X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

কে সঠিক,  র‌্যাব না পুলিশ?

আমীন আল রশীদ
১২ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:২৬আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:২৬

আমীন আল রশীদ
পুরান ঢাকার আলোচিত সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের ছেলেকে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত সাজা দিলেও এই মামলায় পুলিশ তাকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানিয়েছে। ফলে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। তার আগে একটু পেছনে ফেরা যাক।

গত বছরের ২৪ অক্টোবর রাতে ধানমন্ডি এলাকায় নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্টকে মারধরের ঘটনায় হাজি সেলিমের পুত্র ইরফান সেলিমসহ সাত জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা হয়। পরদিন পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাটের দেবীদাস লেনে হাজি সেলিমের বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব-৩-এর একটি দল। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী অভিযানে সেখান থেকে পিস্তল, গুলি, এয়ারগান, ওয়াকিটকি, বিদেশি মদ উদ্ধারের কথা জানায় র‌্যাব। অবৈধ জিনিসপত্র রাখার দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত সঙ্গে সঙ্গে ইরফানকে ছয় মাসের এবং তার সহযোগী জাহিদ মোল্লাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন।

কিন্তু এর প্রায় আড়াই মাস পর মাদক ও অস্ত্র আইনে র‌্যাবের করা দুটি মামলায় দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ইরফান সেলিমকে বাদ দেওয়ার আবেদন জানায় পুলিশ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, র‌্যাব তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে সাজা দিয়েছিল কীসের ভিত্তিতে? র‍্যাবের অভিযানটি কি তাহলে সঠিক ছিল না বা যে অপরাধে সাজা দেওয়া হয়েছিল সেটি কি মিথ্যা? অভিযানের দিন যে পিস্তল, গুলি, এয়ারগান, ওয়াকিটকি ও বিদেশি মদ উদ্ধারের দাবি করা হলো এবং যেসব ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হলো, তা কি ভুল? তাহলে সেই অস্ত্র ও মাদক কার?

পুলিশ বলছে, মামলায় মাদক ও অস্ত্রে ইরফানের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তথ্যগত ভুল ছিল। সে কারণে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তার অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, পুলিশের এই দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে ইরফানকে এই আড়াই মাস জেল খাটতে হলো কেন? নাকি পুলিশ এখন ইরফানকে অব্যাহতি দেওয়ার যে আবেদন জানিয়েছে, তার পেছনে রাজনৈতিক বা অন্য কোনও চাপ আছে? বলা হয়, যেখানে অপরাধ ও ক্ষমতা, সেখানেই অর্থ। সুতরাং শুধু ক্ষমতাই নয়, এখানে টাকা পয়সার লেনদেনের বিষয় যুক্ত রয়েছে কিনা— তাও প্রশ্নাতীত নয়।

রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুলিশেরই এলিট ফোর্স র‌্যাব। সুতরাং তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত একজনকে একটি অপরাধের দায়ে সাজা দিলেন, অথচ পুলিশ সেই আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার যে আবেদন জানাচ্ছে, তাতে কি র‌্যাব ও পুলিশের মধ্যে কোনও টানাপড়েনের শঙ্কা রয়েছে? বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, ‘সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে হাজি সেলিমের বাসায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। কিন্তু পরে পুলিশ তদন্ত করে যা পেয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এটি এখন আদালতের বিচারিক বিষয়।’

তবে ইরফান সেলিমের এই ইস্যুতে যে প্রশ্নটি বড় করে সামনে আসছে তা হলো, কে সঠিক, র‌্যাব না পুলিশ? এ বিষয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে এরকম, জমিজমা নিয়ে দুজন লোকের মধ্যে বিরোধ চলছে। তারা রাজার কাছে গেছেন।

বাদী: রাজামশাই, এই জমি আমার। কিন্তু বিবাদী জোর করে নিজের বলে দাবি করছে।
রাজা: তুমি ঠিক কথা বলেছো।
বিবাদী: না রাজা, এ জমি আমারই।
রাজা: তুমি ঠিক।

পাশ থেকে তখন উজির বললেন: রাজা, একই সঙ্গে তো দুজনই ঠিক হতে পারে না।

রাজা বললেন: তুমিও ঠিক।

মনে রাখা দরকার, ইরফান সেলিম ইস্যুতে পুরো ঘটনার সঙ্গে যুক্ত লোকগুলো ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষ। আর ক্ষমতাবানদের কিছু দম্ভও থাকে এবং ব্যতিক্রম ছাড়া ক্ষমতাবানরা এই দম্ভ প্রকাশ করেন। হাজি সেলিমের ছেলে যে একজন লেফটেন্যান্টকে মারধর করলেন, সেটি ছিল তার ক্ষমতার দম্ভ। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তার কিছুই হবে না বা তিনি আইনের ঊর্ধ্বে। পক্ষান্তরে এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার সূত্র ধরে যেভাবে, যে প্রক্রিয়ায়, যে স্টাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাজি সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে, অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার এবং তাৎক্ষণিকভাবে ইরফান সেলিম ও তার সহযোগীকে সাজা দিয়েছে—সেটিও প্রশ্নাতীত নয়।

প্রশ্ন হলো, ইরফান সেলিম যদি নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্টের বদলে একজন সাধারণ মানুষকে, বা ধরা যাক সমাজের কোনও একজন সম্মানিত নাগরিককেও এভাবে মারধর করতেন এবং তিনি যদি কোনও সশস্ত্র বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য না হতেন, তাহলে কি র‌্যাব তাৎক্ষণিকভাবে হাজি সেলিমের বাসায় এরকম একটি অভিযান পরিচালনা করতো? কারণ প্রশ্নটা আইনের শাসনের। ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে’— কথাটি আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তি এবং রাজনীতিবিদরা যত সহজে বলেন, আইন যে আসলে নিজস্ব গতিতে চলে না, বরং ক্ষমতা ও অর্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সে বিষয়ে দ্বিমত কম।

স্মরণ করা যেতে পারে, ইরফান সেলিমের গ্রেফতার ও সাজা পাওয়ার পর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ও সোশ্যাল মিডিয়ায়ও অনেকে এ ঘটনাকে ‘প্রকৃতির বিচার’ বলে মন্তব্য করেছেন। অনেকে বলছেন, এটা আইনের শাসনের উদাহরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, যিনি একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা, ড. সেলিম মাহমুদ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার রাষ্ট্রে গুণ্ডামি-মাস্তানির সুযোগ নেই’। ওই সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও বলেছিলেন, ‘অপরাধীর সামাজিক পরিচয় যাই হোক, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না’। কিন্তু যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এসব মন্তব্য করেছেন, সেই অপরাধের সঙ্গে ইরফান সেলিম যুক্ত নন দাবি করে পুলিশ এখন তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার যে আবেদন করলো, তাতে কী প্রমাণিত হলো— আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে?

উল্লেখ্য, হাজি সেলিমের ছেলেকে পুলিশ যেদিন মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানায়, তার পরদিনই গণমাধ্যমের শিরোনাম: ‘নারায়ণগঞ্জে মৃত উল্লেখ করা কিশোরী দিশামনির ফিরে আসার ঘটনায় তিন আসামিকে হুমকি দিয়ে জবানবন্দি নিয়েছে পুলিশ। আদালতে এমন প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি।’ কাছাকাছি সময়ে গণমাধ্যমের আরও কয়েকটি খবরের শিরোনাম এরকম: বরিশালে পুলিশি নির্যাতনে একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর নিহত হওয়ার অভিযোগে মামলা; ডাকাতি করতেন দুই এএসআই, সঙ্গে নিতেন সরকারি অস্ত্র; ডিবির তদন্তে বেরিয়ে এলো, ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়েছিল র‌্যাব।

প্রশ্ন হলো, আইন যদি তার নিজস্ব গতিতে চলে তাহলে ২০১৩ সালে হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন পাসের পরেও কী করে পুলিশের নির্যাতনে নাগরিকদের নিহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়? আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে কী করে পুলিশ হুমকি দিয়ে এমন জবানবন্দি আদায় করে যে জবানবন্দির ওপরে রায় হলে আসামিদের ফাঁসি হয়ে যেতো? আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে র‌্যাব কী করে এবং কেন সাদা পোশাকে ডিবি পরিচয়ে ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে যায়? আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে পুলিশ কী করে সরকারি অস্ত্র নিয়ে ডাকাতি করতে পারে? নাকি এগুলো ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’?

লেখক: সাংবাদিক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ