X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সন্তানের মনের খবর রাখছেন?

কাকলী প্রধান
০৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:০২আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:০৪

কাকলী প্রধান মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে বেরিয়ে আমার গাড়ি গুলশান এক নম্বরের দিকে মোড় নিলো। পাশ দিয়ে একটা কালো গাড়ি দ্রুত গতিতে চলে গেলো দামামা বাজিয়ে। মহাখালী থেকে গুলশান একবার থেমে যেতে হচ্ছে ঢাকা শহরের স্বাভাবিক ট্রাফিক বিড়ম্বনায়। এই বিড়ম্বিত সন্ধ্যায় কালো গাড়িটা কখনও এগিয়ে থাকছে কখনও পিছিয়ে। অতোটা খেয়াল হয়নি তবু তীব্র আওয়াজে বিরক্ত হয়েই তাকাচ্ছিলাম গাড়ির দিকে। বিরক্তিটা যেন অনেকাংশেই গাড়ির চালকের ওপর যা হয়ে গাড়িটার ওপরই বেশি হচ্ছিল। এক নম্বর চত্বরের কাছে এসে যখন ঠেকলাম, কেন জানি না সেই কালো গাড়ির জানালায় চোখ আটকে গেলো। গ্লাস নামানো। জানালার বাইরে একটা হাত। আঙুলে ধরা সিগারেট থেকে কালো ধোঁয়া উড়ছে। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম হাতটা কোনও তরুণ যুবক বা বয়স্ক মানুষের নয়। অতি নরম ছোট্ট আদরে বেড়ে ওঠা একজন কিশোরের হাত। বুঝে ওঠার আগেই  গাড়িগুলো নড়েচড়ে উঠলো। খোলা জানালায় দেখলাম এক কিশোর। বয়স খুব বেশি হলে চৌদ্দ, পনের বা ষোল। এক হাতে স্টিয়ারিং উদ্ধত ভঙ্গি। ওর হেয়ার স্টাইল, ওর এই সিগারেটের ছাই ফেলার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ওর বেড়ে ওঠার গল্পটি। স্বভাবদোষে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। হয়তোবা  নেহায়েতই মধ্যবিত্ত ধ্যানে পুষ্ট মানসিকতার চাপেই বিপর্যস্ত হলাম।
কিশোরের আচরণ যাইহোক ওর কোমল অথচ উদ্ধত মুখটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। করুণায় মায়ায় বেশ ভারী হয়ে গেলো মনটা। কার সন্তান জানা নেই। তবু চোখ ছাড়া হলেই যেন কী একটা মূল্যবান জিনিস হারিয়ে ফেলব শঙ্কা হলো। সবুজবাতি  জ্বলতেই কালো গাড়িটা উধাও। আর ওর যাওয়ার পরেই বুঝতে পারলাম আমি একা নই। অনেকেই ওকে প্রাণ ভরে দেখছেন, কেউ আবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে। বিরক্তি নিয়ে দেখার অধিকার সত্যি কি আমাদের আছে? ওরাতো আমাদেরই সম্মিলিত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ফসল।

মনে পড়লো কয়েকদিন আগের একটা ঘটনা। একটি আবাসিক এলাকার কাছে খোলা জায়গায় একজন মডেলের ছবি তুলছি। একটি প্রাইভেট জিপ আর দুটো প্রাইভেট কারে জনা ১২ কিশোর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ধুলো উড়িয়ে শাঁ শাঁ বেগে  ছুটে গেলো। আবার ফিরে এলো। কিন্তু ফিরে এসেই এমন কিছু আপত্তিকর শব্দ এবং ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিলো যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। তবু কেন যেন একবারও ওদের ওপর রাগ হলো না।

বারবার স্বভাবদোষে মাথায় কতোগুলো প্রশ্নই ঘুরতে থাকে। তোমরা কাদের বাড়ির ছেলে গো? ওরা কিভাবে গাড়ির চাবি হাতে পায়? আমরা বাবা-মা’রা কি জানি আমাদের এই কিশোর সন্তানরা ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়? আমরা বোধ হয় কেউ কেউ জানি এবং গর্বিত বাবা-মা হওয়ার চেষ্টা করি। উদাসীনতা! অবহেলা! নাকি অতিমাত্রায় প্রশ্রয়!

এবার দেখা যাক ঢাকার আরও কিছু আবাসিক এলাকার চিত্র। ধানমণ্ডির  বেশ কিছু সড়কে প্রায় প্রতিদিন গাড়ির রেস চলে। চালক? সেই আঠারো না পেরুনোর দল। গুলশান, বনানী, বনশ্রীসহ অন্যান্য আবাসিক এলাকাগুলোরও একই চিত্র। প্রশ্ন জাগে–আমরা এই প্রজন্মের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাবা-মায়েরা কি অতিরিক্ত ভোগ বিলাসিতার জীবনে ঢুকে পড়ছি? এই ভোগের আনন্দ কি আমাদের এতোটাই মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে আমরা সঠিক বিচার বুদ্ধি প্রয়োগের জ্ঞান হারাতে বসেছি?

ভুটানের রাস্তায় কোনও ভোগ্য পণ্যের বিলবোর্ড টাঙানোর অনুমতি নেই। কারণ তারা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভোগী হিসেবে গড়তে চায় না। প্রতিটি স্কুল-কলেজে একজন মনস্তাত্ত্বিক আছেন। তারা প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের মনের খবরটি পাঠের চেষ্টা করেন। সেইসব শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত দেশকে ভালোবাসার শিক্ষা দিতে থাকেন। অনেকটা মানসিক কাউন্সিলিংয়ের আদলে। আমরা বোধ হয় নিজেদের ওপর বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছি। নিজেদের সংস্কৃতির ওপর ভরসা রাখতে পারছি না। আমাদের শিশু-কিশোর-কন্যা সন্তানদের সুন্দর হওয়ার জন্য পার্লারে পাঠাই। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের উদ্ভট চুলের ছাট এবং চুলের রঙ কিভাবে আমরা বাবা-মা-শিক্ষকরা মেনে নিতে পারি বোধগম্য নয়। যখন শিশু-কিশোররা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছে তখন ট্রাফিক সিস্টেম কোথায় থাকছে? আবার যখন তাদের ধরা হচ্ছে তখন গর্বিত বাবা-মা’রা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সন্তানকে বাড়ি নিয়ে আসছেন। সন্তানদের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অহংকারকে কয়েকদফা এগিয়ে উচ্চবর্ণ হওয়ার চেষ্টা করছি। আসলে গলদটা শেকড়েই। পাল্লা দিয়ে পুঁজিবাদী  ভোগবাদি হয়ে ওঠার যে প্রতিযোগিতা আমরা জানান দিয়ে শুরু করেছি তারই বাস্তব রূপ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

আসুন আমরা সবাই মিলে দেশটাকে একটু ভালোবেসে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করি। আসুন রাষ্ট্রের জন্য একটি কাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং অধিকারবোধ, অধিকার প্রয়োগেরও সঠিক মূল্যায়ণ করি। যা আমার আগে থেকেই আছে তা হলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। এগুলো ইউরোপ আমেরিকা থেকে ধার করতে হবে না। সহজ ভাবে অন্যকে গ্রহণ করার যে গুণ বা প্রবণতা আমাদের মধ্যে আছে তাকে কিছুদিনের জন্য কিছুটা রোধ করে একটা সুস্থ শিক্ষা এবং সংস্কৃতিমুখী রাষ্ট্র হিসেবে দেশটাকে সহণীয় করে তুলি।

আসুন আমরা আমাদের সন্তানদের সারল্যময় কৈশোরের মধ্য দিয়ে নিজেদের ফেলে আসা কৈশোরবেলাকে স্পর্শ করে দেখি।

লেখক: সিনিয়র ফটোসাংবাদিক, দৈনিক কালের কণ্ঠ

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ