সে জানে যে দিলে মুচলেকা
তাকে তোলা হবে আশমানে
টিপ সই মেরে সেই লেখা
তাই সে তখনই লিখে আনে
সে বলে যে এতে নেই
কারও কিছু দোষ
সব মুখই জেনো মুখ নয়
কিছু মুখ কিছু বা মুখোশ
পালিশ রয়েছে তাই ধরা
যায় না যে এটা নয় খাঁটি
সোনার জলে যা রং করা
আসলে তা পাথরের বাটি
তাই নিয়ে চলে কাড়াকাড়ি
কারও মুখে নেই কোনও ভার
তামাশা জমেছে আজ ভারি
বাটি বেচে গুদাম সাবাড়
(মুচলেকা/ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
যখন ক্লাস টেনে পড়ি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর এই কবিতা নাড়িয়ে দিয়েছিল আমাকে। কী চমৎকার অন্ত্যমিল! শুধু অন্ত্যমিলের জন্যই কি বারবার বেজে উঠত কানে? তা নয়। কবিতাটি এখনও বয়ে চলি মনের ভিতরে। এর মর্মার্থই তবে নাড়া দিয়েছিল কি? সব মুখই জেনো মুখ নয় কিছু মুখ কিছু বা মুখোশ! সাংঘাতিক লাইন! সব মুখ যে আসলে মুখ নয় তার মধ্যে মুখোশও মিশে রয়েছে কিছু কিছু—এ লেখা তরই কথা বলে আর আমাদের সতর্ক করে। সহজ ভাষায়, সহজ ভাবে কবিতার ভেতর দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবন কথা লিখে রেখেছেন নীরেন্দ্রনাথ!
২০০৪ সালে শ্যামলকান্তি দাশ সম্পাদিত কবিসম্মেলন পত্রিকায় কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ পায়। সেই সাক্ষাৎকারের ভূমিকায় লেখা হয়েছিল ‘সব চলে যায়, কীর্তিনাশা জামা পালটায়, রাষ্ট্র মুখ খুলে রেখে মুখোশ পরে নেয়। কিন্তু কবির থাপ্পড় আজও থাপ্পড়।’ কবিতা যে কখনও থাপ্পড় হয়ে উঠতে পারে, তার আঁচ পেয়েছিলাম সেখানে।
মাধ্যমিকে পাঠ্যে ছিল ‘উলঙ্গ রাজা’। নীরেন্দ্রনাথ পারিবারিকভাবেও আমাদের স্বজন ছিলেন। বাবার সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল খুবই। আমার জন্মের বহু বছর আগে ১৯৮২ সালে অতিথি হয়ে এসেছিলেন আলিপুরদুয়ার কলেজে। সেই সময় রাজাভাতখাওয়ায় বেড়াতে যাওয়া—বাবার মুখে শুনেছি। বাবার ডায়েরিতে পেয়েছি নীরেন্দ্রনাথের কবিতা—
বাজে কগজের টুকরোগুলিকে
গোল্লা পাকিয়ে পরপর
জানলা তাক করে ছুড়ে মেরেছিলুম বটে—
কিন্তু তার একটাও বাইরে গেল না,
জানলার শিকে আটকে গিয়ে প্রত্যেকটাই ফের
ঘরের মধ্যে ফিরে এল।
দেখে, আমার এক বহুদর্শী বন্ধু বললেন,
বাজে কাগজের বদলে একটা
কারেন্সি নোটকে যদি
গোল্লা পাকিয়ে ওইভাবে ছুড়ে মারতে, তো
সেটা ঠিক বেরিয়ে যেত
সত্যিই তা-ই
যা-কিছু দামি, তার একটাও ফিরে আসে না।
ফিরে আসে শুধু দেশলাইয়ের
পোড়া কাঠি, বাতিল রসিদ, নোংরা ঠোঙা
গোল্লা পাকানো কাগজগুলি
যা জমতে জমতে আমার ঘরের মধ্যে এখন আর
পা রাখবার জায়গা পাই না।
(যা ফিরে আসে/ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
২০০৮ সালে প্রকাশ পেয়েছিল ‘আমার সময়’ পত্রিকায়। এ লেখা লিখতে গিয়ে তা আমার কাছে ফিরে এলো। এভাবেই কবিতা ফিরে আসে জীবনে। মনে আছে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলায় কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিক। গেলাম কবিতা পড়তে। সেই সময় আকাদেমির সভাপতি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ভেবেছিলাম দেখা পাবো। কিন্তু দেখা হলো না। পরে তাঁর দেখা ও সঙ্গ পেয়েছি সে বছরই জুলাই মাসে। আমি তখন কলকাতাবাসী। তাঁর বাঙ্গুরের বাড়িতে যেতে হল ২০১২ সালে বাবার নতুন বই দিতে। মনে আছে যাওয়ার আগে ফোনে বলেছিলেন, নির্দিষ্ট স্টপেজে নেমে কোনও বাঙালি রিকশাওয়ালাকে বলেতে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বাড়িতে যাব। বললামও তাই। আর পৌঁছে গেলাম তাঁর দরজায়। কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুললেন তিনি। সদ্য মারা গিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রয়াণলেখ লিখছিলেন তিনি। তার মধ্যেই কথা হল কিছুক্ষণ। কথাগুলোর নির্যাস আমি এখনও টের পাই।
'কোনও শিল্পীই তাঁর ভাবনাকে একেবারে সর্বাংশে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিম্বিত করে দেখাতে পারেন না। কবি পারেন না, চিত্রকর পারেন না, ভাস্কর পারেন না। ভাবনা ও রূপের মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য সর্বক্ষেত্রে থেকেই যায়। শুধু কবি বলে কথা নেই, তৃপ্তিহীনতা তাই শিল্পী মাত্রেই নিয়তি।" এ কথা কথা রয়েছে তাঁর 'কবিতার কী ও কেন' বইয়ে। তবু যে নিয়মিত লেখার চেষ্টা করতে হবে আমাদের, সে কথাও মনে করিয়ে দিতেন নীরেন্দ্রনাথ। 'লিখতে হলে বসতে হবে'—দেখা হলে বরাবর বলতেন তিনি। একটি কবিতায় লিখেছেন—
সন্ধ্যারাতে চতুর্দিকে চেঁচিয়ে মরে ফেউ।
মরুক। তোর কাজে
বিঘ্ন কেন ঘটবে, তোর হাতের কলম কেউ
কাড়তে পারবে না যে।
দৃশ্য বটে পালটে যায়, রাত্রি হয় ঘোর।
তখনও ফেউ ডাকে।
ডাকুক, ডেকে মরুক। তাতে ভাবনা নেই, তোর
কলম যদি থাকে।
ঘরের মধ্যে একলা তুই, বাহিরে ঘুরে যায়
আতঙ্কের ঢেউ;
এ দিকে দেখি টেবিলে আলো, ওদিকে শুনি ঠায়
চেঁচিয়ে মরে ফেউ।
(ফেউ/ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
আজ থেকে দশ বারো বছর আগে আলিপুরদুয়ারে বসে এইসব লেখা পড়েই ছন্দের কাছাকাছি চলে যেতাম। আর কলকাতায় গিয়ে পড়েছি 'কবিতার ক্লাস'। এত সহজে ছন্দ বোঝানো যায়? স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর অক্ষরবৃত্তকে স্পর্শ করতে সত্যই সাহায্য করেছে এ বই। ছন্দ শুধু কবিতায় নয়, যে কোনও কিছু মধ্যেই থাকে। জামার বোতাম আটকানো কিংবা বিড়ি ধারানোর মধ্যেও যে একটা কায়দা বা ছন্দ থাকে এ বই পড়েই তার ধারনা মিলেছে। নীরেন্দ্রনাথের সহজতার কাছে নম্র হয়ে শঙ্খ ঘোষ চিঠি লিখেছিলেন: ‘কাজটা কি ভালো করলেন? এত সহজেই যে ছন্দ-কাণ্ডটা জানা হয়ে যায়, এটা টের পেলে ছেলেমেয়েরা কি আর স্কুল কলেজের ক্লাস শুনবে? ক্লাস মানেই তো সহজ জিনিসকে জটিল করে তুলবার ফিকির!’
এই সহজতার কাছে আমিও ফিরতে চেয়েছি বারবার। আমাদের দেখাশোনা থেমে যায় ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর। যিশুর জন্মদিনেই আড়ালে চলে যান 'কলকাতার যিশু'র কবি।