X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঐক্য, অনৈক্য ও ঐকমত্য

সাইফুল হাসান
০৫ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৩৯আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৪০

সাইফুল হাসান একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় খুব কাছে। নির্বাচন মানেই মনোনয়নপ্রত্যাশীদের শোডাউন, ছোটাছুটি। রঙবেরঙের পোস্টার। চায়ের দোকান থেকে অফিস টেবিলে নানা আলোচনা। কথার লড়াই, উত্তাপ, উত্তেজনা, অঙ্গীকারের ফুলঝুরি। এই সময়ে সাধারণ মানুষের কদর বাড়ে। বাংলাদেশে নির্বাচন উৎসবের উপলক্ষও বটে।
যদিও, দশম সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও বিবর্ণ। এর বাইরেও, নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তার অভাবে কিছু কিছু নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সামনে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন। নানা বিবেচনায় একাদশ সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে ২০ বছর পরের বাংলাদেশের চেহারা।
আশা করছি, একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রধান সব দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা, মানুষের রায়কে সম্মানের সঙ্গে মেনে নেবে। যদিও আমাদের মতো ক্ষুদ্রদের আশা-প্রত্যাশায় ভবিষ্যতের হবু সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আশা করতে তো অসুবিধা নেই। সুযোগ বুঝে, তাই আগেই অনুরোধটা জানিয়ে রাখলাম।

ক্ষমতার পালাবদলের একমাত্র বৈধ পথ হচ্ছে নির্বাচন। যদিও, নির্বাচনের মান, ধরন-ধারণ নিয়ে কোনও আলোচনায় যাচ্ছি না। অবশ্য সামরিক শাসন, ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিদের পথেও ক্ষমতায় যাওয়া যায়। তবে, ইদানীং তা এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ এবং অগ্রহণযোগ্য যে সহজে কেউ ওই রাস্তায় হাঁটতে চাইবে বলে মনে হয় না। ফলে, জনরায়ই পালাবদলের একমাত্র চাবিকাঠি। ফলে, দিনক্ষণ ঠিক না হলেও, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই এখন রাজনীতির প্রধান প্রতিপাদ্য।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার শরিক সব দল নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বেশ আগেই। আওয়ামীবিরোধী, বিএনপি ও তার শরিক দল এখনও আন্দোলনের হুমকি ধামকির মধ্যেই আছে। যদিও, তলে তলে তারাও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বা নেবে নিশ্চয়ই। কেননা, নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প তাদের সামনে আপাতত দেখছি না। আমার ধারণা, খালেদা জিয়াকে ছাড়াই দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে।

রাজনীতিতে এখন ‘ঐক্য’ শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার ও সমাদৃত। সবাই জাতীয় ঐক্য, দলীয় ঐক্য, শরিকের সঙ্গে ঐক্য, জনগণের ঐক্যের ওপর জোর দিচ্ছে। সরকারবিরোধীরা ইতোমধ্যেই ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামক একটি প্ল্যাটফর্ম করেছেন, যার নেতৃত্বে আছেন, বঙ্গবন্ধুর সহচর ড. কামাল হোসেন। তিনি মূলত একসময়ের আওয়ামী লীগার। কিন্তু অভিজাত ও জনবিচ্ছিন্ন নেতা। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে সুবিধা করতে পারেননি। পরে দল থেকে বেরিয়ে গণফোরাম গঠন করেন।

ড. কামাল হোসেন এই দেশ বিনির্মাণের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাকিস্তানের কারাগারে জেল খেটেছেন। দেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংবিধান প্রণেতাদের প্রধান। গায়ে কখনও দুর্নীতির কালি লাগতে দেননি। ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক মানুষ হিসেবে পরিচিত। দল ছাড়লেও আওয়ামী লীগ তাকে কখনও বিরোধী শিবিরের মানুষ বলে ভেবেছে বলে মনে হয়নি। সেই কামাল হোসেন কিনা বিএনপি ও ২০ দলের সঙ্গে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট করলেন? যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত।

সরকার ও তার সমর্থকদের জন্য এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। ড. কামালকে লক্ষ করে সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহারই যার প্রমাণ। যদিও, সরকার প্রধান শুরুতেই ঐক্যফ্রন্টকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। পরে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সমালোচনা করলেও ড. কামাল হোসেনকে নিশানা করেননি। ভোটের মাঠে গুরুত্ব না থাকলেও জাতীয় রাজনীতিতে ড. কামাল হোসেনরা যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, তা আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়েই ভালো করেই বোঝে।

যে কারণে তিনি কিছুটা মন্দ কথা শুনেছেন। কিন্তু তিনি ঐক্যফ্রন্ট করলেন কিসের ভিত্তিতে? কেনইবা করলেন? এর পরিষ্কার ব্যাখ্যাটা ড. কামাল হোসেনের মুখ থেকে এখনও শোনা যায়নি। যদিও, নানা ধরনের অনুমান বাতাসে উড়ছে। ঐক্যফ্রন্ট আসলে বিএনপির মুখরক্ষার প্রচ্ছদ এবং নির্বাচনের স্বার্থে গড়ে ওঠা একটি প্ল্যাটফর্ম। যেখানে নীতি নৈতিকতা কোনও বিষয় নয়। ঐক্যফ্রন্ট গঠন এবং তার নেতৃত্বে ড. কামালকে রাখা—এই খেলাটা বিএনপি ও ড. কামাল হোসেন  দারুণ খেলেছেন।

ঐক্যফ্রন্ট সিলেট ও চট্টগ্রাম—দুই জায়গায় দুটি সমাবেশ করে ফেলেছে। এই লেখা প্রকাশের আগেই আওয়ামী লীগ ও তার শরিকদের সঙ্গে একদফা সংলাপও হয়ে যাওয়ার কথা। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে ইনিয়ে-বিনিয়ে আলোচনার দাবি জানিয়ে এলেও তাতে সাড়া দেয়নি আওয়ামী লীগ। সেখানে কিনা ড. কামাল হোসেনের একটি মাত্র চিঠির জবাবেই সংলাপে রাজি হয়ে গেলো সরকার। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী অসাধারণ ‘কাভার ড্রাইভ’ খেলেছেন, যা ঐক্যফ্রন্টের কারও কল্পনাতেও ছিল না। যেটা সামাল দিতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে।

এতে দুটো লাভ হয়েছে সরকারি দলের। প্রথমত বিশ্বকে দেখানো যাবে, সরকারি দল আলাপ-আলোচনায় বিশ্বাসী। দ্বিতীয়ত, প্রথম চিঠি কবুল করায় ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে বিএনপির ভেতরে সন্দেহ/অস্বস্তি তৈরি হবে। লোকটা আসলে কোনপক্ষের। যেটা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ক্ষেত্রেও বিএনপিতে হয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঐক্যফ্রন্টের মধ্য দিয়ে কী অর্জিত হবে? বিএনপি ও তার শরিকরা ক্ষমতায় চলে যাবে? রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে? ২০ দলীয় জোট কি জামায়াতকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানাবে? জামায়াত কি ৭১’র অপরাধের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইবে?

অধিকাংশ প্রশ্নই অমীমাংসীত। আরও বহু অমীমাংসিত প্রশ্ন কিছুদিনের মধ্যেই সামনে আসবে। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা শেষমুহূর্তে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়নি। কাদের সিদ্দিকীও নানা টালবাহানার মধ্যে আছেন। তাছাড়া ঐক্যফ্রন্টে সব দল মিলেও বিএনপির সমান হবে না। ফলে, বিএনপি কতদিন ঐক্যফ্রন্টের কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মানবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। অন্যদিকে, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ায়, নেতৃত্বের প্রশ্নে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ড. মোশাররফের মধ্যে সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঐক্যফ্রন্টে নানাবিধ অনৈক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এ বিচারে আওয়ামী লীগ ও তার শরিকরা এগিয়ে আছে। পুরো জোটের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আছে। জোটের বাইরেও যেসব ধর্মভিত্তিক বা ছোটখাটো দলের সঙ্গে কথা চলেছে, সেখানে শির উঁচুতেই রাখছে আওয়ামী লীগ। এমনকি দশম সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আছে। রাজনৈতিক ও আদর্শগত অবস্থান, দলীয় বিবেচনা ও বিশ্লেষণ ইত্যাদি প্রশ্নে প্রকট মতবিরোধ থাকলেও ১৪ দলের সবাই ক্ষমতার প্রশ্নে একজোট। এই জোট বা এই পক্ষে শেখ অবিসংবাদিত নেতা। তার সামনে কথা বলার মতো কেউ নেই। যেটা এই জোটকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে।

বাধ্য হয়েই ড. কামাল হোসেনকে ফ্রন্টের নেতা বানিয়েছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। কতদিন তাকে রাখবে, সেটা সময় বলবে। তবে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এটা দারুণ। কিন্তু একে কাজে লাগিয়ে সুবিধা আদায়ের মতো প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব ড. কামাল হোসেনের কতটা আছে, সেটিই দেখার বিষয়। পাশাপাশি, শরিকদের ঐক্যবদ্ধ রাখার মতো নেতৃত্বগুণ আছে কিনা, সেটাও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

রাজনীতিতে ঐক্য-অনৈক্য থাকবেই। কৌশলগত জোট, একতাবদ্ধভাবে আন্দোলন হবে। সবই রাজনীতিতে স্বাভাবিক। কিন্তু ঐক্য যদি হয় শুধুই ক্ষমতার প্রশ্নে, উপেক্ষিত হয় জনআকাঙ্ক্ষা, তবে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আমার প্রত্যাশা করি, একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে উঠুক। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সবার আগে রাখতে, দেশকে এগিয়ে নিতে অঙ্গীকার ও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হোক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।

মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদ্ভাব ও সুসম্পর্ক দেখতে চায়। ঐক্যবদ্ধ দেখতে চায় জাতীয় ইস্যুতে। জন ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণে নেওয়া শপথ যেন যথাযথভাবে পালিত হয় তার নিশ্চয়তা চায়। শান্তিপূর্ণ জীবন চায়।

দূর হোক সব অনৈক্য।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ