X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধনিক শ্রেণির পক্ষে সরকারের যাবতীয় আয়োজন!

চিররঞ্জন সরকার
২৫ জুন ২০১৯, ১৬:৩৪আপডেট : ২৫ জুন ২০১৯, ১৬:৩৬

চিররঞ্জন সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ৮টি বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ২০১৮ সালে ছয় হাজার ১৬৩টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে এক হাজার ১৯৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করা হয়েছে। গত ২২ জুন সংসদে এ তথ্য জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
একই দিন সংসদে অর্থমন্ত্রী দেশের ঋণখেলাপির তালিকাও প্রকাশ করেছেন। অর্থমন্ত্রীর সংসদে দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের সব তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির সংখ্যা এক লাখ ৭০ হাজার ৩৯০ জন এবং অর্থের পরিমাণ এক লাখ দুই হাজার ৩১৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা, যা ২০১৫ সালে ছিল এক লাখ ১১ হাজার ৯৫৪ জন এবং তাদের কাছে প্রাপ্ত ঋণের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ৫৮ হাজার ৪৩৬ এবং অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ২১০ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
যারা ঋণখেলাপি হয়েছেন, কিংবা সুদ মওকুফ পেয়েছেন, তারা সবাই ধনী ব্যক্তি। দেখা যাচ্ছে ধনীরা নানাভাবে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাচ্ছেন। ব্যাংকে গচ্ছিত থাকে মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের টাকা। এগুলো দিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ‘দুষ্ট’ বড়লোকদের। যারা কর দিতে পারে, কর দেওয়ার মতো সামর্থ্য, বড় সামর্থ্য আছে, তারা কর দেয় না। কর আদায় করা হয় মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, চাকরিজীবী, সরকারি চাকরিজীবী—এসব শ্রেণির লোকের কাছ থেকে। তাও বাধ্য করা হয় নানা কায়দায়। এ নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও এর কোনও প্রতিকার হচ্ছে না।

দেশে অস্বাভাবিক হারে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত ১০ বছরে (২০০৯-২০১৮) কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫৫ হাজার। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর শেষে এই সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার ৫৬৩ জন। অথচ প্রত্যক্ষ কর আদায়ের হার খুব একটা বাড়ছে না।

‘ধনী লোক’ কারা? সরকারের মতে যাদের ‘ট্যাক্স ফাইলে’ সোয়া দুই কোটি টাকার সম্পদ আছে, তারাই ‘ধনী’। হিসাবটা ‘কোটিতে’। অথচ সরকার এখন হিসাব করে মিলিয়ন (দশ লাখ), বিলিয়ন (শত কোটি) এবং ট্রিলিয়ন (লক্ষ কোটি)! বড় হিসাব বাদ দিয়ে বাঙালির ছোট হিসাব কোটিতে এলেও দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ধনী লোকের সংখ্যা ‘ট্যাক্স ফাইলে’ অনুযায়ী মাত্র সাড়ে ১৫ হাজারের মতো। এরা কত টাকা কর দিয়েছে? মাত্র ৪৫০ কোটি টাকা। ভাবা যায় এ কথা, এ দেশে সোয়া দুই কোটি টাকার মালিক মাত্র ১৫ হাজার জন!  ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, শান্তিনগর, সিদ্ধেশ্বরী, সেগুনবাগিচা, মতিঝিল, মিরপুর ইত্যাদি অঞ্চলে একটা ফ্ল্যাট থাকলেই তো সেই ব্যক্তি মোটামুটি ধনী হওয়ার কথা। আর বাড়ি থাকলে তো কথাই নেই। উপজেলার অবস্থাও তাই। অনেক উপজেলা শহরে এক শতাংশ জমির দাম ২০-৩০ লাখ টাকা। ঢাকার সন্নিকটে টঙ্গী, মাধবদী, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী থেকে শুরু করে সারা দেশে প্রায় একই অবস্থা। একজন ভদ্রলোক যদি দেড় লাখ দুই লাখ টাকা দিয়ে একটা মোটরসাইকেল কিনতে পারে, ২৫-৩০ লাখ টাকা দিয়ে একটা গাড়ি কিনতে পারে তাহলে তার সম্পদের পরিমাণ কত?

এভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে দেশে লাখ লাখ লোক ‘ধনী’, সোয়া দুই কোটি টাকার ওপরে সম্পদ-সম্পত্তি। কিন্তু ভুল হিসাব পদ্ধতি, ত্রুটিপূর্ণ নীতিমালা, সদিচ্ছা ইত্যাদি কারণে ‘ধনী’ লোকের সংখ্যা এত কম দেখা যাচ্ছে।

এখানেই আপত্তি, এখানেই কথা। যারা ট্যাক্স দিতে পারে, যাদের সম্পদ আছে, তাদের কেউ কেউ ট্যাক্স দেয় না। তাহলে কারা দেয়? দেয় চাকরিজীবীরা, তা সরকারি হোক, বেসরকারি হোক। এরা জালের মধ্যে। বের হওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। যাদের বের হওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই, তাদের কাছ থেকেই ট্যাক্স আদায় করা সহজ।

অন্যদিকে সমানে চলছে ‘বন্ডেড’ ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার। সদরঘাটের পাটুয়াটুলির বাজার এর সাক্ষী। শুল্কমুক্ত রফতানির কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। রাজস্ব কর্মকর্তাদের মতে বছরে প্রায় লাখ-কোটি টাকার রাজস্ব এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফাঁকিবাজদের ধরার কোনও চেষ্টা নেই। আছে কর রেয়াতের ঘটনা। হরহামেশাই কর রেয়াত, কর মুক্তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। যারই একটু শক্তি আছে, সে-ই এই সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছে। আর বড়লোকদের যুক্তি সরকার সব সময়ই মনোযোগ দিয়ে শোনে।

এক হিসাব মতে, গত পাঁচ বছরে ‘ট্যাক্স ওয়াইভার’ দেওয়া হয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার। সংসদ সদস্যদের গাড়িতেই গত চার বছরে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা। এরকম অনেক উদাহরণ আছে।

এটা পানির মতো পরিষ্কার—প্রভাবশালীদের অনেকেই ট্যাক্স দেয় না, ভ্যাট দেয় না, বন্ড সুবিধার অপব্যহার করে। তারা শুল্ক দিতে চায় না। গ্যাস, বিদ্যুতের বিলের টাকা দিতে চায় না। মোট কথা, সরকারকে তারা কোনও টাকা দিতে চায় না। এমনকি ব্যাংকের পাওনা টাকা, যা জনগণের টাকা, তাও তারা দিতে চায় না। এটা তাদের পণ, তারা শুধু দুই হাত পেতে নেবে, কিন্তু কিছুই দেবে না। এর বিপরীতে সরকার ক্রমেই পরোক্ষ করের দিকে ঝুঁকছে। অথচ ঝোঁকার কথা প্রত্যক্ষ করের দিকে। এটাই নিয়ম হওয়ার কথা ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে সামর্থ্যবান নাগরিকদের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কর আদায় করা হয়। আর গরিবদের যতটা সম্ভব কর রেয়াত দেওয়া হয়। বড়লোকদের কাছ থেকে কর আদায়ের রয়েছে নানা পদ্ধতি। যেমন যেকোনও অপরাধের জরিমানা (অধিক গতিসীমায় গাড়ি চালালে, কর ফাঁকি দিলে) হিসাবে উচ্চ আয়ের মানুষদের জরিমানা নিম্ন আয়ের মানুষদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি হয়। আবার সেই টাকাতেই সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

আমাদের দেশের কর প্রশাসনও অদক্ষ এবং দুর্বল। আমাদের দেশে কর প্রশাসনের যে অবকাঠামো, তাতে দূর-দূরান্তের গ্রাম তো দূরের কথা, বড় বড় গুটিকয় শহর-বন্দর বাদ দিলে অনেক ছোট ছোট শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রেও তার উপস্থিতি একেবারেই নেই। সুতরাং কর আদায়ের লোক না থাকার ফলে অনেক সম্ভাব্য করই ওইসব এলাকায় অনাদায়ী থেকে যায়। খোদ ঢাকা নগরীর কথাই যদি ধরা যায় তাহলেও দেখা যাবে, অবস্থা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। সুসংগঠিত কতিপয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা কিংবা সেবাদানকারীরা নিয়মিত কর দেন কিংবা দিতে বাধ্য হন। তাদের মধ্যেও অনেকেই কর ফাঁকি দেন। তবুও কর প্রশাসনের আওতায় তারা আছেন। কিন্তু কর দেওয়া যাদের জন্য আইনানুযায়ী বাধ্যতামূলক, এমন অনেক ব্যবসায়ী, শিল্প প্রতিষ্ঠান এমনকি চাকরিজীবীও খোদ ঢাকা শহরেই কোনও প্রকার কর দেন না। এর একাংশ ঘটে কর প্রশাসনের যোগসাজশে, আর একাংশ তাদের নাগালের বাইরে থাকে বলে।

সরকার তার পরিকাঠামো ব্যবহার করে করযোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনতে পারছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে বাংলাদেশের ভ্যাট লাইসেন্সধারীর সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বড়জোর ১ লাখ লাইসেন্সধারীর কাছ থেকে (মোট ভ্যাট লাইসেন্সধারীর ১০ শতাংশ) বর্তমানে ভ্যাট আদায় হয়। যারা তাদের ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করছে না, কর প্রশাসন তাদেরও ঠিকমতো ধরতে পারে না তথ্যের অভাবে।

কর ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির যে ঘাটতি রয়েছে, তা দূর করার কোনও উদ্যোগ নেই। জমির মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তার ওপর করারোপের হার বৃদ্ধি এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজিকরণের কোনো পরিকল্পনা নেই। কর ব্যবস্থাকে দরিদ্রবান্ধব করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর ভ্যাট কমিয়ে বিলাসজাত দ্রব্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোরও কোনও তাগিদ নেই! থাকবে কী করে? সরকার যদি ‘বাই দ্য রিচেস (বড় ধনী), ফর দ্য রিচেস, অব দ্য রিচেস’ হয়, ধনিক শ্রেণির পক্ষেই যদি তাদের যাবতীয় আয়োজন হয়, তাহলে এর বাইরে যাবে কেন?

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ তিনজনের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করবে দুদক
রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির অভিযোগবিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ তিনজনের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করবে দুদক
একনেকে ১১পি প্রকল্প অনুমোদন
একনেকে ১১পি প্রকল্প অনুমোদন
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ