X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

একজন সেকেলে মানুষের জবানবন্দি

আবদুল মান্নান
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:৩৪আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:৪১

আবদুল মান্নান আমি নিজেকে একজন সেকেলে মানুষ মনে করি, কারণ অনেক ক্ষেত্রে আমি আমাকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারি না। ১৯৬৫ সালে এসএসসি পাস করা একজন নিজেকে সেকেলে মনে করলে তাতে দোষের কিছু নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এদেশে হাতে গোনা কিছু মধ্যবিত্ত পরিবার ছাড়া দেশের সব মানুষই ছিল নিম্ন-মধ্যবিত্ত। আমাদের পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়। চট্টগ্রাম হতে ব্যবসা করতে যাওয়া আমার বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন হতে বিতাড়িত হয়ে হেঁটে এক কাপড়ে চট্টগ্রাম ফিরে এসেছিলেন। দেশ ভাগের পর তার বিয়ে আর আমার জন্ম। এসব বিবেচনায় আমি তো সেকেলে হতেই পারি। আমার বাবা আর মা অসম্ভব পরিশ্রমী ছিলেন। লেখাপড়ার গণ্ডি স্কুলের সীমানা পার হননি অনেকটা আর্থিক আর সামাজিক কারণে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের লেখাপড়া করাটা তখন এক ধরনের বিলাসিতা তো বটেই। আমাদের চার ভাইয়ের লেখাপড়া করিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার পেছনের বাবা-মায়ের অবদান শতভাগ।
আমাদের স্কুলটা ছিল একটি মিশন স্কুল, প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৫৩। বেশিরভাগ শিক্ষকই সাহেব, একমাত্র বাংলার মাস্টারমশায় ছাড়া। চতুর্থ শ্রেণিতে বাংলায় হাতেখড়ি দু’আনা দামের রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা দিয়ে। তবে মায়ের হাতে বাংলা শেখা শুরু হয়েছে তারও অনেক আগে, স্কুল যাওয়ার বয়সও তখন হয়নি। আমাদের বাড়ির তিন প্রজন্মের প্রথম শিক্ষক আমার মা। পাড়ার ছোট শিশুরা ভোরে মায়ের কাছে আরবি পড়তে আসতো। তখন তাই রেওয়াজ ছিল। একেবারেই বিনে পয়সায় আরবি পড়ার হাতেখড়ি। রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষায় যে বিদ্যা ছিল বর্তমানে ব্যাগভর্তি স্কুল ব্যাগেও সে বিদ্যা আছে বলে মনে হয় না। মায়ের দেওয়া অনুশাসন আমাদের জন্য ছিল অলঙ্ঘনীয়। মাগরিবের আজানের আগে বাড়ির বাইরে থাকা ছিল অচিন্তনীয়। বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েরা কখন বাড়ি বা বাসায় ফেরে, তার হিসাব ক’জন অভিভাবক রাখেন? পাড়ার কোনও বাড়িতেই যেহেতু বিদ্যুৎ ছিল না, সেহেতু আমাদের সব ভাই-বোনের জন্য দু’টা হারিকেন বরাদ্দ ছিল। একটা আমার জন্য, আর একটা বাকি চারজনের জন্য। তখনো আমার শেষের ভাইটির জন্ম হয়নি। হারিকেন পরিষ্কার আর তাতে কেরোসিন তেল ভর্তি করার দায়িত্ব আমাদের। পাড়ার একমাত্র কলতলা হতে স্কুল শেষে আমাকে পানিও আনতে হতো। স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলা ছিল কঠোর, যা বর্তমানে চিন্তাও করা যায় না। প্রতিদিন ক্লাস শুরু হতো সব ছাত্রের সমাবেশ বা অ্যাসেম্বলি দিয়ে। স্কুলের নিয়ম-শৃঙ্খলা দেখার জন্য একজন সাহেব প্রিফেক্ট ছিলেন। ভীষণ কড়া। তিনি প্রতিদিন সব ছাত্রের জুতার দিকে দেখে ছাত্রদের সারির মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কাপড়ের জুতা, তারপর বাটা কোম্পানির কালো নটি বয়েজ সু। স্কুল ইউনিফর্ম ছাড়া স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ। চুলের স্টাইল মানে কানের ওপর পর্যন্ত জুলফি। মাথার চুল বড় হওয়া চলবে না। সকাল ৮টার সময় স্কুল শুরু। দেরি করে আসার কোনও অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। সপ্তাহে একদিন এক ঘণ্টা স্কুল গ্রন্থাগারে কাটানো বাধ্যতামূলক। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, তারাশংকর, শেকসপিয়র, স্যার ওয়ালটার স্কটের সঙ্গে পরিচয়। ইংরেজি বইগুলো ছোটদের সংস্করণ। বাবা স্কুলে যাওয়ার সময় চার আনা পয়সা দিতেন। দু’আনা টিফিনের আর দু’আনা বাস ভাড়া। যাওয়ার সময় বাসে যেতাম আর আসার সময় হেঁটে। প্রায় দিন দুপুরের টিফিন খেতাম না। আট আনা জমলে একটা বই বা একটা ম্যাগাজিন কেনা যেতো। ওই জমানো পয়সা দিয়ে কলকাতা হতে প্রকাশিত মাসিক ‘শুকতারা’, ‘কিশোর ভারতী’‘সন্দেশ’ কেনা চাই। তখন শ্রীস্বপন কুমার সিরিজের জবরদস্ত গোয়েন্দা কাহিনি আমাদের বয়সের ছেলেমেয়েদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। সঙ্গে ছিল নিহার রঞ্জন গুপ্ত, বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর জরাসন্ধ।  খেলাধুলা তো ছিলই। স্কুলে ‘নীতি নৈতিকতা’ নামে একটা বিষয় ছিল। এই বিষয়টিতে শেখানো হতো সব ধরনের নীতি নৈতিকতা। এই যেমন গুরুজনদের সম্মান করা, বিনয়ী হওয়া, সত্য কথা বলা, বাবা-মায়ের অবাধ্য না হওয়া ইত্যাদি। 

বর্তমান সময়ের স্কুলগামী বা স্কুল বয়সী তরুণদের এই সময়ের অবস্থা বিবেচনা করে একজন সেকেলে মানুষের এতসব ফিরিস্তি লিখতে উদ্বুদ্ধ হলাম। এই সময়ের সমাজের তরুণদের সার্বিক অবক্ষয় দেখে এই বয়সে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। কেমন করে আমাদের তরুণ প্রজন্ম এই অবস্থায় পৌঁছালো, যেখানে আমাদের স্কুলগামী ছেলেরা  গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে? শতকরা ৯০ জন তরুণ কোনও গল্পকার বা ঔপন্যাসিকের নাম বলতে পারে না। দৌড় বড়জোর হুমায়ূন আহমেদ বা জাফর ইকবাল। এদের গল্প উপন্যাস নিশ্চয় ভালো, কিন্তু তারা তারপর গেলো না কেন? প্রায় লক্ষ করি ১০ জন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসে আছে, কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। সবাই মোবাইল টেপাটেপিতে ব্যস্ত। সামাজিক যোগাযোগে একটি চমৎকার পোস্ট, ‘এক সময় একটি বল কিনতে ১০ জনের কাছ থেকে চাঁদা নিতে হতো। তখন একটা বলের দাম ছিল ১০ হতে ১২ টাকা। এখন একটা বল নিজেই কিনতে পারি, কিন্তু খেলার জন্য ১০ জন বন্ধু জোগাড় করতে পারি না।’ এর চেয়ে আর সরল সত্য উক্তি হতে পারে না। 

আমাদের বর্তমান প্রজন্ম কীভাবে একটি ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থার শিকার হয়ে গেলো? এর জন্য কি শুধু তাদের দায়ী করা যাবে? তা করলে তাদের প্রতি অবিচারই করা হবে। এর জন্য দায়ী করতে হলে পুরো সমাজ, চলমান সংস্কৃতি আর শিক্ষা ব্যবস্থাকে করতে হবে। পিতা যদি দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকেন, তাহলে সন্তান ভালো হওয়া কঠিন। ক’জন পিতা-মাতা তাদের সন্তানের সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটান? এটা ঠিক, শহুরে অনেক পিতা-মাতা পেশাজীবী বা চাকরি করেন। কিন্তু রাতের খাবার, নিদেনপক্ষে বন্ধের দিনের এক বেলা খাবার তো একসঙ্গে খাওয়া যায়। বিদ্যালয়ে কি এখন আমাদের সময়ের মতো নিষ্ঠাবান শিক্ষক পাওয়া যায়? যায়, তবে হাতে গোনা। সবাই এখন শিক্ষাকে বাণিজ্য বানিয়ে কোচিংয়ে ব্যস্ত। স্কুলের একজন শিক্ষার্থীর কাছে মোবাইল ফোন না থাকলে কী অসুবিধা? তেমন কোনও অসুবিধা হওয়ার তো কথা নয়। বছর দুয়েক আগে গুলশানে এক হোটেলে এক ছাত্রী ধর্ষিত হয়েছিল, মনে আছে নিশ্চয় পাঠকদের। বাবা-মাকে বলে সেই মেয়ে বন্ধুর জন্মদিনে মধ্যরাতের পার্টিতে এসেছিল। কেমন অভিভাবক হলে নিজ মেয়েকে এমন একটা পার্টিতে পাঠান? ধর্ষক তরুণের পিতা নাকি তাকে হাত খরচ হিসেবে লাখ টাকা দিতেন। সৎপথে রোজগার করে কোনও পিতা তার সন্তানকে এতো টাকা হাত খরচ দিতে পারেন না। যেসব কিশোর গ্যাং কালচারে জড়িত তাদের বেশভূষা, চুলের স্টাইল অভিভাবকরা কেন অনুমোদন করেন? ধানমণ্ডি লেকের পারে দিনের বেলায় স্কুল ড্রেস পরে স্কুল সময়ে ছেলেমেয়েরা বসে বসে আড্ডা দেয়। তাদের স্কুলের শিক্ষকদের এখানে কী ভূমিকা? আমাদের সময় স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে অভিভাবক হতে চিঠি আনতে হতো। সেই ব্যবস্থা কি এখন আছে? ফি বছর স্কুল হতে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত জিপিএ পাঁচ বা গোল্ডেন জিপিএ নিয়ে পরীক্ষায় পাস করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। কিন্তু সার্বিক জীবনমান ও জ্ঞনের পরিধি (Quality of life and depth of knowledge) কি বাড়ছে? এই প্রশ্ন তো আজকের প্রজন্মকে একজন সেকেলে মানুষ করতেই পারে, কারণ বর্তমান প্রজন্মের হাতেই তো আগামী দিনের বাংলাদেশ। 

প্রতি বছর যখন বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং করে এবং তাতে বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকে না, তখন নানা জন এই না থাকার কারণ জানাতে গিয়ে নিজ নিজ মতো করে ব্যাখ্যা দাঁড় করান। কিন্তু এই না থাকার পেছনে তাদের কোনও ভূমিকা আছে কিনা, তা তারা বলেন না। ইরানের চল্লিশটা বিশ্ববিদ্যালয় এবারের টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাংকিংয়ে আছে। প্রথম এক হাজারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে বাংলাদেশ নেই। কেন নেই, তার কোনও গ্রহণযোগ্য কারণ কেউ বলতে পারেননি। কিছু হলেই সবাই স্বায়ত্তশাসন গেলো গেলো বলে রব তোলেন। কিন্তু কেউ এটা উপলব্ধি করেন না স্বায়ত্তশাসন মানে সবকিছু নিজের মতো করে চালানো আর নৈরাজ্য সৃষ্টি করার লাইসেন্স নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো জনগণের অর্থে চলে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যারাই জড়িত, শিক্ষার্থী হতে শিক্ষক, প্রশাসন, সবারই তো জনগণের কাছে জবাবদিহিতা আছে। আমি জানি একজন সেকেলে মানুষের এসব মন্তব্য অনেকের মনঃপূত হবে না। তবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা হতে এসব কথা লিখতেই হলো। কারণ দিন শেষে এটাই সত্য, এই দেশটা স্বাধীন করতে সেকেলে মানুষরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সেকেলে মানুষরা হয়তো সমাজটার খোল নলচে পাল্টে দিতে পারবেন না। তবে একালের শিক্ষক-অভিভাবকদের কাছে তো আকুতি জানাতে পারেন, যারা একবিংশ শতকের বাংলাদেশ গড়বে বলে মনে করা হয়, তাদের রক্ষা করা সবার সম্মিলিত দায়িত্ব। 

লেখক: গবেষক ও বিশ্লেষক।

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
টাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগটাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ