকু এখানে না দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। ম্যাককোনেল পরিষ্কার করে বলেছেন, “সিভিল ওয়ারের সময় তারা আমাদের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি, এবং আমরা আমাদের কাজ করে গেছি; তারা ব্যর্থ হয়েছিল…আমরা অবশ্যই ২০২০ সালের নির্বাচনকে সার্টিফাই করবো; অপরাধমূলক কার্যকলাপ কখনোই গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না; আমাদের এর বিচার করতে হবে; কোনও অনুকম্পা নয়; এরা টগ, লুণ্ঠনকারী এবং সম্পত্তি বিনষ্টকারী” (অনুবাদটি আমার নিজের)। সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বলেছেন, এ ধরনের বিদ্রোহ আমাদের প্রতিষ্ঠানের চরম ক্ষতি (“গ্রেভ ড্যামেজ”) করে দেবে; একে প্রতিরোধ করতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্বাসে আমেরিকার জনগণ সবসময়ই দুই ভাগে বিভক্ত, এবং দেশটি অনেক রকমভাবে স্তরায়িত, কিন্তু একটি সমাজের টিকে থাকার জন্য এর প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে যে একতা বা সলিডারিটি দরকার হয়, সেটি প্রকাশিত হয়েছে আজকের আমেরিকার বিভিন্ন পর্যায়ে। সিএনএন বা এমএসএনবিসিসহ উদারনৈতিক মিডিয়া তো বটেই, ফক্সের মতো কট্টর রিপাবলিকান সমর্থক চ্যানেলও নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে গেছে এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তারা পরিষ্কার বলেছে, নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্পের দাবির যদি বিন্দুমাত্র সত্যতাও থাকে তবে তা নির্ধারিত হওয়ার উপায় এটি নয় কিছুতেই। আরও কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়টি হলো এই যে ফেসবুক, টুইটার, এবং ইউটিউব ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। এটিও আমেরিকান গণতন্ত্রের একটি প্রণিধানযোগ্য দিক। অন্যদিকে শুধু জিওপি নয়, রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকান ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা মাইক পেন্সকে আহ্বান জানিয়েছিলেন ট্রাম্পকে সংবিধানের ২৫ অ্যামেন্ডমেন্ট ব্যবহার করে ক্ষমতাচ্যুত করতে। এ ধরনের আহ্বানও আমেরিকার ইতিহাসে আর ঘটেছে কিনা জানি না।

সর্বশেষ যা ঘটেছে তা হলো, ট্রাম্প মার্কিন ইতিহাসের একমাত্র প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসিত হন নিম্নকক্ষে, এবং এটি সিনেটে উঠেছে, কিন্তু এখন নতুন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় এ বিষয়টি আপাতত স্থগিত আছে। ট্রাম্পের অভিশংসন যদি সিনেটের অনুমোদন পায়, তবে তিনি আর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। শোনা যাচ্ছে সিনেটে ১৭ জন রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে যোগ দেবেন ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে। সাংবাদিক জিমি কস্টার ভাষায়, “তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি নিজেকে এবং তাঁর প্রশাসনকে ক্রমাগত, এমনকি শেষ সময়েও অপমান করে গেছেন”।

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ৬ জানুয়ারি ২০২১-এর ঘটনাটি ছিল আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় পরীক্ষার দিন। মোটামুটি বলা যায়, একটি সাংস্কৃতিক আইডিয়াল হিসেবে গণতন্ত্র কতটা শক্ত এ দেশে, সেটিরও একটি পরীক্ষা হয়ে গেলো। দেশটির সামাজিক কাঠামোর মাঝে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের যে অবস্থান তার সাথে দেশটির অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের একটি সুদৃঢ় মিথস্ক্রিয়াই প্রমাণ করে আমেরিকান গণতন্ত্রের ভিত কতটা শক্ত। এটি মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্যও বটে, তবে আগামীতে ‘ট্রাম্পবাদ’ বা এ ধরনের নীতির সমর্থক আদর্শের গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করবে দেশটির গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। ৬ জানুয়ারি এ কারণেই মার্কিনিদের জন্য একটি এসিড টেস্টও ছিল।

লেখক: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, এলিজাবেথ সিটি স্টেট ইউনিভার্সিটি (নর্থ ক্যারোলিনা)।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ