X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ‘জনপ্রতিনিধি’!

গোলাম মোর্তোজা
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:৩৩আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:৩৫

গোলাম মোর্তোজা যে দূরদৃষ্টি দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট উপলব্ধি বা অনুধাবন করা প্রয়োজন ছিল, বাংলাদেশ পরিচালনাকারীরা তা কখনও করতে পারেননি। যদিও ১৯৭৭-৭৮ সালে জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় এবং ১৯৯১-৯২ সালে খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায়, তখন মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করে আগত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় সাফল্য। সঙ্গে একথাও মনে রাখা দরকার, সেই সময় চীন মিয়ানমারের এত বড় বন্ধু ছিল না। ভারতও ছিল না মিয়ানমারের সঙ্গে। মধ্যপ্রাচ্য তথা ওআইসি শক্তিশালী ছিল। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারকে বাধ্য করা গিয়েছিল রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে। আজকের বিশ্ব প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। চীন, ভারত, রাশিয়ার কারণে এবং মধ্যপ্রাচ্য তথা ওয়াইসি দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে মিয়ানমারকে বাধ্য করা প্রায় অসম্ভব। আজকের আলোচনায় সেদিকে যাবো না। আলোচনা করবো রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধাবাদের রাজনীতি ও নীতিহীন অবস্থান নিয়ে।
১. ভোটের রাজনীতি এবং প্রভাব বিস্তারের জন্যে বিএনপি-জামায়াত শুরুতে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেছে। তাদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে সহায়তা করেছে। তারপর আওয়ামী লীগও একই নীতি অনুসরণ করেছে। টেকনাফ, কক্সবাজারের কিছু এলাকা এবং বান্দরবানে অবাধে মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছে। প্রথমে বিএনপি-জামায়াত এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ এদের নাগরিক হতে ভূমিকা রেখেছে। গত দশ বারো বছরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করিয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র করে দিয়েছে। অর্থের বিনিময়ে অনেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে গেছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে মালয়েশিয়াতেও গেছে অনেক রোহিঙ্গা।

২. রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাজনীতির এই গড়পড়তা অভিযোগ অনেকবার আলোচনা হয়েছে। আজ একটু সুনির্দিষ্টভাবে কিছু তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করছি। মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গারা যে শুধু বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছে তাই নয়, তারা ‘জনপ্রতিনিধি’ও নির্বাচিত হয়েছে। বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো বড় রাজনৈতিক দলের পদ-পদবিও পেয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে অনুসন্ধান করেছি বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ি উপজেলা নিয়ে। অনুসন্ধান করিনি, তবে তথ্য জানি টেকনাফের জনপ্রতিনিধিদেরও একটা বড় অংশ মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা এবং তারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির রাজনীতি করে। যাই হোক সুনির্দিষ্ট করে নাইক্ষংছড়ি প্রসঙ্গে আসি।

ক. নাইক্ষংছড়ি ১ নম্বর অর্থাৎ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল চৌধুরী। তার বাবা জাফর হাবীব মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসে ১৯৭৬ সালে। রোহিঙ্গাদের প্রথম সশস্ত্র সংগঠনের নাম ‘রোহিঙ্গা প্যাট্রিয়ট ফ্রন্ট (আরপিএফ)’। জাফর হাবীব ছিলেন ‘আরপিএফ’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৮৪ সালে মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কাতে অনুষ্ঠিত ‘ইসলামী সামিট কনফারেন্সে’ যোগ দিয়ে ‘আরপিএফ’র সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাফর হাবীব। ‘আরপিএফ’ পরবর্তীতে ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)’ নাম ধারণ করে স্বাধীন আরাকানের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। জাফর হাবীব ছিলেন সশস্ত্র ‘আরএসও’র কমান্ডার। জাফর হাবীব নাইক্ষংছড়িতে বাড়ি করেন ১৯৮০ সালের দিকে। গত ইউপি নির্বাচনে নাইক্ষংছড়ি সদর থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা সৈয়দ হাজী। তিনি হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করার পর উপনির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জাফর হাবীবের ছেলে তসলিম ইকবাল চৌধুরী। হাজী সৈয়দের আগে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন আরেক রোহিঙ্গা মুহম্মদ নবী।

বর্তমান চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল চৌধুরী নাইক্ষংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম সচিব। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও মূলত ‘আরএসও’ পরিচালনা করেন।

খ. মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা আলহাজ হাবিবুল্লাহ। তিনি নাইক্ষংছড়ি ৪ নম্বর দোছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন সভাপতি।

গ. দোছড়ি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জমির হোসেন। তিনি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। দোছড়ি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল আমিন। তিনিও রোহিঙ্গা এবং ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি।

ঘ. দোছড়ি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুর রহমান। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শফিকুর রহমান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি।

ঙ. নাইক্ষংছড়ি সদর ইউনিয়নের সদস্য রোহিঙ্গা আরিফ উল্লাহ ছুট্টো। তিনি নাইক্ষংছড়ি উপজেলা যুবদলের সভাপতি।

চ. নাইক্ষংছড়ি সদর ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য জহুরা বেগম। রোহিঙ্গা জহুরা বেগম ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

ছ. নাইক্ষংছড়ি সদর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রোহিঙ্গা মো. ফখরুল ইসলাম কালু। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি।

জ. নাইক্ষংছড়ি সদর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আলি আহমেদ, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আমির হামজা, ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য ফাতেমা বেগম। তারা সবাই রোহিঙ্গা।

৩. রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ‘জনপ্রতিনিধি’ তার সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য উল্লেখ করলাম। তবে পূর্ণাঙ্গ চিত্র আরও অনেক বেশি আতঙ্কিত হওয়ার মতো। ভোটের রাজনীতিতে রোহিঙ্গারা এখন বড় ফ্যাক্টর। বিশেষ করে বান্দরবান এবং টেকনাফে। তার একটি উদাহরণ দিই। নাইক্ষংছড়ি উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৫৭ হাজার। এর মধ্যে রোহিঙ্গা প্রায় ৩০ হাজার। সেটেলার বাঙালি ১৫-১৬ হাজার। মারমাসহ অন্যান্য আদিবাসী ১০-১১ হাজারের মতো।

পরপর দুই বারের নির্বাচিত নাইক্ষংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমদ। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে জামায়াত না করলেও জামায়াতের সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন বলে স্থানীয়রা মনে করেন। তিনি দাবি করেন কখনও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শিবিরের সঙ্গে মিলে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না বলে তাকে শিবিরের সঙ্গে জড়ানো হয় বলে তিনি বলেন। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দাবি করেন। তোফায়েল আহমদ পরপর দুইবার কিভাবে নির্বাচিত হলেন?

অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি রোহিঙ্গা বিরোধী হিসেবে পরিচিত। বাঙালি এবং আদিবাসী সবাই রোহিঙ্গা বিরোধী। একারণে তিনি বাঙালি এবং আদিবাসীদের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী রোহিঙ্গাপ্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল্লাহকে পরাজিত করেন। ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে আলোচিত ৫ জঙ্গি গ্রেফতার করা হয়। এই পাঁচ জঙ্গির একজন ছিল ‘আরএসও’ নেতা শফিউল্লাহ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে অর্থ সংগ্রহ করেছে শফিউল্লাহ। তিনি বিত্তবান হিসেবে পরিচিত। উপজেলা নির্বাচনের সময় তার প্রভাবেই তোফায়েল আহমদকে রামুর বৌদ্ধপল্লীতে আগুন ও লুটপাটের ঘটনায় সম্পৃক্ত করা হয়। তোফায়েল আহমদ জেলে থেকে নির্বাচন করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে জামিনে আছেন।

৪. এতক্ষণে যে আলোচনা বর্তমানে আসা রোহিঙ্গারা সেই হিসেবের বাইরে। পূর্বে আসা রোহিঙ্গারা কিভাবে বাংলাদেশের একটি অঞ্চলের রাজনীতিকে প্রভাবিত করছেন, তা এই আলোচনা থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাওয়ার কথা। বর্তমানে জাতিসংঘের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী রোহিঙ্গা এসেছে ৩ লাখ ৭০ হাজার। বাস্তবে এসেছে ৫ লাখের উপরে। প্রতিমুহূর্তে আসছে। এই লেখা যখন লিখছি, আপনি যখন পড়ছেন, তখনও আসছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে পূর্বের নীতি ঠিক ছিল না। এখনও ঠিক নেই। ‘আসতে দেব না’ থেকে এখন হঠাৎ ‘মানবিক’ কারণে আশ্রয় দেওয়ার নীতি নিয়েছি। আশ্রয় দেওয়াটাই সঠিক নীতি। এক জায়গায় রাখা, তালিকা করাটাও খুব জরুরি। সেই উদ্যোগ নেওয়ার জন্যে সাধুবাদ জানাই সরকারকে। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিবিদ-এমপিদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনও উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। তালিকা করার বাইরে ভোটার করার প্রক্রিয়া থেকে স্থানীয় রাজনীতিবিদরা বিরত থাকবেন, বিশ্বাস করা কঠিন।

এবার আসা রোহিঙ্গারা পূর্বে আসা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় টেকনাফ-কক্সবাজার-বান্দরবানে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় রাজনীতিবিদরা সহায়তা না করলে, রোহিঙ্গা হিসেবে তালিকা করা কঠিন।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্থানীয় নেতৃত্বকে প্রভাবিত বা বাধ্য করতে পারবেন বা করবেন, খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। আটকাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ‘আশ্রয়’ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হওয়া যাবে। তবে ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু না হলে ১০-১২ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে ভয়ঙ্কর সংকটে পড়তে হতে পারে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ