X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

কেন এই সিলেবাস?

কাকলী প্রধান
৩১ মে ২০১৭, ১৩:০৬আপডেট : ৩১ মে ২০১৭, ১৩:১৬

কাকলী প্রধান আমি খুব সাদামাটা একজন মানুষ। সাধারণ এবং কিছুটা বোকা মানুষও বটে। চোখের সামনে যা ঘটে তা খুব সাধারণ চোখেই দেখি। ভাবি, এটাই বুঝি নিয়ম। এমনই বুঝি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিছু বিষয় চোখের সামনে এমনভাবে নড়াচড়া করছে যে আর কিছুতেই বোকার মতো বসে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। আমি লেখক কলামিস্ট নই যে কলমের এক খোঁচায় একটা গোটা ব্যবস্থা নড়ে যাবে। মন্ত্রীর দফতরে ছোটাছুটি শুরু হয়ে যাবে আর আমাদের শিক্ষার্থী সন্তানরা আগামী পরশু থেকেই হাসি মুখে স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে দৌড়বে। হ্যাঁ বিষয়টা স্কুলের পড়াশোনা, স্কুল ব্যাগ আর এর পাহাড় সমান চাপের কথাই আজ বলতে চাই।
আমার ছোট বোনের ছেলে রাজধানীর একটি স্বনামধন্য বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। প্লে গ্রুপ থেকে আজ অবধি ফাইভ অন ফাইভ, টেন অন টেন, হানড্রেড অন হানড্রেড। এই গল্প শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। মাঝে মধ্যেই বলে ফেলি কী লাভ! এদের জীবনে কি আর কোনও গল্প থাকবে না! নাচ, গান, তবলা, কবিতা কিছুই থাকবে না? থাকবে। তবে সেটাও শুধুমাত্র প্রতিযোগিতায়। বছরের শুরুতে পড়াশোনার চাপ কিছুটা কম। এই আশা নিয়ে পরিবারের সব শিশু সদস্যের নিয়ে ভাবলাম ঘুরে আসি কোথাও থেকে। শহর থেকে দূরে। সারি নদী সবুজ পানি দেখিয়ে নিয়ে আসি। না, সেখানে বাধ সাধল প্রবল পড়াশোনার চাপ। এই বাচ্চা যেতে পারবে না তো সেই বাচ্চার শুরুতেই ক্লাস টেস্ট মানে ‘সিটি পরীক্ষা’? বছরের শুরুতেই? কী জানি বাবা! আমাদের পূর্ব পুরুষরাও জজ ব্যারিস্টার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। আমাদের যুগে আমরাও দেশের পিছিয়ে পড়া সদস্য হইনি। কিন্তু এটা কোন যুগ আর কোন শিক্ষা মহামারি চলছে। বোকা সাধারণ মানুষ আমরা। তাই শিউরে ওঠে গা। আতঙ্কিত হই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেড়ে ওঠা দেখে।
কয়েকজন শিশু সদস্যকে চোখের জলে ভাসিয়ে শিক্ষা স্কুল এবং শিক্ষকদের অভিশাপ দিতে দিতে বেরিয়ে পড়লাম। সিলেটে পৌঁছে পরদিন সারি নদীর মাঠে উপস্থিত হলাম। ঢাকা থেকে একের পর এক প্রিয় মুখগুলোর ফোন। মাম তুমি এখন কোথায়? কী দেখছ! আমি? আমি এখন নীল নদীর জলে ভাসছি। সবুজ বর্ণ সবুজ পাহাড় দেখছি। বুক ভরে বাতাস নিচ্ছি। আমি লজ্জিত এই সুন্দর তোমাদের চোখে এঁকে দিতে পারলাম না। প্রিয় শিশুদের সচেতন বাবা-মা’রা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবার। আসছে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেরিয়ে পড়বে ওরা। হায় বিধি বাম! গ্রীষ্মকালীন ছুটি হলো ঠিকই। তবে সঙ্গে আছে প্রতিটি বিষয়ের জন্য লম্বা সিলেবাস। স্কুল খোলার পরদিনই পরীক্ষা। বাংলা মূল বই এর সাথে ব্যাকরণ। পঞ্চাশটি বাগধারা। ভাবসম্প্রসারণ, ভাব সঙ্কোচন। ওদের ছোট ছোট মুখগুলো শুকিয়ে গেছে। ধর্ম আর আরবির সিলেবাস দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। অবাক হয়ে ভাব ওয়ান টু থ্রি’র বাচ্চাদের এইসব পড়তে হবে। আমাদের সময়ের একজন বলল, মাম আমাদের এবারও ইংরেজি, সমাজ, বিজ্ঞান ব্লা ব্লা ব্লা। মনে হলো সব বই খাতা টুকরো টুকরো করে নীল আকাশে উড়িয়ে দেই। হবে না তাই না? করুন মুখ কথা যদি বলি তাহলে বলতেই হয়- আমরা পড়াশোনাও করতাম। ছিল অখণ্ড অবসর। নাচ গান কবিতামুখর ছিল প্রতিটি দিন। গ্রীষ্মের ছুটিতে দাদা বাড়ি নানা বাড়ি ঘুরে বেড়ানো। ঈদের ছুটিতে ছিল না কোনও পড়াশোনার বালাই। বছরে দুটো পরীক্ষা। জীবনে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। ক্লাস থ্রি ফোরেই আমাদের রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দ দাশের সুকান্ত ভট্টাচার্যের অন্তত পঞ্চাশ ষাটটি কবিতা মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। আজ ওরা এখন পড়লে তখন ভুলে যায়। আদতে সম্ভবও নয়। এমন চাপ মাথা নষ্ট হওয়ার জোগাড়। স্কুলগুলো কী শেখাতে চায় কী ধারণ করাতে চায় আমরা বোকা মানুষগুলো যেন কিছুতেই বুঝতে পারছি না।

স্কুল শিক্ষকরা হয়তো ভাবছেন- ‘মুর্খ’ অভিভাবকের দল। ঢাকার স্কুলগুলোর অসিহিষ্ণু প্রতিযোগিতার হাওয়া শহর মফস্বলেও ছড়িয়ে গেছে। সেই দিন বোধহয় দূরে নয় যেদিন আমরা আমাদের শিশুগুলো সহ নতুন একটি দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হবো। যে রোগের নাম স্কুল প্রতিবন্ধী। আমরা সচেতন অথচ বোকা বাবা-মা’রা কি একবার দেয়াশলাই এর বাক্স থেকে দেয়াশলাই এর কাঠির মতো বেড়িয়ে আসতে পারি?

আসুন সচেতন বাবা-মারা চিৎকার করে বলি- আমরা আমাদের সন্তানদের এমন ভবিষ্যৎ দিতে চাই না। এমন শিক্ষা দিতে চাই না যাতে ওরা মানুষ হবে না। আসুন ওদের মানুষ বানাই। ওরা সবুজ দেখুক। নাইবা হলো প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয়। যাক না ওরা বাংলাদেশের নদীর কাছে। নাইবা হলো কবিতায় প্রথম তবু কবিতা চিনুক। ছুটির দিনগুলোতে ওরা যেন একবার গ্রামের ফসলতোলা দেখতে পায় যেন দাঁড়াতে পারে কৃষকের পাশে। ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে যেন খড়ের গাদায় জোনাকির জ্বলে থাকা দেখতে পায়।

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী আপনি কি আমার আজকের সন্তানদের চেয়ে স্কুলে অনেক কম পড়ার চাপ নিয়েও আজ দেশ সামলাচ্ছেন না? প্রিয় শিক্ষামন্ত্রী আপনি কি আপনার স্কুল জীবন এতো দূর্বিসহ চাপের মধ্যে কাটিয়েছেন? প্রিয় শিক্ষা সচিব শিক্ষক মহাদয়- আপনারা? আপনাদের স্কুলে আনন্দের গতিধারায় কি আপনারা ভেসে বেড়াননি? তাহলে আমাদের সন্তানদের অপরাধ কোথায়? যে শব্দ ওরা এখনও উচ্চারণ করতে শেখেনি সেই শব্দের জটিল ব্যাকরণ আপনারা কেন চাপিয়ে দিচ্ছেন ওদের ওপর। ওদের পিঠের ওপর একটি ফুলের বোঝা দিন। ওদের দশটি ফুলের বোঝা এমনি চাপালে সব ফুলই নষ্ট হয়ে যাবে। ওরা একটি ফুলও রক্ষা করতে শিখবে না। আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘোর আমাবস্যা চলছে। জানি না এই অন্ধকার কবে কাটবে। কবে আমরা ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবকরা পাঠ্য বই এবং শিক্ষকদের কড়া চোখ থেকে রেহাই পাবো!

লেখক: সিনিয়র ফটোগ্রাফার, কালের কণ্ঠ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ