X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষ ও করুণা!

চিররঞ্জন সরকার
০২ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:৫১আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:৫২

চিররঞ্জন সরকার অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের সদ্য-বিদায়ী অধিনায়ক স্টিভ স্মিথদের বল বিকৃতি কাণ্ডে স্তম্ভিত ক্রিকেট দুনিয়া। একটা ভালো দিক হলো এই যে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী সরাসরি ধিক্কার জানিয়ে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা চেয়েছেন। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কর্তারা একটুও সময় নষ্ট না করে তদন্ত তো শুরু করেছেনই, তৃতীয় টেস্টের মাঝপথেই অধিনায়কত্ব ও সহ-‌অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন স্মিথ ও ওয়ার্নারকে। স্মিথ স্বীকার করেছেন, টিমের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরাই এই পরিকল্পনা করেছিলেন। অপকর্মের জন্য বেছে নেওয়া হয় তরুণ ব্যানক্রফটকে। বল টেম্পারিং করা হয় বেশি রিভার্স সুইং করানোর জন্য। টেম্পারিং না করেও কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। বলের একটা দিকে পালিশ, অন্য দিকটা খসখসে থাকা চাই। যারা ফিল্ডিং করেন, তারা একটা দিকের পালিশ রাখার জন্য সেই দিকটা প্যান্টে ঘষতে থাকেন। একে বলে ‘‌বল বানানো’‌। একটা সীমার মধ্যে থেকে এই কাজটি সব দলই করে। এতে অপরাধ নেই। কিন্তু কোনও কিছু দিয়ে ঘঁষে যখন বলের আকার-আকৃতি বদলানোর চেষ্টা করা হয়, তখন সেটা হয় অপরাধ। জেনে-শুনে অপরাধ করা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য। এর জন্য করুণা প্রকাশের সুযোগ কম।
স্মিথরা কী করলেন?‌ ব্যানক্রফট পকেটে শিরিষ কাগজ নিয়ে নামলেন, বল টেম্পারিং করার জন্য। টেলিভিশনে ব্যাপারটা আসতেই প্যাভিলিয়ন থেকে কোচ লেহম্যান অতিরিক্ত খেলোয়াড়কে পাঠিয়ে সতর্ক করে দেন। ব্যানক্রফট শিরিষ কাগজটা দ্রুত ঢুকিয়ে দেন প্যান্টের ভেতরে, ছবিতে যা স্পষ্ট। আম্পায়াররা ব্যানক্রফটকে চ্যালেঞ্জ করলে সে ভালো মানুষের মতো অন্য একটি নীল কাপড় পকেট থেকে বের করে দেখান। স্মিথও ব্যানক্রফটের পক্ষ নেন। কিন্তু যখন টেলিভিশন ক্যামেরায় সব স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে তখন স্মিথরা অপকর্ম স্বীকার করে নেন। অস্ট্রেলীয় বোর্ড কড়া শাস্তিই দিয়েছে টিমের মাথা স্মিথ ও ওয়ার্নারকে। বল টেম্পারিংয়ের ঘটনায় স্টিভেন স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নারকে ১ বছরের জন্য ও ক্যামেরন ব্যানক্রফটকে ৯ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করেছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। পাশাপাশি ওয়ার্নারকে দলের অধিনায়কত্বের জন্য কখনোই বিবেচনা করা হবে না বলে জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বোর্ড। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা কাটানোর পর এক বছরের মধ্যে স্মিথও অধিনায়কত্বের জন্য বিবেচিত হবেন না। এ অপরাধে আইসিসি শাস্তি হিসেবে স্মিথকে ম্যাচ ফির পুরোটাই জরিমানা করেছে, সঙ্গে এক টেস্টের নিষেধাজ্ঞা। আর ব্যানক্রফটকে ৩টি ডিমেরিট পয়েন্টসহ তার ম্যাচ ফির ৭৫ শতাংশ জরিমানা করেছে। 

বল টেম্পারিংয়ের ঘটনায় তিন ক্রিকেটারদের শাস্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাদের সংগঠন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (এসিএ)। তারা অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংগঠনটি দাবি করেছে, তিন ক্রিকেটারকে তাদের অপরাধের তুলনায় বেশি শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

একথা ঠিক যে ক্রিকেট বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশে একটি ‘ধর্ম’ হিসেবে গড়ে উঠছে। ক্রিকেটাররা আইকন বা জাতীয় হিরো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। এই ক্রিকেটাররা তাদের দক্ষতা-যোগ্যতা-নৈপুণ্য দিয়ে খ্যাতিমান হন—এটাই কাম্য। অন্যায় বা অপকর্ম করে খেলার ফলাফল নিজের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই নিন্দনীয়। বিষয়টি নিয়ে কোনও অনুরাগ বা বিরাগের সুযোগ নেই।

এ কাজটা বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা করলে টেস্ট স্ট্যাটাস কেড়ে নেওয়ার দাবি তুলত অস্ট্রেলিয়া। কাজেই অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কোনও সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা বাংলাদেশকে সব সময়ই অবজ্ঞা-উপেক্ষা করেছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর ১৮ বছর কেটে গেছে। অথচ দেড় যুগের এ সময় মাত্র একবার অস্ট্রেলিয়া সফর করতে পেরেছে টাইগাররা। আর তখন টেস্ট সিরিজও খেলতে চায়নি দলটি। বাংলাদেশকে কীভাবে একদিনেই টেস্ট হারিয়ে দেওয়া যায় এমন এক লজ্জাজনক ছকের কথাও জানিয়েছিলেন সে দেশের সাবেক এক ক্রিকেটার। যদিও বাস্তবে তা ঘটেনি। আর বাংলাদেশের মাটিতেও অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র দুটি সিরিজ। তা নিয়ে কত টালবাহানা। বাংলাদেশ টেস্ট খেলতে পারে এটা যেন তারা মানতেই পারেন না। এক টেস্ট হারলেই অস্ট্রেলিয়ান সাবেক ক্রিকেটাররা একহাত নেন টাইগারদের। শুধু বাংলাদেশই নয়, যেকোনও দলের বাজে সময়ে খোঁচাখুঁচিতে ওস্তাদ তারা। এবার সেই দলই করেছে মাঠে বল টেম্পারিংয়ের মতো ন্যক্কারজনক এক কাজ।

এর আগে ম্যাচ-গড়াপেটা বা জুয়াড়িদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করে পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা নিন্দিত হয়েছেন। এ তালিকায় ভারত ও বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়দের নামও আছে। এবার বাড়তি সুবিধা পেতে বলের আকৃতি পরিবর্তনের মতো কলঙ্কিত কাজে জড়িত হয়ে অস্ট্রেলিয়ানরা নিজেদের উঁচু নাক নিজেরাই ভোঁতা করেছেন।

ঘটনার পরদিন যখন টিভি চ্যানেলে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ ফাটিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন অস্ট্রেলিয়ার মহাতারকা ক্রিকেটার বর্তমানে ধারাভাষ্যকার অ্যালান বর্ডার, শেন ওয়ার্নরা চুপ করে শুনে যাচ্ছেন। কিছুই করার নেই। কী করবেন?

এতদিন আমাদের পাশের দেশ পাকিস্তানকে নিয়ে সবাই কানাঘুষা করত। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানরা যা করেছে তা একেবারেই অবিশ্বাস্য। এ জন্য তাদের অনেক মূল্য দিতে হবে। এরপর ওরা ভালো ক্রিকেট খেললেও সবাই বলবে প্রতারণা করেই জিতেছে! 

অনেকে এ প্রশ্নও তুলছেন, স্টিভ স্মিথ নিশ্চয়ই প্রথম নয়। এবার ধরা পড়েছে, কিন্তু চোখের আড়ালে কি এর আগে কিছুই করেনি? প্রবাদে আছে চোরের দশ দিন আর গৃহস্থের একদিন। বাকি নয় দিনের হিসাব কে নেবে? তবে এবারের হিসাবটা অস্ট্রেলিয়াকে ভালোভাবেই চোকাতে হবে।

তবে সেদিন সংবাদ-সম্মেলনে যখন স্টিভ স্মিথ কান্নাকাটি করলেন, বারবার সরি বললেন, তা দেখে বাঙালি হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে গেলো। অনেকেই বলাবলি করছেন, খেলায় এমনটি হতেই পারে। তাই বলে এতবড় শাস্তি! দু-চার ম্যাচ বহিষ্কার করলেই চলত! অথচ এই মন্তব্যকারীরাই বছর পর বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড ও অনেক ক্রিকেটারের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেছেন ওদের মোড়লগিরি ও অন্যান্য ছোট ক্রিকেট দলকে হেয় করে কথা বলার জন্য! বিভিন্ন সময় স্লেজিং করা ও সর্বশেষ বল টেম্পারিংয়ের জন্য শাস্তির দাবি জানিয়ে! আর এখন স্মিথ-ওয়ার্নার-লেহম্যানদের আবেগ দেখে তারাই আবার সব ভুলে করুণাসিক্ত হৃদয়ে ওদের ক্ষমা করতে বলছেন! কী বিচিত্র আমাদের মন!

পুনশ্চ: রুশ সাহিত্যিক আন্তন চেখভ এক গল্পে এনেছিলেন প্রসঙ্গটা। গল্পের নাম ‘বাজি’। কাহিনি এ রকম: এক ব্যাংক মালিকের বাড়িতে বসেছে সান্ধ্য পানভোজনের আসর। উপস্থিত শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। তো সে মাহফিল যখন বেশ জমে উঠেছে, তখন কথায় কথায় উঠল এক বিতর্ক। ইস্যু: মৃত্যুদণ্ড। অপরাধের ওই সাজা কতখানি নৈতিক বা অনৈতিক। প্রাণ যখন ঈশ্বরের দান, তখন কোনও মানুষ তা কেড়ে নেওয়ার হুকুম দিতে পারেন কিনা। হাজার হোক, জজ সাহেব তো আর ঈশ্বর নন। সুতরাং, সব রাষ্ট্রের উচিত তাদের পেনাল কোড থেকে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়া। এবং তার বদলে চরম শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাবাস চালু করা। তাতে মানুষের প্রাণ নেওয়ার পাপ কাজ থেকে অন্তত রেহাই।

অতিথিদের অনেকের রায় যখন এ রকম, তখন তর্কে যোগ দিলেন গৃহস্বামী। ব্যাংক মালিক মনে করেন, চরম শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের চেয়ে মৃত্যুদণ্ড ভালো। যাবজ্জীবন একাকী কারাবাস অসহ্য যন্ত্রণার ব্যাপার। তিলে তিলে মৃত্যু। তার চেয়ে কাউকে একেবারে মেরে ফেলা ভালো। এ কারণে মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রের পেনাল কোড থেকে মুছে ফেলা উচিত নয়।

ব্যাংক মালিকের এই দাবিতে তর্কে যখন নতুন মাত্রা, তখন তাতে যোগ দিলেন অতিথিদের একজন। এক তরুণ আইনজীবী। তার যুক্তি–একেবারে মরে যাওয়ার চেয়ে যে কোনোভাবে—হাজার কষ্টের মধ্যেও—প্রাণে বেঁচে থাকা ভালো। সুতরাং, মৃত্যুদণ্ড উঠিয়েই দেওয়া দরকার।

আইনজীবীর এই দাবিতে বিতর্ক যখন জমে উঠল, তখন তাতে বাড়তি ইন্ধন জোগালেন ব্যাংক মালিক। তিনি মন্তব্য করেন বছরের পর বছর একাকী কারাবাস যে কী যন্ত্রণার, তা ভুক্তভোগী ভিন্ন কারও বোঝার ক্ষমতা নেই। বহুকাল নয়, পাঁচটা বছর জেলের কুঠুরিতে একা থাকুন, তাহলেই তিনি বুঝবেন কেমন মরণ যন্ত্রণা তাতে।

বিতর্কের একপর্যায়ে আইনজীবী বললেন, পাঁচ বছর কেন, ১৫ বছর একাকী কারাবাসে যেতে তিনি প্রস্তুত।

ব্যাংক মালিক এবার বাজি ধরলেন আইনজীবীর সঙ্গে। ১৫ বছর একাকী কারাবাস করতে পারলে তিনি আইনজীবীকে দেবেন দু’মিলিয়ন রুবল। আর,যদি যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনি জেলের বাইরে বেরিয়ে আসেন একদিনও আগে, তা হলে তিনি পাবেন না এক কপর্দকও। বিচিত্র এই বাজিতে রাজি হলেন আইনজীবী। তিনি গেলেন অন্ধকার এক ঘরে।

চেখভের গল্পে পরিণতি বিচিত্র। একদিকে শেয়ারবাজারে ধসের ফলে ব্যাংক মালিক আমির থেকে গরিব। অন্যদিকে কুঠুরিতে বছরের পর বছর কাটাতে কাটাতে আইনজীবী উপলব্ধি করলেন কঠিন এক সত্য। অর্থ উপার্জন সুখের গ্যারান্টি নয়। তাই, কুড়ি লক্ষ রুবল পাওয়ার হাতছানি উপেক্ষা করে ১৫ বছর বন্দিজীবন শেষ হওয়ার দু’দিন আগে বেরিয়ে গেলেন কুঠুরি থেকে। কাউকে কিছু না জানিয়ে।

দুর্ভাগ্যপীড়িত ব্যাংক মালিক কুড়ি লক্ষ রুবল হারানো থেকে রেহাই পেলেন বটে, কিন্তু বাজি জিতলেন কি তিনি?

যারা জেতার জন্য, লোভ বা লাভের জন্য অনৈতিক পথ বেছে নিয়ে ধরা পড়েন, ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত হন, তারা কি আসলেই জেতেন? নাকি নিঃস্ব হয়ে যান চিরতরে?

এই সত্যটা সব মানুষেরই উপলব্ধি করা উচিত।

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ