X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মামলার রায়: রাজপথ না উচ্চ আদালত

আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৫:৫৪আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬:০৮

আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত মামলার রায়ে তিনি এখন কারাগারে। মামলাটি ১০ বছর ধরে চলার পর রায় হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীগণ আইনি লড়াই করেছেন। দুদকের আইনজীবীরাও লড়েছেন। এর মাঝে মামলাটি বাতিল ও স্থগিত চেয়ে আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে লড়াই করেছেন। একাধিকবার আদালত বদল হয়েছে আসামিপক্ষের ইচ্ছায়। প্রধান আসামির দীর্ঘদিন আদালতে অনুপস্থিতির কারণে মামলা বিলম্বিত হয়েছে। অগত্যা আদালত জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর সরকার রাজনৈতিক বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্য নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ করে তাকে গ্রেফতার করেনি। পুনরায় আদালতে হাজির হয়ে জামিন লাভের সুযোগ করে দিয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার ইচ্ছেমত হাজির হওয়ার ওপর নির্ভর করে আদালত বসেছে। অন্য জনগণের ক্ষেত্রে আদালত নিজ সিদ্ধান্তে সময়, সুবিধামত বসে এবং মুলতবি হয়। আসামিদের অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ কাঠগড়ার বাইরে বা কোর্ট হাজতে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়। এক্ষেত্রে ছিল ব্যতিক্রম। আদালতের ইচ্ছায় আসামি নয়, আসামির ইচ্ছায় আদালত চলেছে।

প্রধান আসামি আত্মপক্ষ সমর্থনের নামে দীর্ঘ রাজনৈতিক বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছেন। আসামি পক্ষের আইনজীবীগণ মনের মাধুরী মিশিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছেন। বাস্তব অবস্থা, আসামি পক্ষের আইনজীবীগণ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ও কথার ভাণ্ডার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আদালত ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে তাদের বক্তব্য শুনেছেন। যার সিংহভাগই মামলার বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে বিজ্ঞ আদালত রায় দিয়েছেন। নিম্ন আদালতের রায়ে আসামিপক্ষ অথবা বাদীপক্ষের অথবা উভয় পক্ষের সংক্ষুব্ধ হওয়ার অনেক যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে। এজন্য আইন উভয়পক্ষের জন্য যুক্তিযুক্ত সুবিধার দ্বার উন্মোচন রেখেছে। উভয় পক্ষই উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। এজন্যও আইনের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। এই সমাধান রাজপথে হবে বলে যারা বিশ্বাস করেন তাদের মস্তিষ্কের চিকিৎসা প্রয়োজন।
আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সকল দলের নীতি-আদর্শ, কর্মসূচি, কর্মকাণ্ড ও কৌশল জানার চেষ্টা করি। আমার মনে হয়, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিতে আস্থা-বিশ্বাসের সংকট চলছে। বাবা ও মায়ের টিমের সঙ্গে পুত্রের টিমের নীরব সংঘাত। বিএনপিতে তারুণ্যের উত্থান ও চরম আধিপত্য বিস্তারে পরীক্ষিত, অভিজ্ঞ সিনিয়র নেতা, সমমনা বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, আমলা, সাংবাদিকগণ দলে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছেন। ফলে আন্দোলন বা আইনি লড়াই সবখানেই সিনিয়রদের অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত নয়।  কোনোরকমে রাজনীতিতে টিকে আছেন তারা।
অন্তত দুটি মামলার ক্ষেত্রে বিএনপির প্রচেষ্টা আন্তরিক মনে হয়নি। বিএনপি উকিল ব্যারিস্টারে ভরা। সুপ্রিম কোর্ট বার তারা দীর্ঘদিন ডমিনেট করে আসছেন। বেঞ্চেও তাদের প্রভাব সর্বজনবিদিত। কিন্তু তারা চেয়ারপারসনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি মামলায় নাস্তানাবুদ হয়েছেন।
চেয়ারপারসনের ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির মামলাটি তারা ইচ্ছে করলেই দীর্ঘায়িত করতে পারতেন। তারা একবারে হাইকোর্টে না গিয়ে নিম্ন আদালত থেকে শুরু করলে কমপক্ষে দেড় যুগ সময় লাগতো বাড়ির মামলা ফয়সালা হতে। কিন্তু  সরাসরি উচ্চ আদালতে গিয়ে ১-০ গোলে পরাজিত হওয়া বেশ রহস্যজনক।
একইভাবে দুদকের মামলায় বিএনপির আইনজীবীদের ভূমিকায় চৌকস পেশাদারিত্ব নজরে পড়েনি। বরং অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরিবর্তে জামিন বিশেষজ্ঞ উকিলদের দিয়ে মামলাটি হ্যান্ডেল করানো আমার কাছে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র মনে হয়েছে। যেহেতু দলে সিনিয়রদের কোনও মূল্য নেই সেহেতু তারা কী চাচ্ছেন, চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মামলায় হেরে গিয়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন, কারাগারে যান। তাতে একদিকে তাদের নেত্রীর প্রতি জনগণের সহানুভূতি বাড়বে, ভাইস চেয়ারম্যানের প্রতি জনরোষ কমবে এবং পুত্রের প্রতি মাতার নির্ভরতা কমবে। সেই সুযোগে জনসিম্পেথির কারণে নির্বাচনে জয়লাভ সহজ হবে এবং তরুণদের জায়গায় সিনিয়রদের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
আলিশান প্রাসাদ হস্তচ্যুত হবে চেয়ারপারসনের; যার উত্তরাধিকার ভাইস চেয়ারম্যান। এটি থাকলে বা না থাকলে নেতাদের কী আসে যায়? জেল খাটলে খাটবেন চেয়ারপারসন। তাতে নেতাদের সমস্যা কী? বরং জেল খাটলে তিনি উপলব্ধি করতে পারবেন তিনি অতি পুত্রবাৎসল্যে কী কী ভুল করেছেন। সংশোধিত হতে পারবেন। তাতেও সিনিয়রদের লাভ। তাছাড়া বিএনপি’র কেন্দ্রীয় পর্যায়ের পারস্পরিক সম্পর্ক আত্মিক নয়। আওয়ামী লীগ বা অন্যান্য দলের মতো পারস্পরিক মমত্ববোধ নেই। সুতরাং কারো জেল খাটা তাদের মনোজগতে তেমন প্রভাব বিস্তার করে না । সুতরাং এ ধারণাটি অমূলক নয়।
দ্বিতীয় একটি কারণ মাথা থেকে ফেলতে পারছি না। বিএনপির ব্যারিস্টার সাহেবরা কোনও মামলা বিনা ফিতে লড়েন না। দলের নেতা বা ত্যাগী, পোড়খাওয়া কর্মী কারও মামলা তারা উচ্চ পারিশ্রমিক ছাড়া মুভ করেন না। বিএনপির একজন জেলা সভাপতি ও তাদের দলের দুঃসময়ের সংগঠক আমাকে বলেছেন, তার একটি মামলায় প্রখ্যাত ‘মিষ্টভাষী’ স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার সাহেবকে প্রতি শুনানিতে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম পরিশোধ করতে হতো। একদিন তিনি টাকা দিতে না পারায় জুনিয়র পাঠিয়ে শুনানির তারিখ পিছিয়ে নিয়েছেন। ১/১১ চলাকালে অনেক প্রভাবশালী বিএনপি নেতার স্ত্রীগণ সময় মতো ও চাহিদা মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তারা ব্যারিস্টার সাহেবদের দ্বারা মৌখিকভাবে অপমানিত হয়েছেন। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি।
এমনও হতে পারে বেগম খালেদা জিয়া বা তার পরিবার ব্যারিস্টার সাহেবদের ‘পেশাদারিত্বে’র ফিস নগদ পরিশোধ করেননি বিধায় তারা দু’দকের মামলা নিয়ে সিরিয়াস হননি। ভবিষ্যতে পদ প্রাপ্তি ও মিডিয়া খ্যাতি পাওয়ার বাসনায় উকিলরা মামলায় অংশ নিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসে অজ্ঞতাবশত মামলার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়া অপরাধী কী নির্দোষ তা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। তা নির্ধারণের ক্ষমতা আদালতের। নিম্ন আদালত রায় দিয়েছে। এখন আপিল হলে উচ্চ আদালত যা সিদ্ধান্ত দেবেন তাই শিরোধার্য। আমার বক্তব্যটি হচ্ছে, যেহেতু এটি একটি ক্রিমিনাল অফেন্সের মামলা, সুতরাং মামলাটি রাজনৈতিকভাবে না নিয়ে অধিকতর পেশাদারিত্বের সঙ্গে বিএনপির মোকাবেলা করা উচিত ছিল।

দ্বিতীয় আরেকটি বিষয়, বিএনপি কি তাদের চেয়ারপারসনের মুক্তি চাচ্ছে, নাকি তার কারাবাস দীর্ঘায়িত করে পাবলিক সিম্পেথি জাগানোর চেষ্টা করে রাজনৈতিক ফায়দা লাভ করতে চায়। যদি চেয়ারপারসনের মুক্তি তাদের নিকট মুখ্য হয়, তাহলে রাস্তায় চিৎকার করে কি তারা তাকে মুক্ত করতে পারবেন? তারা এত বড় বড় আইনজীবী, তারা কি পথ জানেন না? তারা প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রী ছিলেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, দীর্ঘ জন-রাজনীতি ও প্রাসাদ রাজনীতির অভিজ্ঞতা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী এখন কোনও রাজনৈতিক বন্দি নন, তিনি ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মুক্ত করার কোনও ক্ষমতা সরকারের নেই। সুতরা আন্দোলন করে নেতাদের ছবি টেলিভিশনে দেখানো যাবে, কর্মীর শরীরের ঘাম ঝরবে, বেগম জিয়ার কোনও লাভ ক্ষতি হবে না। হয়ত বিএনপি লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের উচিত, উচ্চ ফিস পরিশোধ করে উপযুক্ত আইনজীবীদের দ্বারা আইনি কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া।

লেখক: সংসদ সদস্য ও সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ