X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘এসো লড়ি, এসো মারি, এসো মরি’

চিররঞ্জন সরকার
০২ মে ২০১৮, ১৪:৩৯আপডেট : ০২ মে ২০১৮, ১৪:৪৪

চিররঞ্জন সরকার আগে মানুষ সময়-সুযোগ পেলে আড্ডা মারত, আর এখন সময়-সুযোগ মতো মানুষ মারে! কিছু কিছু মানুষ বর্তমানে যমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। চান্স পেলেই বন্দুক-বোমা-চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কেউ না দিলেও নিজেরাই ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিসারের’ দায়িত্ব পালন করছেন! সমাজে আকস্মিকই যেন পরমতসহিষ্ণুতা লোপ পেয়েছে। সমাজে ধর্মান্ধ, মতান্ধ, দলান্ধ, ক্ষমতান্ধ আর অর্থান্ধদের দাপট বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশ এখন অসহিষ্ণুতা আর নৃশংসতার উর্বর ভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অন্ধত্বের সহযোগী সীমাহীন লোভ আর সংবেদনহীনতা। এর শিকার হয়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন নামে, অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছে মানুষ, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে সমাজ আর অসংখ্য পরিবার। বল প্রয়োগের বিস্তারে চিন্তা, মত, রাজনৈতিক তৎপরতার পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। রাজনীতিকে বানানো হয়েছে অসহিষ্ণু সহিংস তৎপরতায়। একের পর এক আঘাতে ক্লান্ত সমাজ, ক্ষোভ, ঘৃণা, প্রতিবাদ জানানোর পথ ও ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছে।
অথচ আমাদের সমাজটা এমন ছিল না। আমাদের দেশের মানুষের চিরকেলে স্বভাব হচ্ছে আড্ডা দেওয়া। সে গলির ধারে, খেলার মাঠে বসে হোক কী বাজারের পাশে চায়ের দোকানে কিংবা বাড়ির বসার ঘরে। আড্ডা কী আর, তর্কাতর্কি। একজন যা বলবে, অন্যজন নিশ্চয়ই তার উল্টোটা। ভূত থেকে শুরু করে আমেরিকা থেকে হলিউড-বলিউড, ভিয়েতনাম থেকে ভাড়াবাড়ি, উৎসব থেকে ফুটবল ম্যাচ। কেউ কারও কথা পুরোটা শুনছে না। তার আগেই নিজের মতো বলা শুরু। মাঝখানে এ পক্ষে, সে পক্ষে, তৃতীয় পক্ষে কথা বলার লোকেরও কমতি নেই। হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। তারই মধ্যে চা চলছে, দেরি করে বাজার যাওয়া কিংবা দেরি করে ফেরার মুখঝামটা, তাড়াহুড়ো। আবার পরের দিনও। দিনের পর দিন একমত না হওয়ার বিনোদন। ভিন্নমত শোনার অভ্যাস। খুব সাধারণ স্বাভাবিক অভ্যস্ততা। পাশাপাশি বাস করা এক ছাদ কিংবা অন্যান্য ছাদের তলায়, আশপাশের নানান বিষয় সহ্য করতে করতে ভাবা। ভিন্ন ভিন্নজনের ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা, আবার দেখা হলে সেসব ভাবনা এক সঙ্গে খুলেমেলে দেখা। ইলিশ ভালো না চিকেন ফ্রাই, লাভ ম্যারেজ নাকি সম্বন্ধ করে বিয়ে। স্টার প্লাস না স্টারস্পোর্টস? যার কোনও বিষয়েই নিজস্ব মত নেই, সব কথাতেই সমর্থন করে চলে সে একটু ‘আলু’ গোছের। তাকে নিয়ে সবার টিটকেরি, দূর, মত থাকবে কী, কিছু ভাবেই না! ও তো আলু হয়েই থাকতে চায়!

এই স্বাভাবিক মতানৈক্য কবে থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে শুরু করলো, কখন থেকে জীবনযাপনের মধ্যে থেকে তর্ক-আড্ডা, মানে সহজ স্বাভাবিক মেলামেশা অনুপস্থিত হলো তা ঠিকঠাক নির্ণয় হয়তো একদিন কেউ করবেন। আমরা শুধু একসময়ে খেয়াল করলাম লোকজনের মধ্যে কথাবার্তা কমে এসেছে। কথা বলার বিষয় কমে এসেছে, কথা বলার সময় কমে এসেছে। সকলেই নিজের বাড়তি সময়টুকু কোনও না কোনও ‘কাজে লাগাতে’ চায়। কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে মেলামেশা, সেই মেলামেশাও ‘কাজে লাগার’ই অঙ্গ, সেখানে খামোখা তর্ক করে চটিয়ে দেওয়ার থেকে অনেক সুবিধাজনক অধিকাংশ জনের সঙ্গে একমত হয়ে যাওয়া। এই অধিকাংশ জন সংখ্যাধিক বা ‘মেজরিটি’র সঙ্গে কোনও বিষয়ে কত দূর থাকতে হবে, সে সবের অলিখিত নিয়ম তৈরি হলো ক্রমশ। সেগুলো প্রচারিতও হয়। ‘মেজরিটি’তে থাকতে থাকতে ভাবনা করার অভ্যাস ভুলে যাওয়া যায়, সত্যি কথা বলতে কী, ভুলে যাওয়াটাই সুবিধাজনক। একরকমভাবে ভাবা, একরকমভাবে বাস করা, একরকমভাবে বাঁচা। অর্থাৎ, লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে ‘গুরুমস্তিষ্ক’ নামে যে পরমাশ্চর্য অঙ্গটি সংযোজিত হয়েছে, যা মানুষকে অন্য সকল প্রাণী থেকে ভিন্ন করে দিয়েছে, তাকে অস্বীকার করা। অপব্যবহার হতে হতে একদিন হয়তো তা আবার শুকিয়ে গুটিয়ে যাবে। পোশাকের ছাঁট থেকে, সামাজিক উৎসবের তালিকা, সব ধীরে ধীরে ঢালা হয়ে যাচ্ছে এক ছাঁচে। ‘জনপ্রিয়’ আগেও ছিল, তার সংখ্যাধিক্য যেমন থাকত, ব্যত্যয়ও থাকত। এবং সেই ব্যতিক্রমকে সমাজ যে কেবল মেনে নিত তাই নয়। গড্ডলের বাইরে তার একরকম সম্মানও ছিল। কোনও নির্দিষ্ট সমাজে নয়, সব সমাজেই। অন্যরকম হওয়ার অধিকার একরকম সামাজিক স্বীকৃতি পেত। যে সমাজ ইতিহাসের নির্দিষ্ট সময়ে তা দেয়নি সে সকল সমাজ বা শাসক ‘গোঁড়া’ বলে নিন্দিত হয়ে এসেছে।

গত কয়েক দশক ধরেই অভ্যাস কিংবা সামাজিক সংস্কৃতিতেও এই স্বাভাবিক ‘ভিন্নতা’ বা অন্য মত সহ্য না করার প্রবণতা বেড়ে উঠলো। কৃষি ব্যবস্থা থেকে প্রণয় সম্ভাষণ— বহুত্বের বৈচিত্র্যময়, প্রাণবান সৌন্দর্যের জায়গা নিতে শুরু করলো ‘একমাত্র’। বিকল্প ভাবনার সৃষ্টিশীল পরিসর ভাগ করা নয়, সমস্তটাই দখল করার ‘সবটাই’ ভাবনা। ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পরিবার থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র পর্যন্ত এই ‘কাউকে জায়গা না ছাড়া’র মনোবৃত্তি প্রায় একটা যান্ত্রিক অভ্যাসের ভয়ালরূপ ধরেছে। এই ব্যাধি অভ্যাস করা হয়েছে কয়েক দশক ধরে। নিতান্ত শিশুকাল থেকে ‘শুধু তোমার, আর কারও নয়’ ভাবনাকে প্রায় স্বাভাবিক করে দেওয়া হলো। খেলার মাঠ, গলির আড্ডা, পাড়ার রক, পিকনিক, শুক্রবারের আড্ডার জায়গা নিয়েছে প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, সঙ্ঘ, এনজিও, পার্টি। এদের সকলেরই চাই সাংগঠনিক ক্ষমতা। আরও ক্ষমতা। একচ্ছত্র ক্ষমতা। যত মত তত পথের দেশে আজকে ‘অন্য মত’কে মনে হচ্ছে স্পর্ধা। বরেন্দ্র সমভূমিতেই যাদের আবহমানকালের বাস, সংস্কৃতির পারস্পরিক সহাবস্থানের চিন্তা তাদের কাছেও অসম্ভব হচ্ছে ক্রমশ।

এই বীভৎস মহামারির প্রকোপ এক দিনে এমন প্রাণঘাতী জায়গায় পৌঁছায়নি। ‘মনোকালচার’-এর ভাইরাস একটু একটু করে বাসা বেঁধেছে শিক্ষিত নাগরিক মানুষের ‘সুবিধাজনক’ ভাবনার ভেতরে। পুষ্ট হয়েছে সেখানে। তারপর বাইরে ছড়িয়েছে ওই জীবনযাপনের ধরনকে ‘এক মাত্র’ মডেল ধরে। অদূরদর্শী এক সচেতন ভাবনাবিহীনতাকেই সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য সাফল্যের পথ বলে মনে করা হচ্ছে। তার মূল্য হিসাবে ক্রমশ বিসর্জনে যাচ্ছে স্বকীয় ভাবনা, নিজস্ব প্রচেষ্টা। এই অবস্থাটা কোনও নির্দিষ্ট রাজ্য বা সমাজের প্রশ্ন নেই এখন আর, সর্বত্রই এর প্রকোপ। সবচেয়ে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের বিরাট সংখ্যায় মানুষের চেতনাভূষণ। ‘অন্য মত’কে বলদর্পে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা এর আগেও অনেকবার ঘটেছে। একচ্ছত্র ক্ষমতায় বিশ্বাসী রাষ্ট্রীয় শাসকরা এই কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে। তবে তাদের সকলের নাম হিটলার বা স্তালিন নয়। কিন্তু গত কয়েক দশকে কেবল রাষ্ট্রীয় শাসকের বদলে এই অসহিষ্ণুতা, এই অধৈর্য বিকেন্দ্রায়িত হয়ে গিয়েছে। সমাজের নানা স্তরে অসহিষ্ণুতার ক্রোধ ও হিংসা প্রায় ফসল ক্ষেতের মতো ব্যাপ্ত। চিন্তার মনোকালচার সযত্নে চর্চা করার ফলে ভাবনাবিহীন বহু সাধারণ লোকও ‘ক্ষমতা’র যন্ত্র হিসেবে স্বেচ্ছায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদের মনে মনে কোথাও সমস্ত মানুষ ভাগ হয়ে যাচ্ছে দুটি মাত্র অবস্থানে—হয় তুমি আমার পেছনে নয় তো আমার মুখোমুখি। যেকোনও অন্য মতকেই মনে হচ্ছে বিরোধিতা এবং যেকোনও বিরোধিতাই ধ্বংসযোগ্য। অথচ প্রকৃতির নিয়ম এমন নয়। বিচিত্রতাই প্রকৃতির শক্তি। অসংখ্য বৈচিত্র্যের বিপুল সহাবস্থানের কারণেই নানা প্রতিকূল অবস্থায়ও প্রকৃতি টিকে থাকে। মানুষ প্রকৃতিরই এক সংস্থান, প্রাকৃতিক নিয়মের বিরোধী কোনও অবস্থানে সে রক্ষা পাবে না।

দীর্ঘকাল গড়ে ওঠা একটি সঙ্কটের চূড়ান্ত মুহূর্তে দাঁড়িয়ে চটজলদি কোনও ক্ষোভ প্রকাশ বা দোষারোপে এই সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যার গোড়া যতটা গভীরে প্রসারিত, ততখানি গভীরেই ধৈর্য ধরে, সচেতন চিন্তা নিয়ে নিরাময় চেষ্টা করতে হবে।

জাতিগত, লিঙ্গীয় বা ধর্মীয় পরিচয়, বর্ণ, মত, ভাষা বা অঞ্চল ইত্যাদি কখনও কোনও মানুষের অপরাধ হতে পারে না। অথচ এসব বিষয় নিয়ে অসহিষ্ণুতা, ‘ব্যাটাগিরি’ সমাজে, এমনকি নতুন প্রযুক্তির মঞ্চ ফেসবুকেও আলোচনা ও বিতর্কের পরিবেশ ক্রমেই সংকুচিত করে তুলছে। কুৎসা, হিংসা, দ্বেষ, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান, মিথ্যাচার ঢেকে দিচ্ছে মতের সঙ্গে মতের বিতর্কের পরিসর। প্রত্যেক মানুষের ধর্মে বিশ্বাস, ধর্মের নির্দিষ্ট তরিকা অনুসরণ কিংবা অবিশ্বাস, নির্দিষ্ট বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করার অধিকার আছে। প্রত্যেক মানুষের এই বিশ্বাসের প্রতি সম্মান জানাতে হবে। এই সম্মান রেখেই যেকোনও ধর্মমত পর্যালোচনার অধিকার সমাজে রক্ষা করতে হবে। কুৎসার সঙ্গে পর্যালোচনার তফাৎ বোঝার সক্ষমতাও সমাজে তৈরি হবে এই পরিসর তৈরি হলে। কথা বলা ও লেখার কারণে যদি আক্রমণ আসে, তখন নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন আরও বেশি কথা বলা ও লেখা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করলে যদি নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়, তাহলে নিরাপত্তার জন্য দরকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরও বেশি মানুষ জড়ো করা।

আর তা না হলে আমাদের নব্য যমদূতদেরই বাহবা দিতে হবে, উৎসাহ জোগাতে হবে। বলতে হবে– 'এসো লড়ি, এসো মারি, এসো মরি'। এভাবে লড়তে লড়তে, মারতে মারতে আর মরতে মরতে যদি কিয়ামত পর্যন্ত পৌঁছানো যায়!

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
ট্যুর অপারেশনে ব্যাংকে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা
ট্যুর অপারেশনে ব্যাংকে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
প্রসঙ্গ ‘অলক্তক’
প্রসঙ্গ ‘অলক্তক’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ