X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নুর-সাকি: নয়া মেরুকরণ?

আমীন আল রশীদ
০৬ ডিসেম্বর ২০২০, ১৬:০৬আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২০, ১৬:০৭

আমীন আল রশীদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেসব তরুণ নেতাকে একটু ভিন্ন চোখে দেখা হয়, তাদের মধ্যে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর অন্যতম।
জোনায়েদ সাকি অপেক্ষাকৃত ছোট দলের নেতৃত্ব দিলেও গণমাধ্যমের ভাষায় তার ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ তৈরি হয়েছে নিয়মিত টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নিয়ে সাহসী বক্তব্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে নুরুল হক নুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি হওয়ার আগে থেকেই সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে। বলা চলে, এই নেতৃত্বই তাকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ভিপি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু ভিপি হওয়ার পর থেকেই তিনি একাধিক ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে যেভাবে প্রতিনিয়ত মার খেয়েছেন—সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিরল। তার মতো আর কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি থাকা অবস্থায় এরকম মার খেয়েছেন বা নাজেহাল হয়েছেন—তার নজির নেই। কেন নুরের এই পরিণতি—সেই আলোচনা নানা সময়ে হয়েছে। তবে এবার তিনি নতুন করে আলোচনায় এসেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার ইস্যুতে।

পয়লা ডিসেম্বর বাংলা ট্রিবিউনের একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল: ‘জোনায়েদ সাকি ও নুরের নেতৃত্বে নতুন জোট আসছে।’ খবরে বলা হয়, বর্তমানে আলাদা সংগঠনের নেতৃত্ব দিলেও নতুন একটি দল বা জোট করার চিন্তা-ভাবনা করছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর । তাদের এই প্রক্রিয়ায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামে একটি সংগঠনের দায়িত্বশীলরা যুক্ত রয়েছেন বলেও খবরে উল্লেখ করা হয়।

প্রসঙ্গত, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও তিনি অনেক বছর ধরেই সরকারের নানা নীতি ও কর্মকাণ্ডের একজন সমালোচক এবং ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামে যে সংগঠনটি নুর ও সাকির সঙ্গে রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে, সেই সংগঠনটির সংবিধান ও রাজনৈতিক ইস্যুতে নানা তৎপরতাকে অনেক সময় সরকার ভালো চোখে দেখেনি। শুধু তা-ই নয়, এই সংগঠনের একজন শীর্ষ ব্যক্তি দিদারুল ভূঁইয়াকে করোনাকালে ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের ইস্যুতে কথিত গুজব  ছড়ানোর অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতারও করে পুলিশ। যদিও পরে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ভিপি নুর ও সাকি যদি কোনও জোট গঠন করেন, সেটি সরকারবিরোধী জোট হিসেবেই বিবেচিত হবে।

রাজনীতিতে নানা কারণে জোট হয়। তার মধ্যে প্রধান কারণ নির্বাচন। যেমন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও আটটি দল মিলে গঠন করেছিল ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’। সেই জোটে গণসংহতি আন্দোলনও রয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, ভিপি নুর ও জোনায়েদ সাকি যদি সত্যিই কোনও জোট গড়ে তোলেন, তাহলে সেই জোট আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দলের বিপরীতে ভোটের রাজনীতিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। এমনকি বিএনপির মতো দলও যদি প্রচ্ছন্নভাবে এই জোটকে সমর্থন দেয়, তারপরেও না। কারণ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ সুযোগ পেলে মূলত ভোট দেয় প্রধান দুই দলকে। বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনের চরিত্র যেহেতু ভিন্নরকম ছিল, তাই সেখানে কতটুকু জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে—তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, সাধারণ হিসাবে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি হলেও জাতীয় সংসদে এখন প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। এটি ভোটের রাজনীতির স্বাভাবিক হিসাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সেটি অন্য তর্ক।

প্রশ্ন হলো, সাকি ও নুর কি আসলেই কোনও জোট করছেন বা করলে তাদের উদ্দেশ্য কী? সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা? বিএনপির মতো দলই যেখানে রাজপথে বড় কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ—সেখানে এই দুই তরুণ কী করতে পারবেন? তাদের আন্দোলনের ইস্যু কী হবে? তাদের এই আন্দোলনে জনগণ কতটা সাড়া দেবে?

নুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মুহসিন হলের উপমানব উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে ছাত্রলীগের সঙ্গেই তার বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং তাকে অনুপ্রবেশকারী বলেও অভিযুক্ত করা হয়। গত জুন মাসে নুর তরুণদের নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন। ফেসবুক লাইভে এসে তিনি বলেন, তিনি আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতি করেননি, করবেনও না। তাই নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্যে যুব, শ্রমিক ও প্রবাসী অধিকার পরিষদ গঠন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

নুরের দাবি, তরুণদের নেতৃত্বে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক ধারা তৈরি করতে চান।  অর্থাৎ নুর বর্তমানে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও দলের সদস্য না হলেও তিনি রাজনীতিতে যুক্ত আছেন। কিন্তু নতুন দল গঠন করে নির্বাচন করতে চাইলে তাকে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। নিবন্ধনের প্রক্রিয়া বেশ জটিল। নির্বাচন কমিশন অফিশিয়ালি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও সরকারের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া কোনও দলের নিবন্ধন পাওয়া কঠিন শুধু নয়, বলা যায় অসম্ভব। সুতরাং ভিপি হওয়ার পর থেকেই নুর যেভাবে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে রয়েছেন, তাতে তিনি কোনও দল গঠন করলে খুব সহজে সেটির নিবন্ধন পাবেন না। বরং যদি সত্যিই তিনি কোনও দল গঠন করেন এবং নিবন্ধনের আবেদন করেন, নিশ্চিতভাবেই এ কথা বলা যায় যে, তাকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত যেতে হবে।

উল্লেখ্য, জোনায়েদ সাকির দল গণসংহতি আন্দোলনেরও নিবন্ধন নেই। তারা নিবন্ধনের আবেদন করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধিত করেনি। তাদেরও উচ্চ আদালতে যেতে হয়েছে এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে গণসংহতি আন্দোলনকে নিবন্ধন দিতে নির্বাচন কমিশনকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন উচ্চ আদালত। একইসঙ্গে দলটির নিবন্ধন না দেওয়া সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু এখনও দলটি নিবন্ধন পায়নি। গত ২ জানুয়ারি জোনায়েদ সাকি অভিযোগ করেন, উচ্চ আদালত তাদের পক্ষে রায় দিলেও সরকার নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের নিবন্ধন আটকে রেখেছে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সাকি ও নুর যদি নতুন কোনও জোট গঠন করেন এবং সেই জোটের লক্ষ্য যদি হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন—তাহলে সেই পথ খুবই বন্ধুর। নিবন্ধন না পেলে তাদেরকে বড় কোনও দলের অংশ হয়ে ভোটের মাঠে খেলতে হবে। প্রশ্ন হলো আসলেই কি এই দুজনের জোট হচ্ছে?

গণমাধ্যমের খবর বলছে, চূড়ান্তভাবে দল করার আগে যৌথভাবে কর্মসূচি পালন করবেন তারা। গত ২৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে তারা একটি যৌথ সমাবেশ করেছেন। সেখানে ভাসানী অনুসারী পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, ছাত্র-যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদ এবং রাষ্ট্রচিন্তার সদস্যরা অংশ নেন।

গণমাধ্যমের খবরে এমনটিও বলা হচ্ছে যে, নুরের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে এরইমধ্যে গণসংহতি আন্দোলনের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যদিও দায়িত্বশীল নেতারা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

এ বিষয়ে জোনায়েদ সাকি গণমাধ্যমকে বলেছেন, তারা ভবিষ্যতে একসঙ্গে কাজ করার কথা ভাবছেন। আলোচনা চলছে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা চলছে। আর জোনায়েদ সাকির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার প্রসঙ্গে নুর বলেন, প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। একটি যৌথ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে একসঙ্গে পথচলা শুরু হয়েছে। তবে দল বা জোট গঠনের সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।

তবে সত্যিই যদি এই দুই নেতা জোটবদ্ধ হন, তাহলে সেটিকে যে সরকারবিরোধী ফ্রন্টগুলো ইতিবাচক হিসেবে দেখবে, এটিই স্বাভাবিক। কারণ দেশে বামপন্থী দলগুলোর সেরকম ভোট না থাকলেও ভিপি নুরের ব্যক্তিগত ইমেজ যেকোনও দল বা জোটের জন্য কিছুটা সহায়ক হবে। যদিও সেটি শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে কতটুকু অনুরণন তুলবে, তা এখনই বলা মুশকিল। তাছাড়া দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার যে চেষ্টার কথা জোনায়েদ সাকি বলেছেন, সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে যে ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে হবে, সেটি বাস্তবায়নের সুযোগ ও সক্ষমতা তাদের রয়েছে কি না—সেটি আরও বড় প্রশ্ন। কারণ দেশে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ না হলেও এর সুযোগ যেভাবে সংকুচিত করা হচ্ছে; এমনকি সম্প্রতি রাজধানীতে মিছিল মিটিং করতে গেলে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে বলে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং লাউডস্পিকার ও সাউন্ড সিস্টেমসহ মাইক ব্যবহারে সরকার যেভাবে কঠোর হচ্ছে, তাতে নুর ও সাকি জোট গঠন করলেও সেই জোট রাজনীতির সাগরে কতটুকু ঢেউ তুলতে পারবে—তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
প্রসঙ্গ ‘অলক্তক’
প্রসঙ্গ ‘অলক্তক’
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে বাজার কমিটির সহযোগিতা চায় এফবিসিসিআই
অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে বাজার কমিটির সহযোগিতা চায় এফবিসিসিআই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ