X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন পোশাকে পুরনো ‘ইবলিশ’

লীনা পারভীন
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৭:৫৯আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:০০

লীনা পারভীন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি এই বাংলাদেশে নতুন নয়। ১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া যে দেশটির মূলমন্ত্রই ছিল একটি সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার, সেই দেশে পরবর্তীতে সংবিধান সংশোধন করে ঢুকানো হয়েছে ধর্মীয় খোলস আর দেওয়া হয়েছে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের আইনগত ভিত্তি। এই একটি সুযোগে ৭১ সালের শত্রুরা বাংলাদেশকে না মেনেও বুক ফুলিয়ে চলেছে এই দেশে। এসেছে ক্ষমতার কেন্দ্রপটে। লাল সবুজের পতাকা উড়েছে স্বাধীনতাবিরোধী সেসব দলের লোকদের গাড়িতে।
১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন সেই স্বপ্নের সোনার বাংলাকে গড়ে দিয়ে যেতে। হতভাগা এই জাতি সেই স্বপ্নদ্রষ্টাকে হারিয়েছে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়। সেই থেকেই ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে যাত্রা শুরু করেছিলো। ১৯৭২ সালে যেসব চিহ্নিত রাজাকার আল-বদরদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো সেই রথ থেমে গিয়েছিলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। তারপরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। মেজর জিয়া রাজাকার শিরোমনি গোলাম আযমদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করেছিলো আর তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলো গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রদানের মাধ্যমে। যে জামায়াতে ইসলামী এ দেশে রাজনীতি করতে পারার কথা না, তাদের বৈধতা দিলো বিএনপি সরকার। নিজেদের পার্টনার করে ৭১ সালের পরাজয়ের উপহার দিলো মেজর জিয়ার সৃষ্ট দলটি।

জামায়াতের  ভূমিকা আজকে এই প্রজন্মের কাছে আর অজানা নয়। একটা সময় ছিল যখন বঙ্গবন্ধুকে দেখানো হতো একজন ‘খলনায়ক’ হিসাবে। আর ইতিহাসে রাজাকার, আল-বদর বলে কারও যে কোনও অস্তিত্ব ছিল– সেই বিষয়টিকেই দেওয়া হয়েছিলো কবর। সেই কবর থেকে তাদের টেনে বাইরে নিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

৭৫’র পর দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। আওয়ামী লীগই স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচারের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এলো, যারই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখেছি জামায়াত ও বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ মানবতাবিরোধীদের প্রমাণিত অপরাধের ভিত্তিতে ফাঁসির রায় কার্যকর হলো। বাকিদের বিচার প্রক্রিয়া এখনও চলমান আছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমাদের ঐতিহাসিক দায় ও কালিমা মুক্তির এক অনস্বীকার্য রাস্তা। এই শপথ থেকে যারাই সরে যাবে তারাই হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধ্যায় থেকে। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের সেই বিপ্লবের কথা যদি কেউ বুঝতে না পেরে থাকে তাহলে তাদের এই বাংলায় অবস্থানের কোনও নৈতিক অধিকার থাকে না। এটাই ছিল পরিষ্কার বার্তা।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে টানা দশ বছর এবং পরবর্তী আরও পাঁচ বছরের জন্য তারা আবারও শপথ নিয়েছে। এই সরকারের অন্যতম একটি সাফল্যের বিষয় হচ্ছে এই বাংলাদেশকে যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকে দখলমুক্ত করে সত্যিকারের স্বাধীনতার শপথকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর এবং জনতাও তাঁকে সেই ম্যান্ডেট দিয়েছেন বিনাবাক্যে। জামায়াতের নির্বাচনি অধিকার খর্ব করা হয়েছে এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকারও হারানোর পথে। সরকার রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া এরইমধ্যে শুরু করেছে এবং আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই সে ঘোষণা দিয়ে আবারও জয় বাংলার স্লোগানে মুখরিত হবে বাংলাদেশ।

এই হিসাবটি জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যেই করে ফেলেছে এবং তারা এটাও জানে যে শেখ হাসিনা যা বলেন তা করে দেখান। বঙ্গবন্ধুর রক্ত যার শরীরে তাঁকে অন্তত আর যাই করা যাক, টলানো যায় না। হিসাবের খাতায় তাই জামায়াত নতুন অংকের সূত্রে নেমেছে। বিএনপির কাঁধে চড়েছিলো, সুবিধার হয়নি। হত্যা নির্যাতন লুণ্ঠন করে বিএনপি নিজেই নিজের মাথায় লাঠি মেরেছে। সেখানে শেষ পেরেকটি গেঁথে গিয়েছে গত দশ বছরের টালমাটাল অবস্থায়। এমন অবস্থায় যাদের নিজেদেরই বাঁচা মরার প্রশ্ন তাদের আর কোনোভাবেই ভরসার জায়গায় দেখতে পাচ্ছে না জামায়াতে ইসলামী। বুঝে গিয়েছে বাঁচার রাস্তাটি নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে।

অস্বীকারের কোনও উপায় নেই যে জামায়াত অত্যন্ত সুকৌশলী ও সুচিন্তিত একটি রাজনৈতিক দল। তারা কৌশল নির্ধারণ ও ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণে এগিয়ে আছে অন্যদের চেয়ে। তবে এবার কেমন যেন একটু এলোমেলো হাওয়ায় পড়ে গেছে তারা। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনটি ছিল তাদের জন্য লিটমাস টেস্ট। সেই টেস্টের ফলাফল সবাই দেখেছে। সরকারও পেয়ে গেছে সবুজ কার্ড। আর কোনও উপায় বাকি রইলো না। এখন তারা এসেছে নতুন ফর্মুলা নিয়ে। যদিও রিকনসিলিয়েশন তত্ত্ব এর আগেও আমাদের সুশীল সমাজের অনেকেই দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো কিন্তু কোনও দিকেই সামলাতে পারছিলো না। এবার খোদ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি আব্দুর রাজ্জাক নিয়ে এলেন সেই তত্ত্বকে। যে আইনজীবী নিজে জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধের পক্ষে লড়াই করেছেন, যিনি নিজে জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতা, তিনি যখন পদত্যাগ করে বলেন যে জামায়াতের উচিত ১৯৭১-এর বিষয়ে ক্ষমা চেয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করা তখন সাধারণ মানুষ একবার হলেও ভাবতে শুরু করে এ বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু যারা জামায়াতের রাজনৈতিক জায়গাটিকে চেনেন বা যারা সামান্যতম রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে পারেন তারা পরিষ্কার জানেন, জামায়াত এখন পানি শুকিয়ে যাওয়া খালের মাছটির মতো অবস্থায় আছে। বেঁচে থাকার শেষ কুটো হিসাবে তারা নিজেদের নাম পরিচয় পাল্টে নতুন করে শুরু করতে চাইছে।

তবে এ কথা পরিষ্কার যে জামায়াতের ভেতরে একটি ডিসকোর্স শুরু হয়েছিলো বিচার শুরুর প্রথম থেকেই। তাদের শক্ত বিশ্বাসের জায়গাটি নাড়া খেয়েছিলো শক্তিমান নেতাদের ফাঁসির দৃশ্যে। পুরনো আর নতুনের মাঝে মতবাদের একটি যুদ্ধ সবসময়েই চলতে থাকে। এটা প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে। জামায়াতের এই মুহূর্তে আর ধর্মকে আশ্রয় করে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার মতো অবস্থা নেই। এ কথাও আবার বিশ্বাস করা বোকামি হবে যে জামায়াত নাম না থাকলেই শুধরে যাবে তারা। আদর্শকে এক রেখেই জামায়াতের জায়গায় নাম ধারণ করবে অন্য কিছু।

‘আকিকা’ দিয়ে নাম পাল্টালেও মানুষটি কিন্তু পাল্টে যায় না। রাজনীতি করবে না ঘোষণা দিলেও সামাজিক সংগঠনের মধ্যেই তারা চালাবে রাজনীতিকে। সুযোগ পেলেই ছোবলে নীল করে দেবে আবার এই বাংলার মাটিকে।

তাই কেবল জামায়াত ইসলামী নামের দলটিকে নিষিদ্ধ করলেই চলবে না, করতে হবে ধর্মকে আশ্রয় করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেও। অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে কোন পথে চলতে চাইছে তারা। কোনোভাবেই ছাড় দেওয়ার মতো অবস্থা নেই বলেই মনে করি আমরা। সংবিধানের যে ধারাটি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে উসকে দেয়, দাবি থাকবে সেই ধারাটিকে পরিবর্তনের যাতে করে আর কোনও শক্তি ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে নিয়ে খেলতে চাওয়ার মতো সাহস না করতে পারে।

ক্ষমা চাইলেই সব অপরাধের ক্ষমা হয় না। খুনের শাস্তি ক্ষমায় হয় না। জাতিকে ধ্বংসের শাস্তি ক্ষমায় হতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার বদলা ক্ষমায় আশা করার মতো দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ দেওয়া যায় না। তাই যেই রূপেই যারাই আসুক না কেন তাদের জন্য একটাই পরিষ্কার বাণী, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে এমন কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়াও সমান অপরাধ।

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ