X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘থ্রি জিরো’র প্যারিস বিজয়

গোলাম মোর্তোজা
০৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:১৮আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:২১

গোলাম মোর্তোজা সম্মেলনটি বিশাল। জানার আছে অনেক কিছু। আবার আমাদের জন্য বাঁধাধরা কোনও নিয়ম নেই। বলছি ‘অষ্টম গ্লোবাল সোশ্যাল বিজনেস সামিট ২০১৭’-এর কথা। প্যারিসে এসেছি সামাজিক ব্যবসার শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস, ইউরোপের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর। কেন জানি না, প্যারিসকে সব সময়ই আমার কাছে বিশাল কিছু একটা মনে হয়। ছবির শহর কবিতার শহর প্যারিসে প্রতিদিন-প্রতি মুহূর্তে কত রকমের কত যে আয়োজন! সেই শহরে বাংলাদেশের একজন মানুষকে কেন্দ্র করে একটি শীর্ষ সম্মেলন, তা আলাদা করে গুরুত্ব পাবে— ভাবনায় আসে না। এবার প্যারিসে না এলে ভাবনায় সত্যি কোনোদিন আসত না। সামাজিক ব্যবসার খুঁটিনাটি দিক নয়, গত তিন চার দিনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলছি।
১. ‘আপনি কিন্তু ২০২৪ সাল পর্যন্ত অবশ্যই আমাদের সঙ্গে থাকবেন। আপনার সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে কাজে লাগিয়ে আমরা অলিম্পিক আয়োজনের সম্মান অর্জন করেছি একশ বছর পরে। আপনাকে অবশ্যই আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে।’
একবার হাত ধরে, একবার কাঁধে হাত রেখে কথাগুলো বলছিলেন তিনি। একটু পরে জানলাম, কথাগুলো যিনি বলছিলেন তিনি প্যারিস নগরের ডেপুটি মেয়র।

সামাজিক ব্যবসা সম্মেলনের প্রথম দিন প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগোকেও ঠিক একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে দেখলাম। বিশ্বাসের সীমা অতিক্রম করে গেলো। বাংলাদেশের একজন মানুষ ড. মুহম্মদ ইউনূস, তাকে প্যারিসের মেয়র এবং ডেপুটি মেয়র দু’জনে এভাবে অনুরোধ করছেন। নিজ চোখে না দেখলে, গল্প শুনে শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হওয়ারই কথা।

২. ডেপুটি মেয়রের কাছে জানতে চেয়েছিলাম— ফ্রান্স অলিম্পিক আয়োজন করবে, সেখানে ড. ইউনূস এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? কেন আপনারা বারবার ড. ইউনূসকে সঙ্গে থাকার জন্যে অনুরোধ করছেন?

‘ড. ইউনূস শুধু আমাদের কাছে নয়, সারাবিশ্বের কাছে অনেক বড় কিছু। আমরা ড. ইউনূসকে জানি, তার কাজ সম্পর্কে জানি, বাংলাদেশকে সম্মান করি। এটা আপনাদের জন্যে অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার যে ড. ইউনূস বাংলাদেশের একজন মানুষ। ড. ইউনূসের যে সামাজিক ব্যবসা, তার যে থ্রি জিরো তত্ত্ব, সেটাকে ধারণ করে আমরা অলিম্পিক আয়োজক দেশ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ, অলিম্পিক কমিটি আমাদের সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে পুঁজি করে আমরা অলিম্পিকের আয়োজক দেশ হওয়ার সম্মান অর্জন করেছি। ড. ইউনূসের চিন্তাধারাকে আমরা আরও বড়ভাবে কাজে লাগাতে চাই।’

এই কথাগুলো শুনে কার কী অনুভূতি হতো বা হবে, জানি না। আমি শিহরিত হয়ে উঠছিলাম বারবার। বাংলাদেশের একজন মানুষের এত সম্মান, পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি ফ্রান্সের কাছে!

৩. সামাজিক ব্যবসা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন স্পেনের কুইন সোফিয়া, লুক্সেমবার্গের গ্র্যান্ড ডাচেস, জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব। প্যারিসের মেয়র, ডেপুটি মেয়র তো ছিলেনই।

সবার বক্তব্যেই ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক, ইউনূস সেন্টার, বাংলাদেশের প্রশংসা। লুক্সেমবার্গের গ্র্যান্ড ডাচেস বললেন, ‘দেখেন, ফ্রান্সের মতো একটি দেশ ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে কাজে লাগিয়ে অলিম্পিক আয়োজনের স্বাগতিক দেশ হওয়ার সম্মান অর্জন করছে। চিন্তা করা যায় এটা কত বড় ঘটনা!’

২০২৪ সালের ফ্রান্স অলিম্পিকের মূল থিম ড. ইউনূসের ‘থ্রি জিরো’। জিরো প্রোভার্টি, জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট, জিরো কার্বন— এটা ড. ইউনূসের তত্ত্ব। এই তত্ত্বের ওপর এরই মধ্যে তিনি বই লিখেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন দেশ থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা ‘থ্রি জিরো’ ধারণা পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত সব দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এরই দৃশ্যমান কিছু বিষয় দেখা যাচ্ছে প্যারিসে।

৪. প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগো প্যারিসের সম্মানজনক নাগরিকত্বের সনদ তুলে দিলেন ড. ইউনূসের হাতে। মেয়র সামাজিক ব্যবসায় রাজধানী বানাতে চান প্যারিসকে। শুধু কথায় নয়, কাজেও তার প্রমাণ রেখেছেন। প্যারিসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ট্যুরিজম এলাকা স্টার্লিনগ্রাডের জুরিস পার্ক এলাকা। প্রতিদিন হাজার হাজার টুরিস্ট আসে এই এলাকায়। বিশাল লেক, পাশ দিয়ে সারি সারি রেস্টুরেন্ট। পার্কের মতো খোলা জায়গা। লেকের পাড়ে শত বছরেরও বেশি পুরনো তিন বা চারতলা একটি ভবন। এত পুরনো ভবন-আসবাবপত্র সব কিছু আবার রিসাইক্লিং করে তকতকে- ঝকঝকে করে গড়ে তোলা হয়েছে। এই বিল্ডিংটিতে ইউনূস সেন্টারের অফিস হিসেবে বরাদ্দ দিয়েছেন মেয়র অ্যান হিদালগো। ইউনূস সেন্টারের এই অফিস পরিদর্শনে এসে ড. ইউনূসও কিছুটা আবেগে আপ্লুত। এই ভবনে দাঁড়িয়েই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের কাছে জানতে চাইলাম, ফরাসিদের কাছে আপনার এত গুরুত্বের কারণ কী?

‘‘এটা তো এক ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা সবাই মিলে কাজ করেছি। সেই কাজগুলো তারা দেখেছেন। সেই কাজের প্রতি তারা সম্মান দেখিয়েছে। তারা আমাদের কাজের কারণে বাংলাদেশকে সম্মান করেন। প্যারিস নগর কর্তৃপক্ষ সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আমাকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। এটা তো অনেক বড় একটা সম্মান। তারা এই যে অফিসটি ইউনূস সেন্টারকে দিলো, এটাও তো সম্মান জানানোরই নমুনা। প্যারিসের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে ইউনূস সেন্টারের জন্যে অফিস পেলাম আমরা; এটা তো বাংলাদেশের জন্য খুবই সম্মানজনক ঘটনা। এরই মধ্যে ইউনূস সেন্টার প্যারিসে রেজিস্ট্রেশন করেছে। এখন পূর্ণ উদ্যোগ কাজ শুরু হবে। তারা আমাদের ‘থ্রি জিরো’ ধারণা গ্রহণ করেছে। মেয়র প্রস্তাব দেওয়ার সময়ই বলেছিলেন, অলিম্পিকের সঙ্গে বিশাল ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপার থাকে। ২০২৪ সালের অলিম্পিককে সামাজিক ব্যবসা অলিম্পিক করতে চাই আমরা। এই কারণেই ২০২৪ সালের অলিম্পিকের মূল থিম ‘থ্রি জিরো’।’’

৫. পৃথিবীর ৫০টি দেশ থেকে ৭২০ জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন এবারের সামাজিক ব্যবসা শীর্ষ সম্মেলনে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ৮৭ জনের প্রতিনিধি দল। রেজিস্ট্রেশন ফি ছিল ১৩০০ থেকে ১৭০০ ইউরো। ২৬টি দেশ থেকে ১৩০ জনের মতো তরুণ উদ্যোক্তা এসেছেন। যারা সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। আরও নতুন অনেক কিছু করতে চাইছেন। তাদরেকে নিয়ে মূল সম্মেলনের বাইরে দু’দিন সাইড ইভেন্ট ছিল। সেখানেও বক্তৃতা করলেন ড. ইউনূস। নতুন তরুণ উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন দেখালেন।

প্যারিস সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিশাল খোলা চত্বরে তাঁবু দিয়ে সব সুবিধা সমন্বয়ে অস্থায়ী অডিটরিয়াম বানানো হয়েছে। সেখানেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই সম্মেলন।

৬. ইউনূস তার প্রথম দিনের বক্তৃতায় বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি আবারও তুলে ধরেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জটিলতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের আলোচনার বিষয় ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার অভিনব ধারণা এবং তার ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্ব। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে অ্যাকটিভিস্ট— সবাই আছেন। তাদের ধারণা অনেক বছর পর ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতিতে একটি নতুন ধারণা এসেছে— সামাজিক ব্যবসা ও ‘থ্রি জিরো’, বিশ্বব্যাপী এরই মধ্যে যা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এটা শুধু তত্ত্বে সীমাবদ্ধ নেই। এর প্রয়োগ দৃশ্যমান হয়েছে, সাফল্য প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া এই তত্ত্ব নিশ্চয় আগামী দিনে আরও বড়ভাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে, যার মধ্যে দিয়ে ড. মুহম্মদ ইউনূসের বিশালত্ব আরও বাড়বে, পৃথিবীব্যাপী দৃশ্যমান হবে। তিনি এবং তার তত্ত্ব-কাজ কেন বর্তমান ও আগামী পৃথিবীর জন্যে অপরিহার্য, তা আরও বড়ভাবে প্রমাণ হবে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

/এসএএস/টিআর/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ