X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতির সৃজনশীলতায় অবনমন

তুষার আবদুল্লাহ
১৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৩০আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৩১

তুষার আবদুল্লাহ স্কুল বেলার শখ ছিল পোস্টার সংগ্রহ করার। দেয়ালে কোথাও কাউকে পোস্টার সাঁটাতে দেখলেই গিয়ে হাত পাততাম। কত আকারের পোস্টারের ছিল। কোনও কোনও পোস্টার আমাকেই ঢেকে ফেলতো। পোস্টারের রঙ, ছবি ও লেখার ভাষা টানতো আমাকে। রাজনৈতিক দলের ভোটের, রাজনৈতিক কর্মসূচির পোস্টার যেমন ছিল, তেমনই ছিল ওয়াজ মাহফিল, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং পণ্য বিক্রির পোস্টার। রাজনৈতিক দলের পোস্টারগুলো সরাসরি ভোট চাইতো অথবা আহ্বান জানাতো হরতাল বা সমাবেশ, সম্মেলনে যোগ দেওয়ার। আওয়ামী লীগ, বিএনপি’র মতো দলগুলোর পোস্টারে নিজেদের আদর্শিক স্লোগান, প্রতিষ্ঠাতা বা মূলনেতার ছবি আর প্রতীক ব্যবহার হতো শুধু। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বেলাতেও তাই। বাম রাজনৈতিক দলগুলোর পোস্টারে কালো আর লালের প্রাধান্য থাকতো। স্লোগানের মধ্যে থাকতো বিপ্লবের আহ্বান। স্বৈরাচার পতনের পর ১৯৯০-এর পর মূল নেতার আবক্ষ বা নানা ভঙ্গিমার ছবি দিয়ে পোস্টার তৈরি হতে থাকে। এর আগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় আমরা হাতে লিখে পোস্টার তৈরি করেছি। ব্যক্তিগতভাবে বাড্ডা বাস্তুভিটা উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির জন্যও হাতে লেখা পোস্টার তৈরি করতে হয়েছিল। ক্রেতা স্বার্থরক্ষা আন্দোলন করতে গিয়েও লিখতে হয়েছিল পোস্টার। সেই সময়কার নিউজপ্রিন্ট বা অফসেট কাগজের পোস্টারের নান্দনিকতা মুগ্ধ করতো গ্রাম ও নগরের মানুষদের। পোস্টারের পাশাপাশি সেই সময়কার দেয়াল লিখনও ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, নান্দনিক। স্বৈরাচার পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক দুর্নীতির খতিয়ান পোস্টার আকারে ছড়িয়ে দিতে থাকে। সেই সঙ্গে শুরু হয় পোস্টারে একাধিক নেতার ছবি অন্তর্ভুক্তি। ১৯৯৬ সাল অবধি পোস্টারের নন্দন দিকটি অক্ষুণ্ন ছিল। এমনকি ১৯৯৪ সালের ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দেয়াল লিখন ও পোস্টারেও ছিল মুগ্ধতা। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ভোটকে সামনে রেখে দেখা গেলো, সম্ভাব্য প্রার্থীরা শুভেচ্ছা বিনিময় শুরু করলেন। নিজেদের ছবি বড় আকারে দেওয়া এবং একাধিক নেতা কর্মীর ছবির সংযুক্তির চল বলা যায় তখন থেকেই। ছবি’র সংযুক্তি যতো বাড়তে থাকে ততোই কমতে থাকে পোস্টারের পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর রূপ।

পোস্টারে শীর্ষ নেতা, নেত্রী, তাদের উত্তরসূরি, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলা, গ্রাম, ওয়ার্ডের নেতারা। যেকোনও দিবস ও উপলক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট ও পদ প্রত্যাশীরা এমন পোস্টার সেঁটিয়ে দিচ্ছেন দেশজুড়ে। পোস্টার দেখে বুঝার উপায় নেই কে ভোট চাইছেন বা কে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। পোস্টার থেকে দলীয় আদর্শ ও মতবাদ উধাও। পোস্টার মানে হচ্ছে নেতা তোষণ। সেখানেও বিপত্তি, কাকে রেখে যে কাকে তোষণ করা হবে। সবাইকে সন্তুষ্ট রাখতে গিয়ে পোস্টার বীভৎস্য রূপ নেয়। জনগণ পোস্টার দেখে এখন আর রাজনীতির গতি প্রকৃতির আভাস পায় না। তার শিরায় কোনও আদর্শ তরঙ্গায়িত হয় না। বরং শহর গ্রামের দৃশ্য দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পোস্টার।

কেবল বাস্তব জগতের দেয়ালই নয়, পরাবাস্তব বা ভার্চুয়াল জগতের দেয়ালেও দেখা দিয়েছে এমন দূষণ। এখানেও সেই পরিবার ও নেতা কেন্দ্রিক তোষণ। সকল ভাই বোনই সাদা মনের। সকলেই স্বপ্নদ্রষ্টা। পদ প্রাপ্তি, পদে যোগদান, জন্মদিন, কারও পরিজনের মৃত্যু কিংবা যেকোনও ছুঁতো তুলেই চলে সহমতের স্লোগান, জয়ধ্বনী। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই জিকির আজকারে আদর্শ, শুভচিন্তা, আত্মসমালোচনার অনুশীলন উধাও। অবয়বপত্রজুড়ে চলে সহমতের মাতম, প্রতিপক্ষকে হেয় করার নোংরা প্রতিযোগিতা। সার্বিকভাবে আমাদের রাজনৈতিক অনুশীলনের জায়গাটিতে যে আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নেই, সেখানে দলীয় আদর্শ নিয়ে কোনও সংলাপ নেই তা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। মূলকথা হলো সৃজনশীলতা থেকে আমাদের রাজনীতি অনেকটা দূরে সরে গেছে। সেটা মিছিলের স্লোগান এবং অবয়বপত্রের দেয়াল লিখন দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। সৃজনশীলতার উপস্থিতির এই যে অনুপস্থিতি তার আরেকটি কারণ নেতা তৈরির প্রক্রিয়ার কলটি বন্ধ থাকা। প্রায় তিন দশক পর একটি কল পরীক্ষমূলকভাবে চালু হলে, বন্ধ রাখার কুফল আঁচ করতে পারি। একই কারণে রাজনীতিতে  ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গুলোকেও লম্ফজম্ফ করতে দেখা যাচ্ছে বেশি।  রাজনীতির সৌন্দর্য দেয়াল লিখন, কার্টুন কিংবা ভাস্কর্য এখন রাজনীতিতেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কারণ একটাই সৃজনশীলতা থেকে রাজনীতির দূরে সরে যাওয়া। আদর্শ থেকে রাজনীতিতে ব্যক্তি মুখ্য হয়ে ওঠা। ব্যক্তিই আদর্শের প্রবর্তক, আদর্শের মাধ্যমে ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, এই মন্ত্রটিও যেন রাজনীতির মানুষেরা ভুলে বসে আছে। রাজনীতির এই ক্রান্তিলগ্নেও আমরা আদর্শ ও সৃজনশীলতা বিমুখ। যা বিজয়ের ৫০ উদযাপন করতে গিয়েও, আমাদের সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেয়, আমরা কি সত্যি পথ ভুল করে বসে আছি? অস্বীকার করছি না। ভুল পথে কিছুটা হেঁটেছি ঠিকই, কিন্তু সঠিক পথ থেকে খুব দূরে নয়। এখনও সময় আছে, ঠিক পথে ফিরে যাওয়ার । ৫০ -এ এসে আর সঠিক পথে হাঁটতে দেরি না করি। শুরু হোক সুন্দর বাংলাদেশের পথে হাঁটা।

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ