X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনৈতিক উন্নয়ন বনাম আগামীর বাংলাদেশ

লীনা পারভীন
০৮ নভেম্বর ২০২০, ১৭:৩৫আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২০, ১৭:৩৬

লীনা পারভীন বলা হয়ে থাকে আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধাভোগী একটি দেশ। বর্তমান জনগোষ্ঠীর ৬০ ভাগ হচ্ছে তরুণ ও যুব সমাজ; যাদেরকে ঘিরে অঙ্কিত হচ্ছে আগামীর বাংলাদেশের চিত্র। আর কয়েকদিন পরেই আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করবো। নেওয়া হয়েছে ব্যাপক পরিকল্পনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার ইতোমধ্যেই সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সেক্টরভিত্তিক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য যেসব সূচকের উন্নয়ন প্রয়োজন, তার জন‌্য নেওয়া হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনা।
দেশ এখন ডিজিটালি কানেকটেড। আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে দেশের প্রতিটি জায়গায়। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন প্রায় ১০ কোটি আর মোবাইল ব্যবহারকারী প্রায় ১৬ কোটি। মানুষের জীবন এখন চলছে ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায়। দেশের এক কোণে বসে আরেক কোণের সেবা পেতে এখন আর যেতে হয় না বহুদূর। ঘরে বসেই হাতের ডিভাইসটির মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্বের সংবাদসহ নানান সুবিধা।

আধুনিকতা আসেনি কোথায়? জীবনযাত্রার মান বেড়েছে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে। দেশ এখন স্বপ্ন দেখছে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে বিস্ময়কর উন্নয়নের রোল মডেল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। করোনাকালীন সময়ে যখন গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক দিক দিয়ে হিমশিম খাচ্ছে টিকে থাকতে, সেখানে বাংলাদেশ একমাত্র ব্যতিক্রম যে পেছনে ফেলে দিচ্ছে ভারতের মতো একটি শক্তিকে।
এমন অনেক অনেক উন্নয়নের উদাহরণ এখন আমাদের হাতে। দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে তখন যাদের জন্য এ উন্নয়ন অর্থাৎ যে জনগোষ্ঠী এর সুবিধাভোগী, তাদের অবস্থান কোথায়? সরকার তো কেবল চালক হিসেবে কাজ করছে, কিন্তু এর প্রকৃত উপকারভোগী হচ্ছে এদেশের আপামর জনতা। অথচ আমরা দেখি এই জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় অংশটি আজ বিভ্রান্ত ও দিকভ্রষ্ট। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু সাংস্কৃতিক দিকের দিকে তাকালে হতাশার কালো ছায়া এসে আমাদেরকে ঘিরে ধরে।

দুইদিন পরপরই আমরা দেখি দেশে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতির নামে। পিটিয়ে, আগুনে পুড়ে মেরে ফেলা হচ্ছে জীবন্ত মানুষকে। কেন? কোন অপরাধে? সম্প্রতি রংপুরের ঘটনাটি নিয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউনে সেটির দিকে তাকালে হতাশ হতে হয়। অভিযোগ উঠেছিল জুয়েল নামের সেই শিক্ষক কোরআন অবমাননা করেছিলেন, আর সেজন্যই একদল উন্মাদ লোক তাকে পিটিয়ে মেরেই শান্তি পায়নি, আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। অথচ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে তিনি কোনও কোরআন অবমাননা করেননি। বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি বলছে সেখানে যারা পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যারা পিটিয়েছিল, যারা লাশটি দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের ৬৫ ভাগ ছিল কিশোর ও যুবক। কিশোরদের বয়স ছিল ১৩ থেকে ১৭ আর যুবকদের বয়স ছিল ১৮ থেকে ৩০ এর মধ্যে। এদের সবাই জুয়েলকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে মেরেছে। সবাই উল্লাস করে সেইসব দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করেছে।

যারা লাশকে পুড়িয়েছে তাদের সবার মুখেই ধর্মীয় শ্লোগান ছিল অথচ মুসলমানের লাশ আগুনে পোড়ানো পাপ। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো? ধর্মীয় শ্লোগান দিলেও তারা আসলেই কি ধার্মিক ছিল? যদি ধার্মিক হয়েই থাকে তাহলে ধর্মের কোথায় বলা আছে একজন মানুষকে পিটিয়ে মারা যায়? কোথায় বলা আছে লাশ পোড়ানো সওয়াবের কাজ? অর্থাৎ এ কথা পরিষ্কার যে ধর্মের নামে করা হলেও কাজটি ছিল সম্পূর্ণ অধার্মিক। ‘অনুভূতি’র নামে করা হলেও এটি একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। দেশে একটি উদ্দেশ্যমূলক অস্থিরতা তৈরি ছিল এর উদ্দেশ্য। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই অপরাজনীতির শিকার হচ্ছে আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। যাদের জন্য এই উন্নয়ন, যাদের জন্য সরকারের এত প্রচেষ্টা, এত কর্মসংস্থান তৈরির পরিকল্পনা, তারা আজ পথভ্রষ্ট, আদর্শচ্যুত পথে ধাবিত হচ্ছে। আমরা জানি ধর্ম আমাদের এই অঞ্চলের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। এই ধর্মকে নিয়েই আজ একদল দেশবিরোধী, আদর্শহীন লোকেরা রাজনীতিতে নেমেছে। এই জায়গাটাকে যদি এখনই আয়ত্তে না আনা যায় তাহলে আগামীর বাংলাদেশ হবে হত্যাকারীদের বাংলাদেশ, জঙ্গিবাদের বাংলাদেশ। উন্নয়নের সুফল চলে যাবে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে। সকল সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তারা কাজ করবে দেশকে ধ্বংস করার জন্য।

এই যে ‘অনুভূতি’ নামক রাজনৈতিক চর্চা শুরু হয়েছে, এই জায়গাটিকে নিয়ে ভাবতে হবে। বাস্তবে এরা ধর্মের নামে সবচেয়ে বড় অধর্মের কাজ করছে। এই অধর্মের কাজে ব্যবহার করছে আমাদের কোমলমতি কিশোর, যুবকদের। এই বয়সটাই এমন যে তারা নিজেরা কিছু সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ। তারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করে, অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয় খুব বেশি। তাদেরকে কেবল একবার জাগিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। সময় এসেছে আমাদের দেশের কিশোর, তরুণদের মনোজগৎ নিয়ে কাজ করার। তাদেরকে বিপথে যাওয়ার হাত থেকে না বাঁচানো গেলে যে উন্নয়নই আপনি করেন না কেন, তাদের কাছে সবকিছুই মনে হবে ব্যর্থ। এই উগ্রবাদী নীতির কাছে আপনার যেকোনও কাজই হবে ধর্মের বিরোধী।
আহ্বান জানাবো সরকারের কাছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য। আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাকে কেমন করে প্রতিষ্ঠা করা যায় সেটিকে নিয়ে ভাবতে হবে। রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় আনতে হবে ইতিবাচক পরিবর্তন, যেখানে কোনও প্রকার সাম্প্রদায়িক উসকানি থাকবে না। সকল ধর্মের চর্চাকে শ্রদ্ধার শিক্ষা দিতে হবে। উগ্রবাদের সঙ্গে আপস করে আধুনিক রাষ্ট্র গড়া যায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সহায়তা করবে এমন একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন মডেল প্রণয়ন সময়ের দাবি। কেবল অর্থই সকল সুখ দিতে পারে না। উন্নত জীবনবোধ ও রুচি গঠন না হলে পকেটের টাকা খরচ হবে অনর্থের পথে। আমাদের কিশোর, যুবকদেরকে উগ্রবাদের হাত থেকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা ব্যবহার করে যারা বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিতে চাইছে, যারা এদেশের শান্তিকে নষ্ট করতে চাইছে, যারা চায় না আমাদের কিশোর, যুবকরা স্যাটেলাইট নিয়ে ভাবুক, জগতের সকল আধুনিকতার সঙ্গে বেড়ে ওঠা নিয়ে ভাবুক, তাদেরকে রুখতে হলে দরকার আইনের শক্ত প্রয়োগ, পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ